অবন্তীই কিন্তু একমাত্র, যে নির্দ্বিধায় তোকে বিশ্বাস করে ।হ্যা এবার একটু ভুল বা দোষ হয়েই গিয়েছে তোর দ্বারা। কিন্তু এক বার সব কিছু জানলে? ছেড়ে চলে যাবে ও তোকে । চলে যাবে..."
.
নিজের ভেতরের সত্ত্বা বার বার অভ্রনীলকে বলে যায় কথাগুলো !
.
.
অবন্তী আগে আগে যায়, অভ্র মনে অজানা ভয়ের আশঙ্কায় পিছু পিছু হাটে ।
— কি ব্যাপার আপনি আসছেন কেন? আপনি নাকি চেঞ্জ করবেন, ফ্রেশ হবেন?
— না চলো দেখি তোমার কিসের এত বই পড়ার তাড়া ।
— আচ্ছা চলুন
.
.
রুমের দরজা খুলে অবন্তী বেশ অবাক হয় । এত অগোছালো কেন? কেউ ইচ্ছে করে এসব ওলট পালট করে রেখেছে তাই মনে হচ্ছে। আগে যখন এ রুম লক করা ছিল না তখন অবন্তী কৌতূহল বশত ঢুকেছিল কয়েকদিন। বই ও নিয়েছিল দু একটা । কিন্ত তখন তো এরকম অগোছালো ছিল না । নিশ্চই অভ্র এসব করেছে ।
.
— কি ব্যাপার অভ্রনীল রুমের এ অব্স্থা করে রেখেছেন কেন?
— আমার ইচ্ছে ।
— কি এত বই পড়েন আপনি দেখি সেগুলো আমিও পড়ব ।
.
.
বলেই অবন্তী টেবিলের ওপরে রাখা ছড়ানো ছিটানো বই গুলো হাতে নিয়ে দেখতে থাকে ।
.
— এগুলো পড়ার কি দরকার ? আলমারি থেকে নাও। তুমি যে টাইপ বই পড়ো ওগুলো আলমারিতেই আছে।
.
অবন্তী কোন উত্তর দেয় না । বই গুলো অভ্রনীল এত বেশি দাগিয়ে দাগিয়ে পড়েছে, ফাইনাল এক্সামের আগেও বুঝি এত বেশি বই দাগায় না। যত রকম হাইলাইটার ইউজ করা যায় সব করেছে । তার ওপর লাল, নীল কালির জেল পেন দিয়েও কিছু কিছু আবার দাগিয়েছে ।
এগুলো ব্যাপার ও এত আশ্চর্য লাগত না, যদি বই গুলো কোন স্বাভাবিক গল্প, উপন্যাসের বই হতো ।
.
কিন্তু এগুলো সব গুলোই সাইকলজিকাল বই। দু একটা দেশি আর বেশির ভাগই বিদেশি।
.
অবন্তীর এমন তিক্ষ্ণ চাহুনি অভ্রর হার্টবিট বাড়তে সক্ষম। এই বুঝি বুঝে ফেলল সব কিছু । কি উত্তর দেবে এখন সে?
অভ্র মাথা নিচু করে দুহাতের আঙুল গুলো কচলাতে থাকে ।।
.
.
— এসব কি অভ্রনীল?
.
অভ্র কোন কথা বলে না । ঢোক গেলে বার বার। ছোট বাচ্চারা কোন গুরুতর অপরাধ করার পর ধরা পড়লে যেরকম করে ঠিক সেরকম করছে।।
.
.
— আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি। কি এসব?
.
অবন্তী একটা বই অভ্রর মুখে ছুড়ে মারে। অভ্র হাটু গেড়ে বসে পড়ে অবন্তীর দু পা ধরে কাদতে আরম্ভ করে দেয়।
এবার অবন্তী আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে যায় । কাদার মতো কি হলো এখানে? কোন পাগলের সাথে বসবাস তার এত দিন ধরে?
.
.
— মাফ করে দাও প্লিজ। অবন্তী ...আমি কিন্তু আমাদের ভালোর জন্যই ...আমি বলছি সবটা ...আমি আসলে
.
— হ্যা , বলুন বলুন..আমি আসলে , ইয়ে , মানে ...এভাবে নতুন কথা বানাতে হবে আবার তাই তো?
— না না সত্যি বলছি।
— আগে পা ছাড়ুন আমার । ছাড়ুন বলছি।অর্নি আপু ঠিক ই বলে। আপনি যে কি সত্যি বলেন আর কি মিথ্যে এসব বোঝা কারো পক্ষেই সম্ভব নয় । মিথ্যে বলতে বলতে আপনার অবস্থা কেমন হয়ে গেছে জানেন? ছোট বেলায় পড়া সেই "A Lair Shepherd " গল্পের রাখালের মতো । এই সব ছাতালাতা বই কেন পড়েন আপনি? মাথাটা আবার নষ্ট করতে তো? কি অবস্থা করে পড়েছে তাও আবার ! যুদ্ধ করেছেন মনে হচ্ছে বই গুলোর সাথে । আমি ডক্টর আপুকে বলে দেবো তো এসব । আপনি কেন এমন করেন? নিজে নিজে পাগল হতে চান ইচ্ছে করে?
.
.
"ভাগ্যিস কাদতে কাদতে সব বলে দিই নি । উফ্ফ আমিও না ! মাঝে মাঝেই কেন যে ভুল করে ফেলতে নিই ।"
অভ্র হাফ ছেড়ে বাচে, নিজের মনকে এসব কথা বলে নেয় সে । অভ্র বুঝতে পারে সে এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে। আর সামাল দিতে হলে কি কি করতে হবে তাও তার জানা । এত এত সাইকোলজিক্যাল বই পড়ে যদি এটুকু না বোঝে তাহলে আর কি!। সাইক্র্যাটিস্ট রা একাডেমিক ভাবে সাধারণত যে বই গুলো পড়ে পেশেন্ট এর ভেতরের ব্যাপার গুলো বোঝার জন্যে , অভ্র সেগুলোও পড়ে নিয়েছে অনেকবার । শুধু পড়ার মতো পড়েই নি, প্রত্যেকটা লাইন, দাড়ি, কমা গুলো ও বোঝার চেষ্টা করে করে পড়েছে।
.
.
— দেখো অবন্তী এটা সম্পূর্ণ আমার টেস্ট। আমি কি রকম বই পড়ব না পড়ব সেটা আমার ব্যাপার।
— তাই বলে এসব কি? সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পড়ার মতো বই পড়তে পারেন না? এসব পাগলের বই, এসব পড়লে আপনি পাগল হয়ে যাবেন।।
— তুমি নিজেই পাগল তাই এভাবে ভাবছ।
— হ্যা আমি পাগল কিন্তু আপনার মতো পাগল না। ইকনমিক্স এর স্টুডেন্ট হয়ে সাইকোলজীর স্টুডেন্ট দের বই যে এভাবে পড়ে সে আমার চোখে পাগল বৈ কিছু নয়। আমি রেহানা আপু কে বলে দেবো তো আপনার পেশেন্ট একটুও সুস্থ হয় নি। সে এখন ইচ্ছে করে পাগল হতে চায়।
— শোন, আমি যখন এসাইলেমে ছিলাম তখন রেহানা আপুই আমাকে এসব পড়তে বলত। সত্যি বলছি
— মিথ্যা বলছেন আপনি। আমি এক্ষুনি ফোন করছি ওয়েট।
— না না একদম না ।
— ধরা পড়ল তো চোর?
— আচ্ছা তুমি কি চাও বলো
— এসব আর পড়বেন না তো?
— না
— আপনার কথার দাম নেই। চলুন এগুলো সব পুড়বেন এক্ষুনি ।
.
.
অবশেষে অভ্রকে রাজি হতেই হলো বই গুলো পোড়ার জন্য ।
অবন্তীর এক ধরনের ধারনা ছিল যারা অতিরিক্ত সাইকলজিক্যাল বই পড়ে তারা হয় ডক্টর না হয় সাইকো । মানে কিছুটা হলেও সাইকো । অভ্রর এমনিতেই ছোট থেকেই সাইকোলজিকাল ডিজঅর্ডার ছিল হয়ত এখনো আছে কিছুটা হলেও। কারণ ডক্টর বলেছিল এই ধরনের পেশেন্ট এর থেকে শতভাগ সুস্থতা আশা করা বৃথা। কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু গ্যাপ থেকেই যায় । এরই মধ্যে অভ্রর আবার এসব বইয়ের প্রতি নেশা তাও লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যাপারটা অবন্তীর একদম ই সুবিধার ঠেকে নি। তাই ওকে দিয়েই পুড়িয়ে নিয়েছে সব বই। প্রতিজ্ঞা ও করিয়ে নিয়েছে ভবিষ্যতে যেন আর এগুলো না পড়ে । কারন অবন্তী জানে অভ্র এসব প্রতিজ্ঞা বা কথা রাখার ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস। ।
.
.
গার্ডেনের এক কোনে ওগুলো পোড়া শেষ করে বাড়িতে নিজের রুমে আসার পথে অবন্তী কে কোলে তুলে নেয়।।
.
.
— আমি আপনাকে কত ভালবাসি জানেন ?
— হুম জানি তো
— কিন্তু এটা কি জানেন? আপনি ইচ্ছে করে যদি আবার অসুস্থ হোন আমি কিন্তু আর আপনাকে ভালোবাসব না । চলে যাব আমি ।
— আমি যেতে দেবই না । শোন না,আমার না খুব কবিতা কবিতা পাচ্ছে বলি একটা কবিতা?
— বলুন না
.
—
মেয়েটা পাখি হতে চাইল
আমি বুকের বাঁদিকে আকাশ পেতে দিলাম।
দু-চার দিন ইচ্ছে মতো ওড়াওড়ি করে বলল
তার একটা গাছ চাই।
মাটিতে পা পুঁতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
এ ডাল সে ডাল ঘুরে ঘুরে
সে আমাকে শোনালো অরণ্য বিষাদ।
তারপর টানতে টানতে
একটা পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে নিয়ে এসে বলল
তারও এমন একটা পাহাড় ছিল।
সেও কখনো পাহাড়ের জন্য নদী হোতো।
আমি ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে বললাম
নদী আর নারীর বয়ে যাওয়ায় কোনও পাপ থাকে না।
সে কিছু ফুটে থাকা ফুলের দিকে দেখিয়ে
জানতে চাইল
কি নাম?
বললাম গোলাপ।
দুটি তরুণ তরুণীকে দেখিয়ে বলল
কি নাম?
বললাম প্রেম।
তারপর একটা ছাউনির দিকে দেখিয়ে
জিজ্ঞেস করলো,
কি নাম?
বললাম ঘর।
এবার সে আমাকে বলল
তুমি সকাল হতে জানো?
আমি বুকের বাঁদিকে তাকে সূর্য দেখালাম।
.
.
— এগুলো আমাদেরই কথা তাই না?
— হুম । কবি রুদ্র গোস্বামী মনে হয় তোমার আর আমার জন্যই এটা লিখেছিলেন ।
.
.
.
দেখতে দেখতে তিনশ'তেষট্টি টি দিন কেটে যায় । তিনশ ' চৌষট্টি তম দিন চলছে পাশাপাশি এই পথ চলার। আগামিকাল তাদের পরিণয়ের এক বছর পূর্তি ।
.
.
কাল ম্যারেজ এনিভার্সারির পার্টি আছে বাড়িতে। গত দুদিন ধরে ডেকোরেটর রা কাজ করছে। বাড়িটা একদম বিয়ের বাড়ির মতো করে সাজানো হচ্ছে আবার । অন্যান্য আত্নীয় স্বজনরাও আসতে শুরু করে দিয়েছে ।
অর্পি আর ওর ফ্যামিলি এসেছে গত ছয় দিন হলো ।
এতদিন শুধু ফোন , ভিডিও কলে তার সাথে কথা হয়েছে অবন্তীর। কিন্তু এই প্রথম সামনাসামনি দেখা । খুবই মিশুক সে। পুরো বাড়ি নিজেই মাতিয়ে রেখেছে ।
.
.
বাড়িটাকে বিয়ে বাড়ির মতো করে আবার সাজাতে দেখে অবন্তীর মনে পড়তে থাকে আবার সে পুরনো দিন গুলোর কথা । এরকমই সাজানো ছিল বাড়িটা । কিন্তু তাদের দুজনের কারোর ই মন দুটো সাজানো ছিল না ।
বিয়ের রাতে বেলকনিতে সারারাত বাধা অবস্থায় থাকার কথাও মনে পড়ে । তারপর কতই না ঝগড়া। অভ্রকে ভয় পাওয়া। এসব মনে পড়ে অবন্তী নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে দেয়।
এক বছরে বদলে গেছে অনেক কিছু । বদলেছে তাদের সম্পর্ক । হয়ত সে সম্পর্কের সেতুবন্ধন ও আসতে চলেছে । অবন্তী নিজের ভেতর অন্য কারো অস্তিত্বের আচ পেতে শুরু করেছে কিছুটা গত ক'দিন ধরে। প্রায় সব ধরনের লক্ষণ জানান দিচ্ছে তাকে সে ব্যাপারেই।
আজ সন্ধ্যায় রিপোর্ট পাবার কথা । এসব ব্যাপারে এখনো কাউকে জানায় নি সে। অভ্রনীল কেও না।নিজেই ডক্টর এর কাছে গিয়েছে চুপিচুপি শপিং এর কথা বলে। আজও তাই বের হয়েছে ।
.
এই অস্তিত্বের জানান সে সবার আগে অস্তিত্বের মালিককেই দিতে চায়।
.
রিপোর্টে পজেটিভ দেখার সাথে সাথেই অবন্তী অভ্রকে ফোন করে । এ কথা সে কথায় আর বলেই উঠতে পারে না ব্যাপারটা । সিদ্ধান্ত নেয় কাল ই বলবে।
.
পরিণয় পূর্তির দিন ই পূর্ণতা প্রাপ্তির প্রথম জানান দেবে সে তার প্রিয় পরিপূরক কে। ।
.
.
শপিং মলে গিয়ে অযথা কিছু কিনে নিল বাড়ি গিয়ে বোঝাতে তো হবে যে সে শপিং এ গিয়েছিল। তাছাড়াও বেবি শপে গিয়ে বেবি সু কিনে ছোট্ট একটা বক্সে র্যাপিং করে নিল। আর জুয়েলারি শপে গিয়ে তিনটে আংটি কিনল ।
একটা অভ্রর সাইজের, একটা অবন্তীর নিজের সাইজের আর বিশেষটা জিরো বয়সের বেবির সাইজের ।
দুজনের দুটো আংটির মাঝে রাখল ছোট টি । এক বক্সে সাজিয়ে সেটাও র্যাপিং করে নিল। রাতে পার্টি শেষে রুমে আসার পর পাওনা গিফট এগুলো অভ্রনীলের।
.
.
" আচ্ছা বুদ্ধু টা কি এসব দেখে কিছু বুঝবে? নাকি আমাকে নিজে মুখে বলতে হবে? শোনার পর ? নিশ্চয় খুশিতে পাগলামো শুরু করবে। কোলে তো আমাকে নেবেই মাস্ট। আমি বলব এখন থেকে আস্তে কোলে নেয়ার অভ্যেস করো পুরক সাহেব । পুচকে কস্ট পাবে । "
.
.
গাড়িতে বসে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ির গেটের সামনে চলে এসেছে বুঝতেই পারে নি অবন্তী । হঠাত ড্রাইভারের অন্য কারো সাথে কথা কাটাকাটিতে ভ্রম ভাঙে অবন্তীর।
বেশ বয়স্কা এক মহিলার সাথে কথা কাটাকাটি করছে সে গাড়ি থামিয়ে ।
.
— বললাম তো গাড়িতে স্যার নেই । ম্যাডাম আছে শুধু ।
— আমার যে একটু দরকার ছিল বাবা। অনেক দূর থেকে এসেছি ।
.
.
— জ্বি কি হয়েছে বলুন? কি দরকার?
— এই বাড়ির সাহেব কোথায়?
— ও তো অফিসে। বাবা ও আজ অফিসে। আমি মিসেস আহনাফ চৌধুরী আমাকে বলুন না কি দরকার?
— না উনাদের সাথেই দরকার।
— তাহলে অফিসে যান ।
— না সমস্যা নেই আমি এখানেই অপেক্ষা করব ।
.
.
অবন্তী কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভারকে বাড়ির ভেতরে গাড়ি ঢোকাতে বলে। কি দরকার যখন বলতেই চাইছে না, থাক । সিড়িতে উঠতে উঠতে অবন্তী কি যেন মনে হয়ে আবার নিচে নেমে চলে যায় মেইন দরজায়। বয়স্ক মহিলাটির কাছে প্রায় দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
.
— শুনুন আমি মনে হয় আপনাকে চিনি ।
.
বয়স্কা মহিলার মুখে হাসি ফোটে এবার ।
— হ্যা আমিও তোমাকে চিনি।
.
.
.
চলবে...........................