সোহেলের গ্রামের বাড়ি ঠিক গ্রামে না।নারায়নগঞ্জে গৃহস্থ বাড়িই ছিলো তার দাদার।আগে মাটির ঘর ছিলো,এখন আধা পাকা ঘর।সিমেন্টের তৈরি বাড়ি,উপরে টিনের চাল।বেশ বড় জায়গা নিয়ে বাড়ি।সোহেলের দুই চাচা আর এক ফুফু ঢাকায় থাকে।এক চাচার বিধবা বউ আরেক অবিবাহিত ফুফু নিয়ে তার মা এখানে থাকে।নিজের দুই ভাইয়ের একজন থাকে জার্মানিতে,আরেকজন সাউথ আফ্রিকা।শিউলির সাথে পালিয়ে বিয়ে করার পর প্রায় তিন বছর কোনো যোগাযোগ ছিলো না কারো সাথে।তিন বছর পর ভিনা হওয়ার সময়ে আবার সম্পর্ক জোড়া লাগে,কিন্তু শিউলিকে কখনোই মেনে নেয়নি সোহেলের মা।উপরন্তু ভিনা হওয়াও তেমন খুশি হননি,শখ ছিলো নাতি হবে।নিজে তিন তিনজন পুত্রের জননী,এরজন্য শ্বশুর বাড়িতে আলাদা দেমাগ ছিলো তার।তিন ছেলের দুই ছেলে মায়ের একান্ত বাধ্যগত ছিলো।মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে করে সুন্দরমত বাইরে সেটেল হয়ে গেছে।এইযে গেছে,আর ফিরে আসেওনি,যোগাযোগ ও করেনি।বড় ছেলের ঘরে দুই ছেলে এক মেয়ে,মেঝ ছেলের ঘরে এক ছেলে এক মেয়ে।ফোনে ফোনেই যা দেখা হয়েছে,সরাসরি অতি আদরের নাতিদের দেখার সৌভাগ্য হয়নি সোহেলের মার।তাও তিনি খুশি,বুক ফুলিয়ে বলেন তার তিন নাতি আছে,এইযে যে বলতে পারেন,এতেই পরম শান্তি।কিন্তু যত সমস্যা পাকিয়েছে ছোট ছেলে, মানে সোহেল।ছোট থেকেই চাপা স্বভাবের ছিলো,কিন্তু পড়াশোনায় বেশ ভালো।এই শান্ত ছেলে যে মায়ের অবাধ্য হয়ে পালিয়ে বিয়ে করবে,কোনোদিন কল্পনা করেননি।তিন ছেলের মধ্যে সোহেলকে নিয়ে তার বেশি আশা ছিলো।শিউলি মারা যাওয়ায় বিন্দুমাত্র দুঃখ পাননি,বরং খুশি হয়েছিলেন এইভেবে,এইবার ছেলের জন্য মনমত মেয়ে নিয়ে আসবেন,কিন্তু কে শোনে কার কথা,এইবার আরো এক ধাপ এগিয়ে বন্ধ্যা বেশি বয়সের এক মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে।বিয়ের পর তাই ছেলের বাসায় যাননি,যোগাযোগের ও প্রয়োজন মনে করেননি।
সকালে জ্যাম না থাকায় বেশ জলদিই পৌঁছে গেলো সোহেল আর মুনা।বাড়ির সামনের খালি জায়গার এক পাশে গাড়ি রাখতে বলে নেমে আসলো।সকাল সকাল না বলে হুট করে সোহেলের আসায় অনেক বেশি অবাক হলেন সোহেলের মা জমিরা বেগম।
-কী রে?কী মনে কইরা আইলি?
-তোমাদের কথা মনে পড়লো তাই।আর মুনাও তোমাদের সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলো।
মুনার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখে বেশ রুক্ষভাবেই জমিরা বেগম বললেন-
-বিয়া হইসে ম্যালা দিন আগে।এহন কিসের জন্যে মনে পড়লো?নাকি শ্বশুর বাড়ির সয় সম্পত্তি দেখবার আইসো?
মুনা বেশ ঘাবড়ে গেলো।বিয়ের দিন আঁচ করতে পারেনি যে শ্বাশুড়ি এত জাদরেল।ঢোঁক গিলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
-কী রে মুইনা?এতদিনে তো একবার টেলিফোন ও দিলা না,আইজকা কী মনে কইরা?
-ভুল হয়ে গেছে মা,ভুল শুধরাতেই এসেছি।
পেছন থেকে সোহেলের চাচি আসমা আর ফুপু রেহানা এসে জমিরা বিবিকে সামলে নিলো,নাহলে এক্ষনি ফেঁটে পড়তেন তিনি।
-এই প্রথমবার সোহেলের বউ আইসে বাড়িতে,বসতে তো দেন আগে!(আসমা)
-তুমি বেশি কইয়ো না আসমা।আমার বউ আমি কমু!
-মুনা, তুমি ভিতরে আইসা বসো।(রেহানা)
মুনা রেহানার পেছনে তার ঘরে চলে গেলো।সোহেল উঠানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।ধারণা ছিলো এমন কিছু হতে পারে।জমিরা বিবি ছেলেকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
-তোরে কী আলাদা কইরা কওন লাগবো?যা ঘরে বস।
সোহেল অস্বস্তি নিয়ে মায়ের ঘরে বসলো।কিছুক্ষণ বাদেই আসমা এসে ফল আর পানি দিয়ে গেলো ঘরে।জমিরা বিবি এসে বিছানার উপর পা উঠিয়ে বসলেন।
-এতদিন পর কী দ্যাখতে আইছোস?মা মইরা গেসে নাকি?
-এভাবে বলো না মা...
-তো ক্যামনে কমু?দুইবার বিয়া বইলি,একবার বয়স কম সিলো,মানলাম,হুজুগের মাথায় শিউলিরে আনছোস,পরের বার কী মায়ের কথা শোনা যাইত না?
-আমি তো বিয়ে করতে চাইনি মা,ভিনার জন্য সৎমা আনার কোনো ইচ্ছা আমার ছিলো না।তোমার কথা রাখার জন্যই বিয়ে করেছি মুনাকে।
-অনেক উপকার করছোস ঐ বাজা মাইয়া বিয়া কইরা।পোলার বাপ হইতে পারবি জীবনেও?আরে তোর বউ তো বাচ্চাই দেবার পারবে না।
-আমার বাচ্চা লাগবে না আর।এমন তো না যে নেই।ভিনাই আমার সব।
-এ্যত এ্যত ট্যাকা কী করবি?গরিব মাইনষেরে খাওয়াবি?
সোহেল চুপ করে থাকলো। অনর্থক তর্কে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না।এর মধ্যে রেহানা এসে জিজ্ঞেস করলো দুপুরে কী রান্না করবে।
-এত জিগানের কী আসে।ছেলে আইসে বউ নিয়া,ভাত তো খাওয়ামু না।পোলাও মাংস পাকা।
-লাগবে না মা,আমি বেশিক্ষণ থাকবো না।
-বসবিই যখন না তাইলে আইলি ক্যান?
-মুনা সবার সাথে পরিচিত হতে চাচ্ছিলো।
-এইহানে তো কেউ নাই।তোর চাচাগো খবর দেই।যারা আওনের আসুক।
-ঝামেলা হয়ে যাবে না?
-যেই পেরশানি দিলি আমারে,এরপর আর কিসু কইস না।
এরপর পাশের বাড়ির ওয়াকিল মিয়ার ছেলের ফোন দিয়ে সবাইকে দাওয়াত দিলেন জমিরা বিবি,দাওয়াতের চাইতে হুকুম বলাই ভালো।এরপর কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
মুনা রেহানার সাথে বসে আছে।কী কথা বলবে বুঝতে পারছে না।এক বিপদ থেকে বাঁচার জন্য নাটক সাজিয়ে এখন আরেক বিপদে পরে গেছে।জরজেটের শাড়ির একপাশ সড়ে গিয়েছিলো মুনার,রেহানা সেটা ঠিক করে দিতে দিতে নিজেই কথা শুরু করলো-
-কতদিন যেন হইলো তোমার বিয়ার?
-সাড়ে তিন বছর।
-বাচ্চা নাও নাই ক্যান?
মুনার চোখ ভিজে এলো।যতবার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে ততবার যেন কেউ ছুড়ি দিয়ে এফোড় ওফোঁড় করে দিয়েছে।
-আমি সমস্যা আছে,মা হতে পারবো না।
-কে কইছে?
-ডাক্তার
-ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করবা না।এরা হইলো ধান্দা করে।আল্লাহর দুনিয়ায় কত কিসু যে হয়!মনে আশা রাইখো।আমগো পাশের বাড়ির জোছনা রেও এমন কইসিলো ডাক্তার,এখন চারডা পোলাপান। হুজুরের কাসে গেসো কোনো?
-না..
-হায়রে!কামের মানুষের কাসে না গিয়া আকামের মানুষের কাসে গেলে এমনি হইবো।এমনি অসুখ বিসুখ আর বাচ্চা না হওয়া দুইডা আলাদা।অনেক সময় খারাপ বাতাস লাগলেও বাচ্চা হয় না,হেই বাতাস কাটায় দিলে সব ঠিক হইয়া যায়।দুপুরে খাইয়া আমার সাথে আজমির খালার বাড়ি যাইবা,বুঝলা?ওনিই জোছনা রে ফু দিয়া দিসিলো।অনেক বড় আলেম মানুষ।
-জ্বি আচ্ছা।
-এহন আমার সাথে দেহানের জন্য হইলেও পাকঘরে আসো।নাইলে ভাবী তোমারে গিলা ফেলাবে।
মুনা শাড়ি ঠিক করে রেহানার পিছে গেলো।সেখানে আসমা বড় রুই মাছ কাটছে।পেছনে পিড়িতে বসে জমিরা বিবি সব তদারকি করছেন।
-কী রে রেহানা,নয়া বউর কান ভরা হইসে?
-ভাবী এসব কী কও তুমি?
-চুপ! যা কাম কর।আর বউ তুমি কিসের জন্য এহানে?যাও ঘরে বসো।এমনিই অনেক বদনাম আমার,পরে কথা উঠবো যে জমিরা নয়া বউ রেও ছাড়ে নাই।
দুপুরের দিকে সোহেলের মেজ চাচা চাচি আর বড় ফুপু আসলো।সবাই মিলে দুপুরের খাওয়া শেষ করে উঠোনে বসলো।শহরে থাকার সুবাদে তাদের চালচলন আর ভাষা সোহেলের মতই।জমিরা বিবি মুনার বন্ধ্যাত্ব নিয়ে অনেক হা হুতাশ করলেন তাদের সামনে,কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না।বড় ফুপু রেনু বললো-
-এসব কোনো ব্যাপার না ভাবী।চাইলে টেস্টটিউব বেবি নিতে পারে ওরা।
-আমি ওইসব টিউবের বাচ্চা চাই না,আমি সোহেলের বাচ্চা চাই।
রেনু বোঝানোর চেষ্টা করলো না।সোহেলের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত একটা হাসি দিলো।কিছুক্ষণ পর জমিরা বিবি বললেন-
-আইচ্ছা,কী জানি কইলা রেনু?তুমি তো আবার আধা কথা কও।কী যেন টিউবের কথা না কইতাসিলা?
-জ্বি
-বাচ্চা হয় ঐডিতে?
-জ্বি ভাবি।একটু খরচের ব্যাপার।
-মা বাপ ভুইলা সোহেল ম্যালা টাকা কামাইসে।টাকা নিয়া ভাইবো না।
এরপর সোহেলের দিকে তাকিয়ে বললেন-
-কী রে,তুই জানোস না এই ব্যাপারে?
-জানি
-নাইলে বাচ্চা নেস না ক্যান?
সোহেল কোনো উত্তর দিলো না।জমিরা বিবি উঠে গেলেন রাগ করে।সোহেলের চাচা আর ফুপুও বিদায় নিলো।এরকম অসুস্থ পরিবেশে তারাও থাকতে ইচ্ছুক না।সবাইকে বিদায় দিয়ে সোহেল ঘরে এসে দেখে মুনা নেই।আসমা কে জিজ্ঞেস এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে আসমা বললো রেহানা মুনাকে আশপাশ দেখাতে নিয়ে গেছে।ব্যাপারটা খটকা লাগলেও সোহেল কিছু বললো না।
•
মুনা পুরোনো একতালা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।এখানে রেহানার তথাকথিত আজমির খালা থাকেন।মুনাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেহানা ভিতরে গেলো,প্রায় মিনিট দশেক পর এসে বললো,
-বুঝলা,আলেম মানুষ। সহজে দেখা করে না।আমারে এস্নেহ করে দেইখা রাজি হইসে দেখা করতে। তোমার শরীর পাক তো?
-মানে?
-মানে মাসিক আসে নাকি এখন?
-না।
-যাক ভালো,যাও বাইরের ঐ গোসলখানা থেইকা ওজু কইরা আসো।এরপর তোমারে নিয়া যাইতেসি।ওনি আবার শাড়ি পিন্দা পসন্দো করে না।যাই হোক,ঠিকমত ঢাইকা যাইয়ো।
মুনা ওজু করে সব ঠিকঠাক করে ভেতরে গেলো রেহানার সাথে।খুবই সাধারণ বসার ঘর।আলো না আসার কারণে অন্ধকার হয়ে আছে।এর পরে আরেকটা ঘর আছে।সেইখানেই কাঙ্ক্ষিত আজমির খালাকে পাওয়া যাবে।অনেক্ষণ বসে থাকার পর কম বয়সী একটা মেয়ে মুনাকে ডেকে নিয়ে গেলো।
মুনা ভেতরে যেয়ে দেখলো সাদা বিশাল ওড়না জড়িয়ে হালকা রঙ্গের কাপড় পড়া এক বয়স্ক মহিলা বিছানার উপর বসা।তার পুরো চেহারায় এক প্রশান্তির ছাপ।বয়স হলেও খুব মায়াবী দেখতে। মুনা সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।উনি খুব ধীর এবং ভরাট গলায় বললেন
-বসো এখানে।তারপর কও কী সমস্যা?
মুনা কিছুটা অবাক হলো।রেহানার বর্ণনা অনুযায়ী যেরকম কল্পনা করেছিলো,তার কিছুই এই মহিলার সাথে মিলছে না।
-আমি কখনো মা হতে পারবো না।
-সত্যি মা হইতে চাও তুমি?
মুনা কিছুটা হকচকিয়ে গেলো।
-হ্যাঁ
-নিজের অন্তর পাক করো তাইলে।পাক অন্তর,আর পাক শরীর হইলেই আল্লাহর নেয়ামত আসবো তোমার কাসে।
মুনা নিশ্চুপ হয়ে থাকলো।আজমিরি নিজেই আবার বলা শুরু করলেন-
-জীবনডা বড় ক্ষণিকের,এই ক্ষণিকের জীবনে তুমি সব পাইবা না।যদি পাইতে চাও,সব খোয়ানো লাগবে।সবুর কইরা আল্লাহরে ডাকো।এবার যাও।
মুনা বাইরে বেরিয়ে আসলো।রেহানা উৎসুক হয়ে বললো,
-দেখবা এইবার সব ঠিক হইয়া যাইবো।
-ইনশাআল্লাহ।
রেহানা বাড়ি ফিরতেই জমিরা বিবির কাছে ধমক খেলো।গায়ে না লাগিয়ে নিজের মত কথা বলে গেলো।সন্ধ্যার দিকে রওনা হলো বাসার দিকে। পুরো গাড়িতে সোহেল মুনার কেউ কথা বললো না,কেউ না....
•
কলোনির সেই টঙের বাইরে বসে চা খাচ্ছে যাবির আর ভিনা।
-যাবির,আজকে যা করেছো,আর করবে না কখনো।
-কী করেছি?
-ছাদে যেটা করেছো
-কী?বলবে তো?আমি তো বুঝতেই পারছি না।
-তুমি বুঝতে পারছো যাবির।আমি সিরিয়াস এখন।
-কেন করতে পারবো না?
-আমি বলেছি তাই।
-অনেক বেশি খারাপ লেগেছে?
-হ্যাঁ
চা শেষ হওয়ার পর যাবির ভিনার হাত ধরে কলোনির সেই পুকুর পাড়ের সামনে আসলো।
-তোমার কি সত্যিই খুব খারাপ লেগেছে ভিনা?নাকি ভয় হচ্ছে তুমি নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না?
ভিনা হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। এই ছেলের সাথে থাকা যাবে না।কোনোভাবেই না।
-এখন তো আটকে রাখার অধিকার নেই।তাই পারলাম না আটকাতে।কিন্তু একদিন আমি ঠিকি আটকাবো।সেদিন অধিকার থাকুক বা না থাকুক।
-সেদিন আসবে না।
-আমি আনবো।
-দেখা যাবে।
-বাসায় যেয়ে জানিয়ো। যদি না জানাও,ভাববো তুমি আমাকে ভয় পাও।
ভিনা জানে শেষের কথাটা যাবির ইচ্ছে করেই বলেছে।তবুও রাগে চড়ে গেছে মাথায়।প্রায়ই ইচ্ছা করে যাবিরের থেকে দূরে চলে যেতে।কিন্তু ভিনা জানে,এই জনমে যাবির থেকে দূরে সরে যাওয়া সম্ভব না।দিন দিন ছেলেটা আরো অসম্ভব করে ফেলছে ব্যাপারটা।
.
.
.
চলবে...............................................