পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ২৯ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


" আমি শুভ্রনীল আর অভ্রনীলের মিশ্রণে এক নতুন কোন সত্ত্বা। সংকর এক সত্ত্বা ।"
.
অবন্তী অভ্রনীলের শার্টের কলার আবার টেনে ধরতে গিয়ে বড় বড় নখের আচর কাটে গলায় আর ঘাড়ে। "আমার চাই না এমন মিশ্র সত্ত্বা। আমার শুধু একটা সত্ত্বা চাই । শুদ্ধ অভ্রনীল চাই। শুদ্ধ সত্ত্বা।"
.
অভ্রনীল কলার থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়। নিজের দুহাতের ভেতর অবন্তীর হাতদুটো নিয়ে নেয়। যেভাবে ঝিনুক তার ভেতর মুক্তো আগলে রাখে।অতপর তার চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করে,
" আমি তো তোমার জন্যই...নিজেকে ভেঙেছি চুরেছি । নিজের মধ্যে শুভ্রনীলের সত্ত্বার লালন করেছি।"
.
" তাই বলে একটা মৃত মানুষকে নিয়ে এতটা? এতটা নিচে না নামলেও পারতেন আপনি অভ্রনীল।কেন মেরে ফেললেন শুভ্রকে? ও একমাত্র সাক্ষী ছিল বলে? নিজের দোষ ঢাকতে অন্য একজন কে মেরে ফেলতে একটুও দ্বিধা কাজ করল না আপনার?"

" অবন্তী কি বলছ তুমি এসব? "

"আপনার জন্যই এক্সিডেন্ট টা হয় নি? তারপর হসপিটালে আপনি শুভ্রর অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেন নি? মেরে ফেলেন নি ওকে?"

" কি সব আবল তাবল বকছ তুমি? আমি কেন মেরে ফেলব শুভ্রকে? হ্যা মানছি এক্সিডেন্ট টা আমার জন্যই হয়েছিল কিন্তু আমি ইচ্ছে করে কাউকে মেরে ফেলিনি। আর তোমাকে কে এসব আবল তাবল বলেছে শুনি? অর্নি?"

" অর্নি আপু বললে আমি অবশ্যই বিশ্বাস করতাম না । কিন্তু আমি এমন একজনের কাছ থেকে শুনেছি যার মিথ্যে বলার কোন প্রশ্নই আসে না ।"

" কে সে?"

" বেলী ফুফু"

" বেলী ফুফু আবার কে?"

"বাহ মাসে মাসে যাকে ক্ষতিপুরণ হিসেবে টাকা পাঠান তার নামটাও জানেন না দেখছি। আপনারা বড়লোকরা সত্যি পারেন ও বাবাহ!"

" অবন্তী কথা ঘুরিও না ঠিক করে বলো । "

"কথা ঘোরানো তো আমি আপনার থেকে শিখেছি অভ্রনীল। যাই হোক বেলী ফুফু হচ্ছে শুভ্রর ফুফু। "

" কিহ? উনাকে তুমি কোত্থেকে পেলে?"

" চমকে উঠলেন তো?"

" মিথ্যে বলেছে উনি তোমাকে। ."

" হ্যা বেলী ফুফুই আমাকে সবটা বলেছে। আর সত্যিটা বলেছে। আমি বেলী ফুফুকে মাত্র একবার দেখেছিলাম তাই চিনতে একটু দেরি হয়েছিল । আমাদের বিয়ের পাকা কথা ঠিক করার দিন দেখেছিলাম। শুভ্র যে ফুফুর বাড়িতে বেশির ভাগ সময় থেকে মানুষ হয়েছে সেই বেলী ফুফু। " 

" অবন্তী আমি বলছি তো আমি আজ সবটা বলব তোমায়। আমার কথাগুলো শুনবে তুমি আজ। "

" কি আর বলবেন? আবার একগাদা মিথ্যে?"

" না সত্য । "

" আমার আর শুনতে ইচ্ছে করে না আপনার ওসব বানানো সত্য।"

অভ্র অবন্তীর পেটে হাত রেখে বলে, 
" আমার অস্তিত্ব ছুয়ে অন্তত আমি মিথ্যে বলব না । এটুকু তো বিশ্বাস করো । আমি বড্ড ভালোবাসি ওকে। "
অবন্তী চমকে ওঠে।
" আপনি কি করে জানলেন ওর কথা?"

" তোমার কি মনে হয় আমি এতটাই খারাপ বাবা? আমার অস্তিত্বের কথা তুমি আমার থেকে লুকোতে চাইবে আর আমি জানতে পারব না?"

" মানে?"

" সেদিন রাতে তোমার অদ্ভুদ আচরণ দেখে আমি খোজ নিয়েছি তুমি কোথায় গিয়েছিলে , পরে জানতে পারি ডক্টরের কাছে গিয়েছিলে। তারপর সেই ডক্টরের কাছ থেকে আমি সবটা জেনে নিয়েছি। শুধু বেলী ফুফুর এই ব্যাপারটা জানা হয় নি। কিন্তু আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম তুমি কখন আমাকে নিজ মুখে আমাদের অস্তিত্বের কথা বলবে। "

" অভ্রনীল আপনি কি করে পারেন এত সূক্ষ্ম অভিনয়?"

অভ্র মাথা নিচু করে বলে, " জানিনা। সময় আর পরিস্থিতি আমাকে এসব শিখিয়েছে।এবার তো বলতে দাও আমায় সবটা। এবার তো বিশ্বাস করো আমায়। সবটা বলার একটা সুযোগ দাও। আমি বলছি তো বেলী ফুফু মিথ্যে বলেছে ।আমি খুন করিনি শুভ্রকে!"

" সবাই শুধু মিথ্যেই বলে আপনার নামে তাই না? "

" জানিনা।"

" আমি যে শুভ্রকে সেদিন পার্টিতে দেখেছিলাম সে কে ছিল?"

"পুরোটা বলি ?"

" হুম।"

" আমি ছোটবেলা থেকেই অর্পি আপুর কাছে থাকতাম।কেন আপুর কাছে ছিলাম সেসব তো তুমি জানোই। তো ওখানে আমাকে একদমই শাসন করার মতো কেউ ছিল না । আপু ভাইয়া সারাদিন ব্যাস্ত থাকত। আমি সারাদিন যা ইচ্ছে তাই করতাম। দিন দিন বন্ধু বান্ধব বাড়তে থাকল। ভালো বন্ধুর চেয়ে খারাপ বন্ধুদের সংখ্যাই দিন দিন বাড়তে লাগল। আমি অনেক ছোট বয়স থেকে ক্লাব পার্টি জুয়া ড্রাগস এসবের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। অর্পি আপুর কাছে ধরা ও পড়েছিলাম । কিন্তু বার বারই আপুর কাছে মাফ চাইতাম বলতাম আর এমন করব না । বাড়িতে বাবাকে এসব জানাতে নিষেধ করতাম, বাবা জানলে আমাকে দেশে নিয়ে আসত আরো শাসন করত সেই ভয়ে। আপু আমাকে খুব ভালবাসে তাই বাবাকে আর ওসব বিষয়ে বলত না আর আমাকে বোঝাতো ভালো হয়ে যাবার জন্য । আমি সেসব এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতাম। যাই হোক, এভাবেই দিন চলতে থাকে। তারপর আমার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলো । বাবা জোর করল দেশে ফেরার জন্য । আমার বিন্দু পরিমান ইচ্ছে ছিল না দেশে ফেরার । দেশে ফিরলেই মার কথা মনে পড়ে ।তবুও বাবা জোর করল,সেই সাথে অর্পি আপুও বোঝালো আমার বাবার কাছে থাকা উচিত। বাবা দেশে একা। আপুরা চাইলেই তো আর থাকতে পারে না । অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও আমি ফিরলাম । ফেরার পর আমার কিছুই ভালো লাগত না । মার কথা মনে পড়ত শুধু। তাই ক্লাবেই বেশির ভাগ সময় কাটাতাম । আর আমার যে বন্ধু বান্ধব জোগাড় করতে খুব বেশি সময় লাগে না তা অন্তত বুঝেছো এত দিনে। ক্লাবে আমার প্রচুর বন্ধু বান্ধব হয়ে গেল। টাকা ওড়ালে বন্ধুর অভাব হয় না ওসব জায়গায়। সেদিন রাতে আমি জুয়ায় বেশ মোটা অঙ্কের টাকা জিতি। তাই সেসব সেলিব্রেশন করতে প্রচুর ড্রিঙ্ক করে ফেলি আমরা। আর সাথে ড্রাগস ও নিই। ড্রাগস নেয়ার অভ্যেস ও আমার আগে থেকেই ছিল। কিন্তু অতো হাই ডোজের না । কিন্তু সেদিন ডোজটা একটু বেশিই ছিল। আমি আসলে বুঝেই উঠতে পারি নি। ওরা ডোজ দিয়েছিল আমি শুধু পুশ করেছি। তারপর আমার আর নিজের ওপর কোন কন্ট্রল ছিল না । আমি কি করেছি না করেছি নিজেও জানি না । চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছিলাম রীতিমতো আমি। ওভাবেই ড্রাইভ করে বাড়ি ফেরার সময় আমার প্রচন্ড বমি পায়। আমি রাস্তায় এক পাশে গাড়ি সাইড করে বমি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়ি । তারপর হঠাতই কেউ এগিয়ে আসে আমার ঐ অবস্থা দেখে। সে আর কেউ নয় শুভ্র। ও আমাকে পানি মেডিসিন দিয়ে হেল্প করে । তারপর আমি একটু ঠিক হই। কথায় কথায় জানতে পারি ওর নাম শুভ্রনীল সাখাওয়াত । ও নেভিতে আছে। কি যেন মিশনের কথা ছিল, কিন্তু মিশন ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ার জন্য বাড়ি ফিরছিল ক'দিনের জন্য । আমার এ অবস্থা দেখে ও আমকে একা ছাড়তে চায় না । আমি বারবার বলি আমি একাই যেতে পারব। ও তবুও জোর করে আমাকে বাড়ি পৌছে দেবার জন্য । শুভ্র ড্রাইভ করতে চাইলে আমার প্রচন্ড রাগ হয়। আমি বরাবরউ ড্রাইভ করতে ভালোবাতাম। আমার গাড়ি আমি ড্রাইভ করব । এরকম একটা জেদ চাপে আমার ভেতর। আসলে অতিরিক্ত ড্রাগস আর হার্ড ড্রিঙ্কস এর জন্য আমার মাথা একদমই কাজ করছিল না । ঠিক বেঠিক কোন জ্ঞানই ছিল না আমার। আমি জোর করেই ঐ অবস্থায় ড্রাইভ করছিলাম।আর শুভ্র আমার পাশে বসে ইন্সট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছিল।এতেও আমার মেজাজ প্রচন্ড গরম হয়ে যায় । মনে হচ্ছিল ও কে আমাকে ইন্সট্রাকশন দেবার? আমি ইচ্ছে মতো স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করি । ও বার বার স্পিড কমাতে বলে।আমি আসলে নেশার ঘোরে বুঝতেই পারছিলাম না শুভ্র আমার ভালোর জন্যই এসব বলছে।"

অবন্তী দীর্ঘশাস ফেলে বলে," শুভ্রর বরাবরই স্বভাব ছিল মানুষকে যেচে যেচে সাহায্য করা । "

অভ্র আবার বলতে শুরু করে,
" হ্যা সে সাহায্যই ওর জীবনে কাল হয়ে এসেছিল। আমি নেশার ঘোরে রাস্তার মোড় ঘুরতে লেফট সিগনাল দিতে রাইট সিগনাল দিয়ে ফেলি। শুভ্র আমাকে সে বিষয়েও ধমক দিয়ে বলতে থাকে।কথায় কথায় কথা কাটাকাটি শুরু হয় আমাদের। এরই মধ্যে সামনে খেয়াল না করায় ঘটে যায় এক্সিডেন্ট । হ্যা তোমাদের গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট । এসব দেখে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই । কি করব, কি করা উচিত কিছুই ভেবে পাই না আমি। এদিকে আমিও মাথায় হাতে আঘাত পাই প্রচন্ড। আমি নিজেও সেন্সলেস হয়ে পড়ি । সেন্স ফেরার পর জানতে পারি তোমার ফ্যামিলির সবাই অলরেডি ডেড। শুভ্রও প্রচন্ড অসুস্থ ,আইসিইউ তে। শুভ্র অনেক বেশি ইনজুরড হয়। ইন্টার্নাল ব্রেইন ইঞ্জুরি। ব্রেইন এ প্রচন্ড আঘাত পায়। ব্রেইনে রক্তক্ষরণ হয়ে জমাট বাধে। ততক্ষনে পুলিশ চলে আসে হসপিটালে আমাকে এরেস্ট করার জন্য । আমার ব্লাড টেস্ট ও হয়ে গেছে ততক্ষণে। ব্লাডে এলকোহল আর ড্রাগস লেভেল অনেক হাই পাওয়া যায় । আমার গাড়িতেও নাকি ড্রাগস পাওয়া যায় । আমি জানি না গাড়িতে কি করে ড্রাগস এলো । আমি বুঝতে পারি আমি খুব বাজে ভাবে ফেসে গেছি। বাড়িতে তখনো কেউ কিছুই জানে না । আমি পুলিশকে বললাম আমি আজমির চৌধুরীর ছেলে। আমি একবার বাবার সাথে কথা বলব। উনারা আমাকে যাচ্ছে তাই গালিগালাজ করল। বাড়িতেও ফোন করতে দিলেন না । থানায় এনে রাখলেন । পরের দিন কোর্টে চালান করবে। একবার কোর্টে চালান করলে সব শেষ! এক্সিডেন্টাল মার্ডার, ড্রাগস পাচার সমস্ত কেসে ফাসিয়ে দেবে ওরা । তাই আমি প্রায় সারারাত বলার পর ভোরের দিকে এক কন্সটেবল এর দয়া হয় আমার ওপর । উনি লুকিয়ে আমায় ফোন করতে দেন বাড়িতে। বাড়ি না ফেরার জন্য বাড়িতেও ততক্ষণে আমাকে নিয়ে সবাই টেনশন করতে শুরু করেছে । পরে বাবা এসে সমস্ত কিছু ম্যানেজ করে নেয় কোনভাবে। "

" কোনভাবে মানে ঘুষ দিয়ে তাইতো?"

অভ্র মাথা নিচু করে বলে," হ্যা। তোমার মেজ চাচা পলিটিক্যাল লিডার । সমস্যাটা উনার জন্যই হয়েছিল বেশি। উনিই পুলিশকে বলেছিল এই এক্সিডেন্টাল কেসের পাশাপাশি আরো দু একটা কেসে ফাসিয়ে দিতে। আমি যেন বাড়িতে যোগাযোগ করতে না পারি সেদিকেও খেয়াল রাখতে। চার্জশিট এমনভাবে ফাইল করতে বলেছিলেন যাতে করে আমার যাবজ্জীবন অথবা ফাসি হয়। ব্যাবসায়িক কারণেও তোমার ঐ চাচার সাথে আমাদের কিছুটা দ্বন্দ ছিল। তাই তিনি হঠাত আমার এই ভুলের সুযোগ পেয়ে তা উসুল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছু কিছু পুলিশের চরিত্র তো তুমি জানোই। আমার বাবা এসে বেশ মোটা অঙ্কের ঘুষ অফার করলেন। আর তাছাড়া ওপজিট পার্টির লিডার আমাদের ফেভারে ছিল। কোর্টে চালান করার আগেই আমাকে ছেড়ে দেয়া হয় , তোমার চাচারাও কেস তুলে নিতে রাজি হয় দুটো শর্তের বিনিময়ে।তারা বার বার ক্ষতিপূরণের কথা উল্লেখ করছিলেন। বাবা বলল তারা যা ক্ষতিপূরণ চায় তাই দেয়া হবে । উনারা তোমার ভবিষ্যতের কারণ দেখিয়ে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা চাইলেন । বাবা তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাতেই রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু আপত্তি বাধল তাদের দ্বিতীয় শর্ত নিয়ে । তোমার চাচার মেয়ে অবনীকে আমায় বিয়ে করতে হবে এমন একটা শর্ত দিয়ে ফেললেন তোমার চাচা । বাবা বললেন আমার ছেলের জন্য যাকে নিজের পরিবার হারাতে হয়েছে দায়িত্ব নিতে হলে আমার ছেলে তার দায়িত্বই নেবে। এসব কথাবার্তার জন্যই আমি আর বাবা তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম এক্সিডেন্টের পরের দিন।সেদিনই তোমাকে প্রথম দেখি আমি। যাই হোক তখন উনারা বললেন তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে অন্য কারো সাথে । আর আমাকে অবনীকেই বিয়ে করতে হবে ।আমি এসবে শুধু মাত্র কাঠের পুতুল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কোন ইচ্ছে ছিল না অবনী বা তোমাকে বিয়ে করার। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমাকে রাজি হতে হয়েছিল ।"
.

" তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেন? শুভ্রকেই বা মেরে ফেললেন কেন?"
.

" আমি শুভ্রকে মেরে ফেলি নি। ঐ এক্সিডেন্ট এ আমিও মারা যেতে পারতাম। সবাই মারা গেল আর বেচে রইলাম শুধু আমি। সত্যিই কৈ মাছের প্রাণ আমার।"
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন