চিঠি পড়ার পর মুচকি হেসে কবিতাটা শেষ করে অভ্রনীল। কি আশ্চর্য,অবন্তী চলে গেছে, অবন্তী সব জেনে গেছে! কিন্তু তবুও তার এতটুকু ও ভয় লাগছে না কেন আজ? অভ্র নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে । নিজেকে আজ তার বড্ড বেশি স্বাধীন মনে হচ্ছে । এতদিন কেমন যেন পরাধীন মনে হতো নিজেকে। মিথ্যের জালে আটকে থেকে ডানা ঝাপটানো এক পরাধীন পাখির মতো মনে হতো নিজেকে।
.
সত্যে যে কত সুখ তা আজ উপলব্ধি করতে পারছে অভ্রনীল। মিথ্যে বড় বোঝার ন্যায়,কচ্ছপের ওপর যেমন পাথরের বোঝা কচ্ছপকে ঠিক মতো চলতে বাধাগ্রস্থ করে ঠিক তেমন মিথ্যের বোঝা ও জীবনের চলতি পথে বাধা সৃষ্টি করে ।
.
.
অভ্র বুঝতে পারে আর এক মুহুর্ত ও দেরী নয়। অনেক দেরি হয়ে গেছে অনেক বেশিই দেরি হয়ে গেছে । সে সব সময়ই চাইত সত্যিটা নিজে থেকে বলতে। অভ্রনীল কখনই এই মিথ্যের সংসার চায় নি। কিন্তু বার বার ভেতরের সত্ত্বা যে তাকে বাধা দিয়েছে সব কিছু বলতে। সে যে নিজের ভেতর লালন করেছিল অন্য এক সত্ত্বা। অন্য এক দ্বিতীয় সত্ত্বা।
"আচ্ছা অবন্তী কতটুকু জানে? আর যেটুকুই জানুক, কেই বা তাকে জানালো এসব?নাহ এখন এসব ভাবার আর সময় নয়। তাকে যেতে হবে, অবন্তীর কাছে যেতে হবে । হাতের মুঠোয় সব সত্যি নিয়ে যেতে হবে । আর নয় কোন চাপা সত্য। এবার উন্মুক্ত করতেই হবে শুভ অশুভ সব সত্য।"
.
.
অভ্রনীল আলমারি খুলে ডায়েরিটা বের করে নেয়। সেই সাদা গোলাপ, সেই শুকনো সাদা বকুল গুলো। আর বিশ্রী রঙের ছিটে ! অভ্র হাত বুলিয়ে নেয় সব কিছুর ওপর । এক চিলতে হাসি হাসতে হাসতেই চোখ বেয়ে পানি পড়ে । মনে মনে আর একবার বলে," কি বলে সম্বোধন করব জানিনা
তবে মাফ করে দিও প্রিয়, তোমার জন্যই সব পাওয়া। তোমার জন্যই হয়ত নিজেকে চেনা, নিজের ভেতর তোমার আদল গড়া, নিজেকে ভেঙে চুড়ে এক নতুন আমি গড়া ।"
.
সাগর পাড়ে অবন্তী এলোচুলে একা বসে আছে অনেক্ষণ।পায়ে সাগরের নোনা জল বার বার ঢেউ খেলে যাচ্ছে। সাগরের জলের সাথে ভেসে আসছে ছোট ছোট ঝিনুক, শামুকের খোসা। আশেপাশে কিছু কাকড়া হেটে বেড়াচ্ছে। দমকা বাতাস এসে বার বার ওর চুলগুলো নিয়ে যেন খেলা করছে। যেভাবে খেলা করত শুভ্র!
আকাশে সাদা শুভ্র মেঘমালা উড়ে চলেছে। কিছুদূরে যেন তা সাগরের সাথে মিলে গেছে। দূর সাগরে ভেসে আসা জাহাজগুলোর দিকে চেয়ে রয় অবন্তী। চোখে তার নোনা জল। কার জন্য নোনা জল? তা সে জানে না।
.
.
"সাগর আছে , জাহাজ আছে
নেই যে শুধু নাবিক
বাকা পথে হেটে হেটে
ক্লান্ত এখন পথিক"
.
আচমকা চেনা কন্ঠস্বর শুনে পেছনে তাকায় অবন্তী।অভ্র এসেছে। চোখভরা জল তার। হাতে একটা ডায়েরি। অবন্তীর কাছে এগিয়ে এসে ডায়েরিটা তার হাতে তুলে দেয় অভ্র। অবন্তীর চোখে এই মূহুর্তে অভ্রর জন্য ঘৃণা , রাগের সংমিশ্রনে এক অন্যরকম ভালবাসা ফুটে উঠছে। হ্যা , ভালোবাসার মানুষের প্রতি ঘৃণা আর রাগ জন্মালে সৃষ্টি হয় এক অন্যরকম ভালোবাসা।অবন্তী ডায়েরিটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে সাগর পাড়ের ভেজা বালিতে । অভ্রর শার্টের কলার টেনে ধরে তার বুকে মাথা গুজে কাদতে শুরু করে ।
অভ্র আজ আর কেন যেন সাহস পাচ্ছে না অবন্তীর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবার। পাথরের মতো ঠায় হয়ে দাড়িয়ে থাকে সে। অতীতগুলো আবার মনে করে । তিক্ত অতীত।
.
বেশ অনেক্ষন পর স্মিত স্বরে বলে,
" অবন্তী আমি আজ সবটা বলতে চাই।"
.
অবন্তী মাথা তুলে অভ্রর চোখে চোখ রেখে তাকায়।
" সত্য বলার সাহস আছে আপনার?"
"হু।"
" নাকি আবার কোন মিথ্যে বানিয়ে এনেছেন?"
" সব সত্যির প্রমাণ তো আমি তুলেই দিলাম তোমার হাতে।"
" কি প্রমাণ?"
" ডায়েরি।"
" আর কোন সত্যি?"
" সব চেয়ে বড় সত্যি।"
" ডায়েরিটা কার?"
"খুলে দেখো ।"
.
অবন্তী ডায়েরিটা আবার কুড়িয়ে নেয়। ডায়েরি খুলে সে মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকে প্রথম পাতা।
.
" মেয়েটার চোখে আমি সর্বনাশ দেখেছিলাম কোন এক চৈত্র মাসে। চৈত্রের রোদ্দুরময় দুপুরে সে আমার শুকনো খটখটে মনে এক প্রশান্তির শুভ্রতা এনে দিয়েছিল মেয়েটা। মেয়েটির নাম অবন্তী। হ্যা সে ই আমার সর্বনাশ । "
.
এর পরের লাইনগুলো আর পড়তে পারে না অবন্তী। চোখ বেয়ে তার নোনা জল গড়িয়ে পড়ে । অভ্রকে জিজ্ঞেস করে,
" কেন করলেন এমনটা? কি ক্ষতি করেছিল শুভ্র আপনার?"
.
" আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি বিশ্বাস করো ।"
.
" দিনের পর দিন এই নাটকটাও আপনি ইচ্ছে করে করেন নি তাই বলতে চান আপনি?"
.
" আমি বলছি তো সবটা"
.
" এতটা নিচে নামতে পারলেন আপনি অভ্র? আমি কোন অভ্রনীল কে চিনতাম? আর আপনি কোন অভ্রনীল?"
.
" আমি শুভ্রনীল আর অভ্রনীলের মিশ্রণে এক নতুন কোন সত্ত্বা। সংকর এক সত্ত্বা ।"
.
" আমার চাই না এমন মিশ্র সত্ত্বা। আমার শুধু একটা সত্ত্বা চাই । শুদ্ধ অভ্রনীল চাই। শুদ্ধ সত্ত্বা।"
.
.
.
চলবে..........................