অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৪৭ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


‌মুনা নিজের ঘরে ঢুকে দেখলো সোহেল সিগারেট খাচ্ছে,তার মানে কোনো বিষয় নিয়ে খুব আপসেট।ভিনা মেয়ে হয়েও এই বদ অভ্যাস কোথা থেকে পেয়েছে সেটার প্রমাণ চোখের সামনেই।রক্তের ব্যাপার গুলো এড়ানো যায় না।রক্ত!মুনার ভেতর টা অনিশ্চয়তার যন্ত্রণায় ডুবে যাচ্ছে।হাজার হোক,সোহেল আর ভিনার সম্পর্কে রক্তের টান আছে।ভিনা হাজার দোষ করলেও সোহেল ক্ষমা করে দিবে,শুধু তাই না,বুকেও টেনে নিবে। কিন্তু মুনার বেলায় দৃশ্যটা ভিন্ন।সোহেল যদি ঘুনাক্ষরেও আঁচ পায় ভিনার কষ্ট হচ্ছে মুনার কারণে,বিনা দ্বিধায় ওকে ঘর থেকে বের করে দিবে।আর যদি মুনার বাবাকে দেয়া কথার প্রশ্ন আসে,সেক্ষেত্রে নিজের ঘরে না রেখে অন্য ব্যবস্থা করে দিবে সোহেল।এতদিনে এই বিষয়ে ধারণা হয়ে গেছে মুনার।

-রাতে কিছু খাবে না?

-না

-কেন?

-ইচ্ছে হচ্ছে না।

-ঠিক আছে। আমিও আর খাবার গরম করলাম না।

সোহেল উত্তর দিলো না।মুনা এবারো আশা করেছিলো সোহেল খাওয়ার কথা বলবে।

-কিছু নিয়ে আপসেট?

-হ্যাঁ 

-কী নিয়ে?

-ভিনাকে নিয়ে।মনে হচ্ছে ও খুব প্রেশারে আছে।আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে,কিন্তু পারছে না।শিউলি মারা যাওয়ার আগে আমি ওর মাঝে এই অস্থিরতা খেয়াল করতাম।

-তুমি বেশি চিন্তা করছো, তেমন কিছুই না।

-নিজের সন্তানের মলিন চেহারা যে কী পরিমাণ যন্ত্রণা দেয় সেটা....

-কী?আমি বুঝবো না,তাইতো?

-বুঝবে,যদি চেষ্টা করো।আমি এর আগেও বলেছি,মা হওয়া আর মাতৃত্ব,দুটো এক না।মাতৃত্ব তুমি বাচ্চা না জন্ম দিয়েও পেতে পারো।

-আমি চেষ্টা করছি।

-আমি জানি তুমি চেষ্টা করছো।আমি চাই তোমারও শূন্যতা না থাকুক।আমি তোমাকে ভরসা করি দেখেই ভিনার সাথে তোমাকে সম্পর্ক আন্তরিক করতে নিজে দূরে থাকছি।যাই হোক,কী বললো তোমাকে?বেশিক্ষণ তো ছিলে না।

মুনা লম্বা দম নিয়ে বলা শুরু করলো-

-আগেই তো বলেছিলাম মোবাইল ওয়েটিং এ ছিলো। আমি তেমন আমলে নেইনি।এখন যখন কথা বলতে যাচ্ছিলাম,তখন প্রথমেই বললো তোমাকে না জানাতে।আমি অবাক হলাম,এরপর জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে,এরপর একটা ফোন কল আসলো,পরে বললো রুম থেকে চলে যেতে,একা থাকতে দিতে। 

-মানে?!আমি তো কিছুই বুঝলাম না।

-আমিও না,তবে আন্দাজ করছি ছেলেঘটিত কিছু হয়েছে হয়ত।

সোহেলের ভেতরে অন্যরকম ভয় ঢুকে গেলো।আসলেও তো,বয়সটাই এমন যে আবেগের বশে ভুল হয়ে যেতে পারে।এতদিনে এই ব্যাপারটা মাথায়ই আসেনি যে মেয়ে বড় হয়েছে।

-আমি কথা বলে দেখি দাঁড়াও।

-কী কথা বলবে তুমি?এরকম তাৎক্ষণিক রিয়েকশন দেখালে তো মুশকিল সোহেল,ভিনা আমাকে পরবর্তীতে কিছুই জানাবে না তোমার ভয়ে।

-তাহলে?

-শান্ত থাকো।আমি ধীরে ধীরে সবটা জেনে তোমাকে জানাবো।এর আগে তুমি এ বিষয়ে কথা বাড়িয়ো না।

-ঠিক আছে।তুমি খেয়াল রেখো ওর দিকে। 

-সেটা নিয়ে ভেবো না,আমি দেখবো বিষয়টা।

নিজে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী হওয়া সত্ত্বেও ভিনার সাথে যা করার কথা ভাবছে মুনা,সেটা নিয়ে বিবেকের কাছে দাঁড়াতে না পারলেও,অপরাধবোধকে নিজের উপর চড়াও হতে দিলো না।মানুষ একবার পাপ করা শুরু করলে,নিজে শেষ না হওয়া পর্যন্ত উপলব্ধি হয় না,বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।


ভিনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে।মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে।চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ,ওজন কমেছে বোধহয়।কম বয়সের চাঞ্চল্য নেই,এর পরিবর্তে একরাশ হতাশার ছাপ। ভীষণ একা লাগছে নিজেকে।শেষ পরীক্ষার দিন কথা দিয়েছিলো সবার সাথেই যোগাযোগ করবে,ওয়াসিম তো বেশ কয়েকবারই বলেছিলো।সব ছাপিয়ে আরশির কথা মনে পড়ছে,কেমন আছে মেয়েটা?প্রায় দিনই কলেজে আসত না,পরীক্ষার সময় ভিনাকে ছাড়া অচল ছিলো।বদমেজাজি আর রুক্ষভাষী,ক্লাসে কেউই পছন্দ করত না।তবুও এই মেয়েটা ভিনার সবচেয়ে কাছের ছিলো।অবাক হলেও সত্যি ভিনার চেহারা দেখেই আরশি বুঝে ফেলত সব।বেস্ট ফ্রেন্ড?না,বেস্ট ফ্রেন্ড ট্রেন্ড বলতে কিছু মানে না ভিনা।নওমির ঘটনার পর দ্বিতীয় কাউকে বেস্ট ফ্রেন্ড ফ্রেন্ড উপাধি দেয়ার ইচ্ছে ছিলো না।আরশির সাথে সম্পর্কটা অন্যরকম ছিলো,আত্মার সম্পর্ক যাকে বলে। অবিশ্বাস্য হলেও কলেজের পুরো দেড় বছরে ভিনা জানতে পারেনি আরশি কোথায় থাকে,যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তার নাম কী,কেমন আছে এখন,কেন কলেজে আসে না,কেন পড়াশোনা করে না,কিছুই জানে না।শুধু এতটুকু বুঝে দুজনের শূণ্যতার জায়গা এক।এই শূণ্যতাই ওদের সম্পর্কের ভিত্তি ছিলো হয়ত।আরশির সাথে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে,কিন্তু যোগাযোগের কোনো উপায় নেই।না ফোন নম্বর,না বাসার ঠিকানা।এডমিট কার্ড তোলার দিন হয়ত দেখা হতে পারে।সেদিন আরশিকে অনেক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকবে ভিনা।


-যাবির,আমার ঘরে আসো,কথা আছে।

যাবির মায়ের এই ঠান্ডা গলার ডাকে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো।জীবনে খুব কমই মায়ের কাছে এধরণের ডাক পেয়েছে।তাই ঠিক ঠিক বলে দিতে পারবে কিসের প্রেক্ষিতে এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে।

-বলো মা,কিছু হয়েছে?

-আমি খেয়াল করছি তুমি বেশ অন্যমনস্ক থাকো। কী কারণে বলো তো।

-কেন মা?এ মাসে তো আমি তোমার ওষুধ এনে দিয়েছি।বাসার বিলপত্র ও দেয়া শেষ। 

-প্রেম করো তুমি?

-হ্যাঁ? 

-স্পষ্ট করে বলো,তুমি কি সম্পর্কে আছো কোনো?

-হটাৎ একথা কেন বললে আমাকে?

-আমি শুনলাম একজনের থেকে,তাই বলছি,তুমি কি আসলেই কারো সাথে সম্পর্কে আছো?

-কার কাছ থেকে শুনেছো মা?

-যার থেকেই শুনি,আমার প্রশ্ন আমার অন্য কারো থেকে জানতে কেন হবে আমার ছেলের ব্যাপারে?

-আসলে....মা..

-আবারো জিজ্ঞেস করছি,তুমি কি সম্পর্কে আছো কোনো?

-না....মানে...হ্যাঁ, আসলে আমি পছন্দ করি,কিন্তু সেভাবে বলা হয়নি

-মেয়ে পছন্দ করে?

-হয়ত....না আসলে...করে,কিন্তু বলেনি সেভাবে।

-করেনি বলেনি হয়নি এসব কথা কেন আসছে?

-আমরা সেরকম সম্পর্কে নেই মা।

-তাহলে কীরকম সম্পর্কে আছো?

-জানি না আসলে...

-ভবিষ্যৎ কোনো পরিকল্পনা রেখেছো মেয়েকে নিয়ে?

-হ্যাঁ

-কী পরিকল্পনা আমাকে বলো তো শুনি।

-বিয়ে করবো ওকে....ও রাজি হলে....মানে রাজিই আছে।এখনো বলেনি।

-আর?

-আর?

-শুধু বিয়েই করলে হবে?আর কিছু ভাবো নি?

-দায়িত্ব নিবো ওর।

-নিজের দায়িত্ব নিতে পেরেছো এখনো?

-খুব জলদিই নিবো

-নিজের দায়িত্ব নিয়ে এরপরে সম্পর্কে যাওয়া উচিৎ ছিলো না তোমার?

যাবির বুঝতে পারছে কী উত্তর দিবে। এরকম সিচুয়েশনে কী বলা উচিৎ তাও জানে না।

-কথা বলো যাবির।

-ছিলো।

-আশা করি এরপর থেকে তুমি ঠিক কাজই করবে,আমার বলতে হবে না দ্বিতীয়বার।

যাবির উত্তর না দিয়ে চলে এলো। শেষ কথার গূড়ার্থ এটাই যে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে হবে,যেটা অসম্ভব!ভিনা নিজেই অনেক দূরত্ব বজায় রাখছে,কেন রাখছে সেটাও জানে,তাই অভিযোগ নেই কোনো।যাবির নিজেও যদি দূরত্ব বাড়াতে থাকে,তাহলে ভিনার আর ওর মাঝে যাই আছে,সেটাও থাকবে না।এই 'কিছু একটা আছে' কে কেন্দ্র করেই যাবির বেঁচে আছে।মেসেজ দেয়নি জেনেও ফোন চেক করার মাঝে প্রশান্তি আছে,কারণ দেরী করে হলেও ভিনা ঠিকি মেসেজ দিবে।এই অপেক্ষাও জীবনের বড় অবলম্বন। না....এবার আর মার কথা শোনা হবে না...
.
.
.
চলবে.................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন