যদিও সোহেল বলেছিলো বড়জোর দুই সপ্তাহ লাগবে থাইল্যান্ডে,কিন্তু বিভিন্ন ঝামেলার কারণে আরো দেরি হলো আসতে।এসেই মনে হলো কোনো অচেনা বাসায় এসে পড়েছে।রেহানা,জমিরা বিবি,মুনার মা,দোলা সবাই বাসায়।বোনের প্রেগন্যান্সির কথা শুনেও তারেক আসেনি।মুনা অনেকবার ডেকেছিলো,তবুও।সোহেলই শুধু জানে তারেক কেন আসছে না।সোহেলকে ঘরে ঢোকা মাত্র মুনা ঠোঁট ফুলিয়ে বলতে লাগলো
-আসার ইচ্ছে হলো অবশেষে! তুমি কি ভুলে গেছো তুমি যে বাবা হচ্ছো সামনে?আমার কথা না ভাবো,বাচ্চার কথা তো ভাববে!
-ডাক্তারের কাছে যাও নি?
-তোমাকে ছাড়া কীভাবে যাবো?
-কেন?রেহানা বা তোমার মা কে নিয়ে যেতে?
-ওরা কী ভালো বুঝবে নাকি,আরো সিন ক্রিয়েট করবে।
-দোলা?
-দোলার বিয়ে হয়ে গেছে,এত সময় নেই ওর।
-তাহলে ভিনাকেই নিয়ে যেতে।ও তো এডুকেটেড ইয়াং একটা মেয়ে।
সাথে সাথে মুনা তেতিয়ে উঠলো।আগে নিজেকে সামলিয়ে রাখতো,এখন যেন গলার আওয়াজে অন্যরকম আধিপত্য আর রুক্ষতা প্রকাশ পায়।
-পাগল হয়ে গেছো সোহেল?ভিনাকে সাথে কী মরার জন্য নিবো আমি?
-মানে?
-বাচ্চার হওয়ার খবর শোনার পর থেকে কেমন যে করছে!মনে হয় ওৎ পেতে থাকে কিছু করার জন্য।
-তোমার মনের ভুল মুনা,প্রেগন্যান্সিতে অনেক সময় এমন হয়।
-এভাবে এড়িয়ে গেলেই সত্যিটা বদলাবে না।তুমি নিজেও জানো ভিনা আমাকে পছন্দ করে না,করবেও না।এই কয়দিন তো ছিলে না,দেখো নি যে কী করেছে।
-এখন বলো,কী হয়েছে?
-সারাদিন ঘর থেকে বের হবে না।সেদিন খাওয়ার জন্য ডাকতে গেছি এই শরীর নিয়ে,মুখের উপর বাজে ব্যবহার করলো।
-তুমি যেয়ো না ওর সামনে তাহলে।
-না গেলে তো আবার আমারই কথা শুনতে হবে যে মেয়েকে ঠিকমত খাবার দাও না, খেয়াল করো না।
-কে বলবে?বলার কে আছে?সবাই তো তোমার মতই..
-আমার মত মানে?
-মানে হলো...কিছু না...
-এখনো অন্ধই হয়ে আছো সোহেল। মেয়েটা তোমার কারণেই ভুগবে দেখো।
-বাদ দাও এসব।ডাক্তারের কাছে কবে যাবে?
-আমি ডাক্তার সোমার সিরিয়াল নিয়েছি। উনার সিরিয়াল পাওয়াই যায় না।উনি নাকি কী কনফারেন্সে বাইরে গেছে।সামনে সপ্তাহে আসবে। কিন্তু সিরিয়াল পেয়েছি আরো পরের।
-তোমার না পরিচিত এক ডাক্তার ছিলো?তাকে দেখাও,দেরি করছো কেন তুমি?
-আমি বেস্ট ডাক্তারই দেখাবো সোহেল।এক্ষেত্রে আপোষ করতে পারবো না আমি।
-যেটা ভালো মনে করো....
সোহেল জোড়াজুড়ি করলো না।নিজের বাচ্চা হলেও সেই টান কাজ করছে না। শিউলি আজকে এই জায়গায় থাকলে দৃশ্য পুরো অন্যরকম হতো।সোহেল দেশের বাইরেও যেত না,ডাক্তারের কাছে যেভাবেই হোক,নিয়ে যেত।থাইল্যান্ডে কাজ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।তবুও দেশে আসতে ইচ্ছা করেনি,কিছুদিন এমনিই রয়ে গিয়েছিলো।পুরো বাসার পরিবেশ এক কথায় বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।
•
ভিনা বক্স থেকে ছোট একটা কিপ্যাড মোবাইল বের করলো।সেটাকে চার্জের পয়েন্টে লাগিয়ে পাশে বসে ছিলো ফুল চার্জ হওয়ার আগ পর্যন্ত।হওয়া মাত্রই সিম ঢুকিয়ে যাবিরের নাম্বার ডায়াল করলো।এক বার,দুই বার,তিন বার....তৃতীয়বার রিং হওয়া মাত্রই যাবিরের গলা শুনতে পেলো।
-ভিনা!হ্যালো?ভিনা?কথা বলো!হ্যালো!?
-যাবির.....
-ভিনা!তুমি সত্যিই আমাকে ফোন দিয়েছো?কী হয়েছিলো তোমার?এক মাস হয়ে গেছে তোমার কোনো খোঁজ নেই।আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।
-আমিও..
-ভালো নেই তাই না?কী হয়েছে?
-অনেক কিছু!
ভিনা পুরো ঘটনা খুলে বললো।যাবির চুপ করে সব শুনলো।ভিনার কথা শেষ হওয়ার পরই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-
-আমি ভাবতে পারছি না মানুষ এত খারাপ কীভাবে হয়?কীভাবে সহ্য করছো?
-আমি জানি না...আমি আসলে কিছু জানি না।সহ্য হচ্ছে না কিছু।অনেক কষ্টে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বের হয়েছিলাম ভর দুপুরে।একদম ছোট একটা মোবাইল কিনেছি,যেন সহজে কারো চোখে না পরে।
-এভাবে কতদিন?
-যদি জানতাম...
-আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখো?ভালোমত পড়াশোনা করো এই কয়দিন।খুব ভালোমত।এরপর এ্যডমিশন টেস্ট দিয়ে পাবলিকে ভর্তি হয়ে যাও।খরচ অনেক কম পাবলিকে।টিউশনি করে চালিয়ে নিতে পারবে।আর মাত্র একটা বছর।এই একটা বছর পার হলেই দেখবা লাইফ একদম চেঞ্জ হয়ে যাবে।জানি এক বছর কম সময় না।তবুও আমি বলবো এই কষ্টটা তুমি করো।দিনে দুইবার আমার সাথে কথা বলো,সারাদিন পড়াশোনা করো।আশেপাশে কী হচ্ছে দেখার দরকারই নেই।বলো,তুমি কথা রাখবা?
-রাখবো...
-বেশিক্ষণ কথা বলা সেফ হবে না।রাতে আবার ফোন দিও।
-যাবির...
-বলো ভিনা
-আমি তোমাকে ভালোবাসি...
-ভালোবেসে যেও।
ভিনার খুব হালকা লাগছে।কেউ যেন বুকের উপর থেকে বোঝা সড়িয়ে দিয়েছে।মোবাইল ড্রয়ারের এক কোণায় রেখে ভিনা পড়তে বসে গেলো।প্রায় দেড় ঘন্টার মত রুটিন বানালো কীভাবে কোন সাব্জেক্ট পড়বে,এরপর বই খাতায় ডুবে গেলো।যাবিরের প্রতিটা কথা মাথায় গেথে আছে।এই এক বছর....এরপর সব ঠিক হয়ে যাবে।ভালো সময়ের আগে খারাপ সময় আসবেই,এটাই নিয়ম।
•
জমিরা বিবি আর মুনার মা লতিফার বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে।কেউ কাউকে ছাড়া খেতে বসে না,টিভি দেখে না। মুনার মা ই এই সম্পর্কের উদ্যোক্তা। লতিফা ভালোমত জানেন জমিরা বিবি ভিনাকে পছন্দ করেন না।এই বিষয়ের সুযোগ তিনি আসার পর থেকেই নিচ্ছেন।মুনাকে ছোট থেকেই তিনি অবহেলায় বড় করেছেন,বিয়ের পর আশা ছিলো বড়লোকের বউ হয়ে সংসারে কিছু কন্ট্রিবিউট করবে,নানা কারণে করতে পারেনি। এরপর যখন নিজের স্বামী মারা গেলো,তখন এই মেয়ের খোঁজ রাখার তিনি প্রয়োজন মনে করেননি।এখন বাচ্চা হওয়ার কথা শুনে উনি জান পরাণেই খুশি। কারণ বাচ্চার অজুহাতে হলেও সোহেলের থেকে টাকা নিতে পারবে মুনা।এর জন্যই মেয়ের যত্নআত্তিতে কোনো কমতি রাখছেন না।কিন্তু তার সমস্যা ভিনাকে নিয়ে। মনে হচ্ছে এই মেয়ে বাড়িতে থাকলে মুনার আধিপত্য কিছুটা হলেও কমে যাবে।
লতিফা পান নিয়ে জমিরা বিবির বসলেন-
-আচ্ছা আপা,একটা কথা কন তো,ভিনা এমন ক্যান?
-ক্যান?কী হইসে?
-যেমনে চুপচাপ থাকে,আমার তো ভয় হয়।কারণ এরা শয়তান বেশি হয়।
-হইবোই তো।ওর মায়ে আমার পোলাডার মাথা খাইসিলো।শয়তান না হইলে কোনো মাইয়া একটা পোলারে নিজের মায়ের কথা ভুলায় দেবার পারে?
-আমার তো ভয় করে,যদি মুনার কোনো ক্ষতি কইরা ফেলে?
-ক্ষতি?
-হ রে আপা।বিয়ার পর অনেক জ্বালাইছে এই মেয়ে।মুনার শরীর দেইখা তো লাগে পোলা হইবো,যদি কিছু কইরা ফেলায়?হিংসা অনেক খারাপ জিনিস।
-আমারো তাই মনে হইতাসে।অনেক চাইসি আল্লাহর কাসে,যেন সোহেলের পোলা হয়।মুনা যখন পোয়াতি হইসেই,আল্লাহ আমার মনের আশা পূরণ করবো মনে হয়।
-ভিনারে কোথাও পাঠায়া দেন। ভালা হইবো।অন্তত বাচ্চাটা হওয়ার আগ পর্যন্ত মাইয়াডা দূরে থাকুক।কিছু হয়া গেলে আর কি ঠিক করা যাইবো?
-আমি দ্যাখবো নে।সোহেল তো মাইয়া কইতেই অজ্ঞান।সরাসরি তো কিসু কওন ও যাইবো না।
-তাইলে?
-মুনারে কও।পোয়াতি বউয়ের কথা জামাই ফেলতে পারে না।
.
.
.
চলবে...............................................