অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৪৬ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


ভিনা সন্ধ্যা হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগেই ঘরে ঢুকলো।এখনো সোহেল আর মুনা এসে পৌঁছায় নেই।নিজের ঘরে যেয়ে আবার চিরকুটটা খুঁজে পেয়ে ক্ষত জায়গা যেন আরো গভীর হলো।সেটাকে মুচড়ে একটা বক্সে রেখে দিলো।ফোনে এখনো সোহেলের কল আসেনি।ফোন বিছানায় ছুড়ে ফেলার আগ মুহূর্তে যাবিরের কথা মনে পড়লো।কিছুক্ষণ বসে থেকে এরপর ফোন দিলো-

-বাসায় এসেছি।রাখি।

-ভীতুর ডিম

-এগুলা কী,ফোন দিলাম তো আমি।

-আমাকে ভয় পাও দেখেই তো ফোন দিয়েছো।

-একদম চুপ!

ভিনা ফোন রেখে দিলো। ভালো খারাপ মিলিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে।কেন এমন হচ্ছে সব?কেন যাকে আকড়ে ধরে রাখতে চাচ্ছে,সে এভাবে দূরে চলে যাচ্ছে?


গাড়িতে সোহেলের মনে পড়লো সারাদিনে ভিনাকে ফোন দেয়া হয়নি।ফোন খুঁজতে পকেটে হাত দিতেই মনে পড়লো সকালে ছবি তোলার কথা বলে মুনা ফোন নিয়েছিলো।

-আমার ফোন কি তোমার কাছে?

-হ্যাঁ, আমার ব্যাগে।

-সারাদিনে ভিনার খোঁজ নেয়া হয়নি।আমি তো সবার সাথে কথায় ব্যস্ত ছিলাম,তুমি তো ফোন দিতে পারতে।

এমনিই আজমির খালার কথা শুনে মুনার অস্বস্তি লাগছিলো,এর উপর সোহেলের এই প্রশ্ন করার ধরণ দেখে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো।

-দিয়েছিলাম,ফোন ওয়েটিং এ ছিলো।

-কয়বার দিয়েছিলে?

-বেশ কয়েকবার।

সোহেল চিন্তায় পড়ে গেলো।মুনার হাত থেকে ফোন নিয়ে ডায়াল লিস্ট চেক করে দেখলো সেখানে ভিনার নাম্বার ডায়াল করা নেই।

-এখানে তো দেখছি না আমি যে ফোন দিয়েছো।

মুনা হকচকিয়ে গেলো।এরপর দেরি না করে বললো 

-আমার মোবাইল থেকে দিয়েছি।

-অভিমান করেছে হয়ত।সকালে বলে এসেছিলে না?

-না,ঘুমে ছিলো,একটা লেটার দিয়ে এসেছিলাম টেবিলে।

-কী লিখেছিলে?

-যা দরকার তাই লিখেছিলাম।

মুনার এরকম বাঁকা উত্তরে সোহেলের প্রচন্ড মেজাজ খারাপ লাগছে।কিন্তু ড্রাইভারের সামনে কোনো সিন ক্রিয়েট না করে চুপ করে থাকলো।রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ভালো রেস্টুরেন্ট থেকে শুধু ভিনার জন্য রাতের খাবার নিয়ে নিলো।

-কী ব্যাপার,রাতে খাবে না তুমি? 

- না, ক্ষিদে নেই।

-আচ্ছা

মুনা ভীষণ খারাপ লাগলো।সোহেল একবারো জিজ্ঞেস করলো না মুনা রাতে কী খাবে।এত চেষ্টা করেও করছে,তবুও সোহেল ভিনাকেই সব জায়গায় প্রায়োরিটি দিবে।আজ প্রায় ছয় মাস হয়ে গেছে,পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।কেউ একটাবার ফোন দেয়ার ও প্রয়োজন মনে করেনি।এত অবহেলা কেন?কোনো দোষ না করেও মানুষ ঘৃণার পাত্র হতে পারে?রাস্তার ফুটপাতে বসে এক যুগলকে দেখা যাচ্ছে।হালকা শীতে মেয়েটা চাদর গায়ে দেয়া,তবুও ছেলেটা নিজের চাদর ও মেয়েটার উপর জড়িয়ে দিয়েছে।দুজনের হাতেই চায়ের কাপ,আর চোখভর্তি স্বপ্ন।এই উষ্ণতার হাহাকারে কারো সারাজীবন পার হয়ে যায়,আর কেউ না চাইতেই পেয়ে যায়।


দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই সোহেল দেখলো পুরো বাসা অন্ধকার,শুধু দোতালার কোণায় ভিনার রুমে আলো জ্বলছে।সে আলো দেখে শান্তি লাগলেও খানিকটা কষ্ট ও লাগলো,এত বড় বাসায় মেয়েকে একা রেখে গেছে দেখে খারাপ ও লাগছে।তাই দেরী না করে সোহেল উপরে সোজা ভিনার ঘরে চলে গেলো।মুনা নিচে দাঁড়িয়ে সব শুধু দেখলো।অসহ্য যন্ত্রণায় ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।পরক্ষণেই মনে পরলো ভিনাকে দেয়া চিরকুটের কথা।ভিনাকে আঘাত দেয়ার জন্য সেটা লিখলেও খামখেয়ালি তে ভুলেই গেছে যে সেটা ভিনা সোহেলকে দেখাতেও পারে।নিজের উপর ভীষণ রাগ লাগছে মুনার।দিনের পর দিন এরকম নাটক সাজাতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে গেছে।কিছু করার নেই,জীবনে যা চাচ্ছে,সেটার জন্য যেভাবেই হোক এভাবে চালিয়ে নিতে হবে।
মুনা ভিনার রুমে যেয়ে দেখলো সোহেল ভিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,ভিনা মাথা নিচু করে বসে আছে।মুনাও ভিনার পাশে বসে ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে আহ্লাদ মাখানো গলায় বললো-

-মন বেশি খারাপ তোমার?জানো তোমার বাবা তোমার পছন্দের খাবার নিয়ে এসেছে।

ভিনা কোনো উত্তর দিলো না।এই মানুষটাকে সহ্য হচ্ছে না কেন জানো।চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে রুমে থেকে বেরিয়ে যাও,আমার বাবার সাথে আমাকে থাকতে দাও,আমার বাবাকে আমার থাকতে দাও।কিন্তু পারছে না,জানে পারবেও না।আজকে মন খুলে কথা বলে নিজেকে প্রকাশ করতে পারলে জীবনের অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যেত।শিউলির এই স্বভাব যে কীভাবে ভিনা পেয়ে গেলো,আর এখন এই জন্য কী পরিমাণ কষ্ট পেতে হচ্ছে সেটা ভিনাই জানে একমাত্র। 

-কী রে মা,কী হয়েছে?

-কিছু না বাবা।

-আমাকে তো বল?

ভিনা অনেক কিছু বলতে চায়,অনেক কিছু।এতকিছু যে নিজের খেই হারিয়ে ফেলছে কথাগুলার মাঝে।
মুনা মনোযোগ দিয়ে ভিনাকে লক্ষ্য করছে।ভিনার অস্থিরতা চোখ এড়াচ্ছে না।গতবার বাজে রকম সিন ক্রিয়েট করে নিজেই ফেঁসে গিয়েছিলো,মোমেনা কে অপমানের শাস্তি হাতে নাতে শ্বশুরবাড়িতে পেয়ে গেছে।এখন সেরকম সিন ক্রিয়েটের সুযোগ নেই।মুনা নিজেকে একদম ঠান্ডা রাখলো।

-ভিনা,লক্ষ্মী মেয়ে না তুমি,বলো তো কী হয়েছে?আমাকে বলো,আমি না তোমার মা?যাও তো সোহেল,তুমি পরে এসো,মেয়েদের নিজেদের অনেক বিষয় থাকে,আমাকে দেখতে দাও।তুমি যাও।

ভিনা সাথে সাথে সোহেলের দিকে তাকালো।এরকম কিছু হোক এটা মোটেও চায়নি সে।সোহেলকেই তো পাশে দরকার সবচেয়ে বেশি।সোহেল মেয়ের আকুল চাহনির অর্থ বুঝতে পারলো না।ভিনার মাথায় হাত বুলিয়ে রুম থেকে চলে গেলো। 

ভিনা অসহায় ভাবে আবার নিচে তাকালো।মুনা ঘরের এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছে,চিরকুট টা ফেলে দিতে পারলে শান্তি।কোথাও খুঁজে না পেয়ে শেষে ভিনার দিকে মনোযোগ দিলো মুনা।

-চিরকুট কি ফেলে দিয়েছো?

ভিনা এই প্রশ্নে বেশ অবাক হলো।

-হ্যাঁ, কেন?

-এমনি,মনে হলো সেটার জন্যই তোমার মন খারাপ।তাই ভাবলাম সেটা ফেলে দিলেই ভালো হবে।আসলেই কি সেটার জন্যই তোমার মন খারাপ?

-না

-সোহেল ইদানিং খুব ব্যস্ত থাকে, তাই তোমাকে সময় দিতে পারে না,তুমি এটা নিয়ে মন খারাপ করো না।

-হুম

-পরের বার কোথাও গেলে তোমাকে অবশ্যই নিয়ে যেতে বলবো।তখন আর আমার কথা ফেলতে পারবে না সোহেল।

ভিনা বিছানার চাদর শক্ত করে ধরে নিজেকে সামলালো।এমন দিন এসেছে যে সুপারিশ করে নিজের বাবার সাথে বাইরে যেতে হবে।

-আমাকে একা থাকতে দিন।প্লিজ।

মুনা চলে গেলো সাথে সাথেই,হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন।প্রতিদিনকার এই ড্রামা অসহ্য হয়ে উঠছে।ভিনার পার্মানেন্ট একটা ব্যবস্থা না করে উপায় দেখছে না।বাপ মেয়ে একসাথে থাকলে এক না একদিন ঠিকি মুনার এই কুকর্মের কথা সামনে এসে পড়বে,তখন ভালোবাসা তো দূরের কথা,মাথা গোঁজার ঠাই ও হারাতে হবে।
.
.
.
চলবে.................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন