পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ২৬ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


বয়স্কা মহিলার মুখে হাসি ফোটে এবার ।
— হ্যা আমিও তোমাকে চিনি।
.
— আপনি...?
—হ্যা ঠিক ই ধরেছ ।
— এখানে কি কাজ আপনার?
—আমি বাপু গরিব মানুষ । এইসব বড়লোকেদের ভুলের মাশুল কুড়িয়ে নিই ।
— মানে? বুঝলাম না ঠিক ।
— এরা জীবনের দাম টাকায় কেনা বেচা করে । কেন তুমি জানো না এসব? তুমিও তো এখন এদেরই একজন ।
— কি সব আবল তাবল বলছেন আপনি কার জীবনের দাম ? কে কেনা বেচা করেছে?
.
.
মহিলা এবার মুচকি হাসে । 
— তোমাকেও তো কেনা বেচা ই করেছে । 
— আপনি জানলে কি করে?
— আমি সব জানি । 
— কি জানেন আপনি?
— শুনবে? 
.
অবন্তী ডান হাতটা নিজের অজান্তেই পেটের ওপর রেখে একবার সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বলে,
.
— হ্যা আমি শুনতে চাই।
.
পুরোটা শোনার পর অবন্তীর মনে হতে থাকে তার মাথার ওপর নেই কোন আকাশ আর পায়ের নিচেও মাটি নামের কোন অস্তিত্ব নেই । চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে । এসব না শুনলেই বুঝি ভালো ছিল।   
অবন্তী ভদ্র মহিলার সাথে আর কোন কথা বাড়ায় না । কথা বলার মতো ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে । 
.
চোখ মুছতে মুছতে হন হন করে হেটে নিজের রুমে ঢুকতেই অর্নির সাথে ধাক্কা খায় সে। 
— কি ব্যাপার অবন্তী শপিং থেকে এরকম কাদতে কাদতে ফিরছ যে? পছন্দের জিনিস পাও নি বুঝি?
  .
অবন্তী কোন উত্তরই আর আজ দেয় না । যে অভ্রনীলের জন্য এত দিন অর্নির সাথে এত ঝগড়া করেছে সেই কি না ! আজ আর কি ঝগড়া করবে? কি উত্তর দেবে তার কথার? বরং অর্নিই তাকে সাবধান করেছিল অভ্র কে এতটা বিশ্বাস না করতে ।
.
 রুমে এসে দরজা লাগিয়ে হাতের কাছে যা পায় ইচ্ছে মতো ভাঙতে থাকে সে। ভাঙার শব্দ শুনে রেণু খালা, অর্পি এগিয়ে আসে । ওরা বারবার দরজা ধাক্কায় কি হয়েছে জানতে চায়। অবন্তীর সে দিকে কোন খেয়াল ই নেই। ভাঙতে ভাঙতে ড্রেসিং টেবিল এ রাখা ফুলদানি টা নিতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে চোখ পড়ে অবন্তীর । নিজের চেহারা একদৃষ্টে দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে চোখ চলে যায় পেটের দিকে । আর পারে না থেমে যায় সে । মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে । এই সন্তান জন্মালে কি উত্তর দেবে তাকে? তার বাবা খুনি?
.
.
অভ্র বাড়ি ফিরে দেখতে পায় তার রুমের সামনে বড় ধরনের জটলা পেকে গেছে । কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারে অবন্তীর এসব কাণ্ডের কথা । অভ্র নিজেও কয়েকবার ডেকে সারা না পেয়ে দরজা ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে ছিটকিনি ভেঙে ঢুকে রুমের নাজেহাল অব্স্থা দেখতে পায়। অবন্তী চুপচাপ মেঝে তে বসে আছে বিছানার এক কোনে হেলান দিয়ে । 
 মেঝেতে অভ্রনীলের ছায়া দেখতে পায় অবন্তী। চোখ মুছে নিয়ে মানুষটাকে আবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নেয়। 
অভ্র ওর পাশে বসে গালে লেগে থাকা একটু আধটু চোখের পানি মুছে দেয় বিস্ময়ের সাথে । 
.
 .
— কি ব্যাপার ? কি হয়েছে? এনিথিং সিরিয়াস? 
— নাহ ।
— তাহলে?
— এমনি ভালো লাগছে না আমার কিছু ।
— হঠাত ?
— কেন আমার কি ভালো না লাগার ও অধিকার নেই নাকি ? আর নাকি এসব ভেঙে অনেক ক্ষতি করে দিয়েছি আপনাদের?
— এভাবে কথা বলছ কেন তুমি আমার সাথে? ভালো না লাগার অধিকার যেমন তোমার আছে সেরকম ই ভালো না লাগার কারণ জানার ও অধিকার আমার আছে ।
— সে হিসেব করলে আমার ও অনেক অধিকার ছিল । 
— কোন অধিকারটা আমি তোমাকে দিই নি বলো?
.
.
অবন্তী আর কোন কথা বলে না । আবার চেয়ে রয়। সব চেয়ে বড় অধিকার, সব কিছু জানার অধিকারটাই আজ পর্যন্ত তাকে দেয়া হয় নি। 
.
.
— কি হলো বলবে তো কিছু?
— কিছু না । গত পরশু সবার মৃত্যুবার্ষিকী ছিল তো তাই মনটা ভালো লাগছিল না । সবাই থাকলে আগামীকাল কতই না পূর্ণ হতো দিনটা । 
.
.
এসব শুনে অভ্রর মাঝে আবার অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে । নিজেরও মনটা খারাপ হয়ে যায় । সত্যি তো এত বড় একটা ঘটনার মাত্র চার দিন পরে বিয়েটা হয়েছিল। মানুষের সুখের স্মৃতির চেয়ে দুঃখের স্মৃতি গুলই মনে পড়ে বেশি। অবন্তির ও হয়ত তাই হচ্ছে । অভ্র মাথা নিচু করে নেয়। অবন্তীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চুপচাপ গভীর ভাবে শ্বাস নিতে থাকে । অবন্তী প্রায় অনেক্ষণ ছোট বাচ্চাদের মতো করে কাদে অভ্রনীলের বুকে । হয়ত এই কাদাই শেষ কাদা ! 
.
.
প্রায় অনেক্ষন পর অবন্তী কান্না থামিয়ে চোখ মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানার এক কোনে গুটিগুটি মেরে। শরীর যে আর চলছে না । ক্লান্ত লাগে ভীষণ । 
.
.
অভ্র নিজেও দমে গেছে কিছুটা অবন্তীর এমন অবস্থা দেখে। কিন্তু সে আন্দাজ ও করতে পারে না অবন্তী সব জেনে গেছে আর তার জন্যই এমন আচরণ। 
অভ্র নিজেই মেঝেতে পড়ে থাকা ভাঙচুর করা জিনিসপত্র, কাচের টুকরো গুলো সরাতে থাকে । হুট করে হাতে বিধে যায় এক টুকরো কাচের কণা । 
.
" উফ্ফ " 
.
" কি হলো? "
.
বলতে বলতেই উঠে বসে অভ্রনীলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে হাত কেটেছে বেচারা । নিজেই খুটে খুটে কাচ বের করার চেষ্টা করছে । বের তো হচ্ছেই না বরং কাটা জায়গা আরো গভীর ক্ষত হয়ে যাচ্ছে । অবন্তী নিজেজ উঠে গেল।
.
" যেটা পারেন না সেটা করার চেষ্টা করেন কেন? একটু দেরি হলেও আমি তো পরিস্কার করতাম ই রুমটা নাকি? একটু দেরী ও দেখি সয় না আপনার । আর এত গোছালো হওয়ার ভঙ আর ধরতে হবে না । "
.
.
অবন্তী ফার্স্ট এইড বক্স থেকে এন্টিসেপটিক, তুলা, ব্যান্ডেজ নিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতেদিতে বলল,
 .
— দেখলেন তো প্রকৃতি ফিরে আসতে পছন্দ করে । আমরা যতই চাই অপছ্ন্দের জিনিস গুলো ফিরে না আসুক কিন্তু প্রকৃতি যেন ততই তা আমাদের ফিরিয়ে দিতে চায়। 
.
— মানে? কি বলতে চাইছ তুমি? কি ফিরে এসেছে?অবন্তী কি হয়েছে তোমার সত্যি করে বলো তো আমায়। 
.
অবন্তী মুচকি হেসে বলে,
— ওরে বাপরে আমার সামান্য কথায় এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন যে? এত সিরিয়াস হবার কিছু নেই। 
— তাহলে কিসের ফিরে আসার কথা বললে তুমি?
— কেন সত্যি সত্যি কিছু ফিরে আসার কথা ছিল বুঝি?
— অবন্তী কি হয়েছে বলো তো তোমার?
— আমার এসব কথায় আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন? কি হয়েছে বলুন তো আপনার?
.
.
অবন্তী আবার হাসতে শুরু করে। কিন্তু অভ্রর একদম হাসি পাচ্ছে না । কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে । ব্যান্ডেজ করা শেষহলেই অভ্র উঠে পড়ে । ওয়াশরুমে যাবে , চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেবে । কিন্তু অবন্তী হাত টেনে ধরে আবার পাশে বসতে ইশারা করে ।
.
.
—পালাচ্ছেন?
— না তো । 
— প্রকৃতি কি ফিরিয়ে দেবার কথা বলছি জানতে চাইলেন না?
— অবন্তী আমার মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। বমি ও পাচ্ছে প্লিজ যেতে দাও আমায় । তুমি তো জানোই মাথা ব্যাথা করলে আমার বমি পায়।
— বাহ বাহ। দেখেছেন কি ফিরে আসার কথা বলছি? আমাদের বিয়ের দিনে আপনার হাত কাটা ছিল,হাতে ব্যান্ডেজ ছিল কত দিন আগের হতে পারে বলুন তো? তিন চার দিন আগের? হয়ত ....ব্যান্ডেজ দেখে তাই মনে হচ্ছিল। দেখুন না আজ ও আবার ব্যান্ডেজ করতে হলো হাতে। আবার আপনার মাথা ব্যাথা ও নাকি করছে? বিয়ের দিনেও আপনার মাথায় কিন্তু আমি আঘাতের চিহ্ন দেখেছিলাম । কিন্তু হাতের ব্যান্ডেজ এর কথা জিজ্ঞেস করায় আপনি রেগে গেছিলেন তাই মাথার চোটের কথা আর জিজ্ঞেস করতে পারি নি । আর পরে তো আমার মুখ ও বেধে রেখেছিলেন যেন বেশি প্রশ্ন করতে না পারি। আপনি সম্ভবত ঐ জন্য রুমের লাইটস অফ রেখে আমার সাথে কথা বলতে চাইছিলেন তাই না যেন জখম দেখতে না পারি ? জখম হয়েছিল মানে ব্যাথা ও হচ্ছিল আবার আজ ও মাথা ব্যাথা হচ্ছে ।বমি কিন্তু আমাকে বিয়ের দিনও আপনি করেছিলেন আবার আজও? আমাদের বাড়িতে সবাই হাসাহাসি করছিল এই নিয়ে, বর বিয়ে করতে এসে বমি করছে ।দেখেছেন কত কিছু আবার প্রকৃতি ফিরিয়ে দিল? 
.
.
অবন্তী আবার হাসে কথাগুলো বলে। অভ্রর এসব পুরনো কথা মনে পড়ে আরো বেশি অস্বস্তি হয় । মানসিক চাপ সে একদমই সহ্য করতে পারে না ছোট বেলায় মায়ের ঘটনাটার পর থেকে । অতিরিক্ত চাপ নিলে, দুশ্চিন্তা করলে বমি করে ফেলে । অবন্তীর কোন কথার উত্তর দেয় না সে। অবন্তী হেসেই যাচ্ছে। 
.
ওয়াশ রুমের বেসিনে দৌড়ে গিয়ে আবার গড় গড়িয়ে বমি করতে শুরু করে অভ্রনীল। হাত পা ও কেমন থর থর করে কাপতে শুরু করে ।  
.
" সত্যি কি প্রকৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছে সব কিছু? কি হচ্ছে এসব? সত্যি তো এক বছর পর আবার কেন মিলে যাচ্ছে ছোট ছোট ব্যাপার গুলো । প্রকৃতি যদি সত্য টাও ফিরিয়ে দেয়? অবন্তী যদি জেনে যায় সব কিছু কোন ভাবে? "
.
.
অভ্র মাথায় এবার আবার যুক্ত হয় এসব দুশ্চিন্তা। বমি করতে করতে গলা ছিলে এক পর্যায়ে ব্লাড ও আসে বমির সাথে ।
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন