মুনা সোহেলকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।সোহেল অপ্রস্তুতভাবে দাঁড়িয়ে আছে।ভিনা দৌড়ে এসে এসব দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো।
-সোহেল...সোহেল জানো আমি প্রেগন্যান্ট!
ভিনা কথাটা শুনে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো।যেন চোখের সামনে ওর মাকে দেখছে এভাবে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে দিতে।কিন্তু বাস্তবে ফিরতেই একি দৃশ্য পুরো শরীরে ঘৃণা ধরিয়ে দিলো।সাথে সাথে নিজের রুমে যেয়ে দরজা আটকিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে,কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।
•
-প্রেগন্যান্ট?কীভাবে জানলে?
-বাসায় টেস্ট করেছি,এইযে দেখো রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে!কী স্পষ্ট দাগ!আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না!
-তোমার চাচি তো বলেছিলো তুমি কখনো মা হতে পারবে না...
-উনি সবসময় বাড়িয়ে বলত!সমস্যা আমার ছিলো,কিন্তু মিরাকেল যে হতে পারে না,এমন তো না।
-আচ্ছা...
-তুমি কি খুশি হওনি?
-হয়েছি...
সোহেল কিছু বলতে পারছে না,ভোতা অনুভূতি নিয়ে বসে আছে।শিউলিও একদিন এভাবে এসে বলেছিলো,মা হওয়ার কথা।আসলে একদিন না...দুইদিন।মারা যাওয়ার সময় শিউলি তিন মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো।আশায় ছিলো এবার ছেলে হলে মার সাথে সব সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।দ্বিতীয়বারের প্রেগ্ন্যান্সিতে বেশ চুপচাপই ছিলো।যদিও কিছুটা কম্পলিকেশন্স ছিলো,তাও ওগুলো গায়ে লাগায়নি,কিছুদিন যাওয়ার পর সবাইকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো দুইজন।এর আগেই...
-সোহেল?তুমি কি এই বাচ্চা চাচ্ছো না?
-কেন চাবো না?
-তোমাকে এমন বিমর্ষ কেন লাগছে?তুমি কি এ্যবোরশন চাও?
সোহেল চুপ থেকে বললো-
-কখনোই না।
-সত্যি!
-এভাবে কেন বলছো মুনা?
-আমার ভয় হয়,অনুগ্রহ করে আমার সাথে সংসার করছো,সেই সংসারে যদি এই বাচ্চার জায়গা না হয়?
-এই বাচ্চা মানে?এটা আমার বাচ্চা না?নিজের বাচ্চাকে কেউ মারতে পারে?
মুনা সোহেলকে জড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো-
-মা কে ফোন করে জানাই,না জানি কত খুশি হবে!
-আগে ডাক্তারের কাছে যেয়ে নেই?এখনি তাড়াহুড়া করা ঠিক না।
-আমি একবার না,দুইবার টেস্ট করেছি সোহেল। আর মুরুব্বিরা জানলে ক্ষতি কী?যদি কোনো সমস্যা থেকেও থাকে,তাদের দোয়ায় সেগুলো ঠিক হয়ে যাবে।
-ঠিক আছে।জানাও তোমার মা কে।
-না...আগে তোমার মাকে জানাবো।এরপর যদি মনে হয়,তাহলে আমার মাকে জানাবো,কিন্তু পরে।
-যেটা ভালো মনে করো।
মুনা দেরী না করে সাথে সাথে রেহানাকে ফোন দিলো।খবর শুনে রেহানা প্রথমেই আজমির খালার গুনগান গাইলো।এরপর কথা বলা শেষে জমিরা বিবিকে ফোন ধরিয়ে দিলো।
-আআসসালামু আলাইকুম আম্মা।
-ওয়ালাইকুম সালাম।তা কী কইবা কও,রেহানা এ্যত খুশি লাগতাছে ক্যান?
-আম্মা,আমি মা হবো।
-মা হইবা?টিউবের বাচ্চা নিছো নাকি?
-না আম্মা।
-নিজেগো বাচ্চা?
-জ্বি আম্মা।
-আলহামদুলিল্লাহ! বড়ই খুশি দিলা আমারে।নাতি য্যানো হয় এইবার!
-দোয়া করবেন আম্মা,আরেকটা অনুরোধ, যদি আপনি এই সময়টাতে আমার পাশে থাকতেন,খুব ভালো হতো।
-ক্যান?তোমার আম্মা নাই?
-আছে,কিন্তু আপনি থাকলে ভরসা পাবো।রেহানা ফুপুকেও নিয়ে আসেন সাথে করে।
-কী জ্বালাতন!আইচ্ছা দেখি।আমি আসমা রে ঘর বুঝায়ে পরের সপ্তাহে আসবানে।সোহেল রে কইয়ো গাড়ি পাঠায়া দিতে।
মুনা একসাথে পুরো পরিবার কে নিজের করে নিতে চাচ্ছে।একবার যদি পোক্ত জায়গা করে নেয়া যায়,সংসার থেকে বিতাড়িত হওয়ার যে ভয় থাকবে না।
•
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পুরো বাসার পরিবেশ বদলে গেলো।জমিরা বিবি রেহানা সহ পুরো এক বাড়ি জিনিসপত্র নিয়ে এ বাসায় এসেছে।এরি মাঝে মুনা অভিমান দূর করে নিজের মাকেও সুখবর জানিয়ে দিলো।বলা বাহুল্য, এতদিন খোঁজ না নিলেও নাতি হওয়ার খবর শুনে এখন মা সম্বোধন না করে কথা বলে না।যদিও মুনার মা থাকে না জমিরা বিবির মত,কিন্তু সেটাকে ঠিক না থাকাও বলা যায় না।সকালে এসে বেশ রাত করে তিনি বাসায় যান।সোহেল নানা ব্যস্ততার মাঝেও ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বারবার বলেছে,মুনা বারবারই বলেছে নিজের পরিচিত ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলে নিয়েছে,কিছুদিন পরই যাবে।আসলে বাসা ভর্তি মানুষ রেখে হুট করে যাওয়াও যাচ্ছে না।এর মাঝে সোহেল ব্যবসার কাজে ইমার্জেন্সি তে থাইল্যান্ড গেছে প্রায় সপ্তাহ দুয়েকের জন্য।সোহেল ছাড়া মুনা ডাক্তারের কাছে কোনোভাবেই যাবে না।এতকিছুর মাঝে ভিনা যেন হারিয়েই গেছে।জমিরা বিবি এসে ভিনার সাথে কোনো কথাই বলেন নি।আর মুনার মা লতিফা কেন যেন ভিনাকে দেখতে পারেন না।হাজার হোক,ভিনা তার মেয়ের সৎ মেয়ে।মুনার প্রেগন্যান্সির খবরের পর থেকে সোহেল চাইলেও আর ভিনার মুখোমুখি হতে পারছে না,নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার।এসব কিছু যেন না হয়,এর জন্যই তো বাচ্চা হবে না জেনে মুনাকে বিয়ে করেছিলো,কিন্তু সৃষ্টিকর্তার মর্জি কেউই বুঝতে পারে না।সব শেষে ভিনা যে ভয় পেয়েছিলো সেটাই সত্যি হলো।সোহেল শেষে কিছু না পেরে মোমেনা কে বলেছিলো ভিনার খেয়াল রাখতে।কিন্তু মুনা বলেছে আগামী মাস থেকে মোমেনা কে রাখবে না,সে নাকি ঠিকমত কাজ করে না।সোহেল যদিও রাজি হয়েছে মুনার কথায়,কিন্তু সত্যিকার অর্থে চাচ্ছে না যে মোমেনা চলে যাক।
ভিনা নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে যায় না।নিজেকে অন্যের বাড়ির অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি মনে হয়। যাবিরের শূন্যতা এই একাকীত্বকে আরো যন্ত্রণাদায়ক করে ফেলেছে।এভাবে কোনোভাবেই থাকা সম্ভব না।নিজের জীবন নিয়েই অনিশ্চয়তা কাজ করছে,এই বাসায় ঠাই হবেও নাকি,বুঝতে পারছে না।আশে পাশে সবাই কোচিং এ মডেল টেস্টের জন্য ভর্তি হয়ে গেছে।আর ভিনা বাসা থেকেই বের হতে পারছে না।সামনেই কলেজে রেজিস্ট্রেশন কার্ড দেয়ার জন্য ডাকবে।সেইদিন হয়তবা কিছু করা সম্ভব।জীবনে আর কী কী দেখতে হবে সেটাই ভাবে ভিনা। পড়ার টেবিলে আগের চেয়ে বেশি সময় কাটানোর চেষ্টা করছে।যেভাবেই হোক নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাচ্ছে,কিন্তু বাসার পরিবেশে কোনোভাবেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না।আগে যাবিরের সাথে দিনের পর দিন কথা না বলে থাকত,এখন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে যখন বাধ্য করা হয়েছে যোগাযোগ বন্ধ রাখতে,তখন এই বিষয়টা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।সারাদিন ছটফট লাগতে থাকে। না জানি যাবির কত অপেক্ষা নিয়ে বসে আছে একটা মেসেজের জন্য।ভিনা সুযোগ খুঁজছে যাবিরের সাথে কথা বলার জন্য।একটা ছোট ফোন থাকলে আর সমস্যাই হত না,কিন্তু সিমের কথা মাথায় আসতেই নিরাশ হয়ে গেলো ভিনা।কেউ এমন পরিচিত নেই যে সিমের ব্যবস্থা করে দিবে। বাধ্য হয়ে মোমেনা খালার মোবাইল চেয়েছিলো ভিনা।
-খালা,তোমার মোবাইল দুই মিনিটের জন্য নেই?
-মোবাইলে তো ট্যাকা নাই।
-আচ্ছা ঠিক আছে।তোমাকে আজকে আমি পঞ্চাশ টাকা দিবো নে,তুমি কালকে ভরে এনো টাকা।
-তোমার মোবাইল ভাইঙ্গা ফেলাইসে,তাই না?
-হুম।
-মুনাই করসে না এই কাম?
-না,বাবা ভেঙ্গেছে রাগ করে
-মুনাই ভাইঙ্গাইসে।কত বড় হারামজাদি তুমি তো জানো না।
-থাক খালা।তোমাকে যা বললাম,তাই করো।
-সেটা করা যাইবো,কিন্তু এমনে কয়দিন চলবো? মোবাইল তো সবারই লাগে আজকাল।কিন্যা নিতে পারো না তুমি?
-সিম থাকলে কিনতাম। নাই আমার কাছে।
-সিম?ঐযে যে ছোট প্লাস্টিকের টুকরার মতন?
-হ্যাঁ
-ঐরকম একটা তো পাইসিলাম যখন রুমে ভাঙ্গা মোবাইল পরিষ্কার করতে গেসিলাম।
-কোথায়?!সেটা লাগবে আমার!
-আমি বাইর কইরা দিতাসি দাঁড়াও
ভিনার চোখে পানি এসে পড়লো।সিমটা পেয়ে গেলে মোবাইল কেনা খুব একটা কঠিন হবে না।মাঝখানে টিউশনি করিয়ে যে টাকা জমেছিলো,সেটা দিয়ে অনায়াসে ছোট মোবাইল যাবে যেটা দিয়ে অন্তত কথা বলা সম্ভব।এর বেশি দরকার ও নেই ভিনার।মোমেনা খালা এসে ভিনার হাতে সিম দিয়ে গেলো।ভিনা খুশিতে জড়িয়ে ধরলো মোমেনা কে।
-খালা প্লিজ তুমি চলে যেয়ো না।কথা দাও তুমি থাকবা।
-আমারে রাখলে তো আমি থাকমু,নাইলে তো কী আর করার কও।
-তুমি থাকবা!
ভিনা কথাটা বলেই চলে আসলো নিজের রুমে।সযত্নে ছোট একটা কৌটায় উঠিয়ে রাখলো সিম।এরপর নিজের ড্রয়ারে রাখা বক্স থেকে টিউশনের টাকা বের করে সেখান থেকে এক হাজার টাকা উঠিয়ে রাখলো।সামনে যেদিনই সুযোগ পাবে মোবাইল কিনে ফেলবে।
.
.
.
চলবে................................................