অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করে,
" জানিনা। আমি শুধু মাত্র তোমাকে নিজের কাছে রাখার জন্য কি করেছি না করেছি তা আমি নিজেও জানি না। আর তাছাড়া আমি যে অন্য একটা গন্ডগোল ও পাকিয়ে বসেছিলাম।"
.
" আবার কি গন্ডগোল? আপনি কি গন্ডগোল পাকানো ছাড়া আর কিছুই পারেন না? তা কি গন্ডগোল শুনি? "
.
" ঐ যে কথা দিয়ে ফেলেছিলাম!"
.
" একটা কথা রাখার জন্য আপনি এত বাকা পথ নিলেন?"
.
" আমি কথা রাখতে পছন্দ করি ।আমি সব সময় সবাইকে দেয়া কথা রাখতে চেষ্টা করি ।আর সেখানে তোমাকে দেয়া কথা আমি কি করে ফেরাই বলো? সেদিন কিচেনে তোমাকে দেখে এত ভয় পেয়ে গেছিলাম যে আমি কি বলতে কি সব বলে ফেলেছি ,কি সব কথা দিয়ে ফেলেছি নিজেও জানি না । কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম তুমি আমার সে কথার ওপর ভিত্তি করে দিন গুনে চলেছ শুভ্রর জন্য । শুভ্রকেও অর্থ্যৎ আমাকে ফোনে বলেছিলে যে আমি তোমাকে মুক্তি দিতে চেয়েছি। আর তারপর তুমি শুভ্রর কাছেই ফিরতে চাও। কিন্তু আমি কি করে আমার দেয়া কথা রাখতাম বলো? আমি কত্থেকে এনে দিতাম তোমার শুভ্রকে? শুভ্র তো ততদিনে সাড়ে তিন হাত মাটিতে তোমার ভাইয়ের কবরের পাশে। তবে আমিও মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম আমি কথা রাখবই। আমি বলেছিলাম শুভ্রর বাধনে বাধা পড়বে তুমি। হ্যা আমি কথা রেখেছি। আমি শুভ্র হয়েই তোমাকে নিজের বাধনে বেধে নিয়েছি।"
.
অবন্তী এসব শুনে আর কোন কথা বলে না । টুপটাপ জল গড়ে দুচোখের কোণ দিয়ে। শেষে এসে যে মানুষটা কে ভুল বুঝেছিল সে মানুষটা তো ভুল বোঝার অনেক আগেই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে । আর এই মানুষটা কি কিই না করেছে একটা কথা রাখতে গিয়ে ।
.
অভ্রনীল থামে না সে বলতেই থাকে,
" আমি স্টোর রুমে একদিন ওরই ব্যাগপত্র খুজছিলাম। ব্যাগে কি কি আছে দেখার জন্য । পাঞ্জাবিটা আছে নাকি তা দেখার জন্য । ডায়েরিতে আমি পাঞ্জাবির কিহিনী ও পড়েছি। কিন্তু তুমি হঠাৎ পেছন থেকে এসে আমাকে ফলো করলে । তাই আমিও আর ওটা না খুজে অযথা অন্য কিছু খোজার ভান করলাম। তোমাকে দেয়া কথা কি করে রাখব আমি? সারাদিন এই একটা কথাই বার বার চিন্তা করতাম। এরই মধ্যে সেদিন আবার তুমি কান্নাকাটি শুরু করে দিলে আজ ভাইয়ার জন্মদিন,ভাইয়াকে এনে দিন। আমি কিছু উপায় খুজে না পেয়ে তাদের কবর দেখাতে নিয়ে গেলাম তোমায়। সেদিন তোমাকে তিনটে কবর দেখিয়েছিলাম । কিন্তু তার পাশের চতুর্থ কবরটা আর দেখাই নি। চতুর্থ কবরটা শুভ্রর ই ছিল। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর আমার ভেতর আবার নতুন করে অপরাধবোধ জাগতে শুরু করে। যা আমি এতদিন তোমার সান্নিধ্য পেয়ে প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। এই অপরাধবোধে আমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করি । তারপর তো জানোই আমি কতটা অসুস্থ হয়ে পড়ি । এসাইলেমে কতদিন থাকি। তারপর রেহানা আপু আমাকে আবার বোঝায় ,অনেক ভালো ভাবে বোঝায়, নতুন করে আবার সব কিছু শুরু করতে বলে। আমাকে শুধরে যাবার জন্য বোঝায়। আমি তাই করি । শুধরে যাবার চেষ্টা করি, নতুন করে আবার সব কিছু শুরু করতে চাই। কিন্তু ঐ শুভ্রর ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে নামে না কিছুতেই। কেমন কাটার মতো বিধে বারবার। তুমি আগে বার বার বলতে তুমি শুভ্রর আমানত। আমি যখনই একটু করে আবার তোমাকে আপন ভাবতাম তখনই মনে পড়ত অন্যের আমানত তুমি। আর আমি এটাও ঠিকমতো বুঝতাম না তুমি তখনো নিজেকে শুভ্রর আমানত ভাবো নাকি আমার সম্পদ । তাই আমি সেবার শেষ খেলাটা খেলতে শুরু করি । মনে মনে ঠিক করি এবার হয় এসপার নয় ওস্পার। এভাবে তোমার এই দোটানা মন , আর আমার এই দ্বিসত্তা আমার আর ভালো লাগছিল না । ভাবলাম শেষ খেলা খেলেই শেষ করব সব কিছু । "
.
" মিমিক্রি করতে পারেন বলে কন্ঠ নকল করেছিলেন। কিন্তু হাতের লেখা? আমাকে পাঠানো সেই কবিতা লেখা চিরকুট? শুভ্রর হাতের লেখা ছিল ওটা।"
.
" বলছি তো । আমিই প্রতিদিন ছোট ছোট গিফট পাঠাতাম বেনামে। ভেবেছিলাম তুমি বুঝতে পারবে শুভ্র এসব পাঠাচ্ছে ।কিন্তু না তুমি ভেবে বসলে আমিই পাঠাচ্ছি।"
.
" আপনি তো তাই ভেবে নেবেন। আপনি কি আর জানতেন যে ততদিনে আমার মনে শুভ্রর অস্তিত্ব ছিলই না? ততদিনে আমার ভেতর শুধু অভ্রনামক এক সত্ত্বা অস্তিত্ব গড়ে তুলেছিল। "
.
" হ্যা সেটাই তো পরখ করে দেখে নিতে চেয়েছিলাম । যেন নিজেদের মধ্যে আর কোন দ্বিধা না থাকে। "
.
" বাহ! আপনার ধ্যান ধারণা আর পারফরমেন্স দুটোই প্রশংসার যোগ্য। হাত তালি দিই? "
.
" তারপর আমি শুভ্রর ডায়েরি দেখিয়ে হ্যান্ডরাইটিং স্পেশালিস্ট কে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিই একদম শুভ্রর হাতের লেখার মতো করে । তারপর বাড়ি ফিরে নিজেই ইচ্ছে করে ওসব রাগারাগির নাটক করি । আর তুমি তো সরাসরি ডিভোর্স এর কথা বলে দাও।"
.
" ডিভোর্স এর কথা যে আমি জেদ করে বলেছিলাম তা বুঝতে পারেন নি বুঝি?"
.
" হ্যা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। তাই তো ডিভোর্স পেপার সহজেই ছুড়ে মারতে পেরেছিলাম।কারণ আমি মনে মনে বেশ নিশ্চিত ছিলাম তুমি ওটাতে সিগনেচার করবে না । এত এত সাইকোলজিক্যাল বই তো আর এমনি পড়তাম না ।সব কিছু বোঝার জন্য আর বুঝে বুঝে পরের স্টেপ নেবার জন্যই পড়তাম। আর ডিভোর্স পেপার আমি এমনিতেই অনেক আগে মানে এসবের অনেক আগে বিয়ের সময় রেডি করে রেখেছিলাম কারণ বিয়ের সময় আমার কাছে তুমি একটা বোঝা বৈ কিছু ছিলে না । ভেবেছিলাম কোন ভাবে বাবাকে ম্যানেজ করে অর্পি আপুর কাছে ফিরে গিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবো । কিন্তু তারপর তো মাত্র তিনদিনের মাথায় ঐ ডায়েরি পড়ে আমার সব কিছু ওলট পালট হয়ে যায় । আমি ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ি তুমি নামক শুদ্ধ নেশায়। আর সেদিন ঝগড়ার পর সেই আগের রেডি করা ডিভোর্স পেপার খুব সহজে ছুড়ে মেরেছিলাম কারণ তোমার ওপরে এটুকু বিশ্বাস ছিল তুমি সিগ্নেচার করবে না । কিন্তু বিশ্বাস করো আমি কখনো ভাবি নি তুমি চলে যাবার মতো স্টেপ নেবে। কারণ আমিতো শুভ্র সেজে ফোনে নেগেটিভ রোল প্লে করতাম। শুভ্র সেজে আমি অভ্রর নামে আজেবাজে কথা বলতাম । যেন এসব শুনে তুমি অভ্রকে না শুভ্রকেই খারাপ ভাবো আর আমাকে অসহায় ভেবে নাও। আর ওকে ভুলে গিয়ে আমার সাথেই স্টে করো । কিন্তু তুমি তো অনেক দূর এগোলে। আমাকেই ছেড়ে শুভ্রর কাছে চলে যেতে চাইলে। "
" হ্যা সেটা আমি আপনার ওপর জেদ করে চলে যেতে চাইতাম। প্রথমে আপনার ওমন কথা শুনে জেদের বশে বললাম ডিভোর্স চাই। আর আপনিও সাথে সাথে ডিভোর্স পেপার বের করে দিলেন। তা দেখে আমার ভেতর আরো বেশি জেদ চেপে যায় । আমি মনে মনে ঠিকই চাইতাম আপনি আমাকে আটকান। কিন্তু না আপনি একদম চুপ হয়ে গেলেন। "
.
"হ্যা আমি বুঝতে পেরে গেছিলাম আমি আসলে বেশি ওভার রিয়াক্ট করে ফেলেছি । কিন্তু আমারও এটা ভেবে রাগ হতো তুমি কেন শুভ্রর কাছেই চলে যেতে চাইছ। আমার এতদিনের এত পরিশ্রম কি কোন কাজেই দেবে না? আমিও মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম এই লুকোচুরি খেলা আর নয়। এবার যা হবার হবে। তাই আমি মানে শুভ্র তোমাকে শুভ্রর কোয়ার্টারে যেতে বলে। কারণ আমি জানতাম তুমি ওখানে গেলে অন্তত জানতে পারবে শুভ্র মারা গেছে । কারণ ওখানে তো ওর নর্মাল ডেথ এর সার্টিফিকেট শো করা হয়েছিল। ওখানে সবাই জানে হ্ঠাৎ ই হার্ট এট্যাকে মারা গেছে শুভ্রনীল সাখাওয়াত । আমি এয়ারপোর্টে বসেছিলাম। আমি জানতাম তুমি এসব কিছু জেনে আমাকে ফোন করবে। জানতে চাইবে সব কিছু । আমি ফোনেই সব কিছু বলে দিতে চেয়েছিলাম, সব কিছু মানে এসব কিছু । শুভ্রর যে হার্ট এট্যাকে মৃত্যু হয় নি সে সব ই বলতে চেয়েছিলাম । আর সব কিছু বলার সুইসাইড ও করতে চেয়েছিলাম। কারণ কোন মুখ ছিল না এসবের পর তোমার সামনে দাড়ানোর। যেই তুমি আমাকে এতটা বিশ্বাস করতে সেই আমি কি কিই না করেছি! কিন্তু তুমি তারপর শুভ্রর ফোনে ফোন করলে। আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়ত শুভ্রর ব্যাপার কিছু জেনে গিয়ে সব কিছু বুঝতে পেরে ফোন করেছ। কিন্তু না ফোনে আমি কিছু বলার আগেই তুমি সব কিছু বলতে শুরু করলে। মানে আমি বুঝতে পারলাম প্ল্যান আসলে আমার মতই এগিয়েছে। আমি ভুলিয়ে দিতে পেরেছি শুভ্রকে। আমি এটাও নিশ্চিত হয়ে গেলাম তুমি আর শুভ্র কে না তুমি এখন অভ্রকেই ভালোবাস। তাই আমি শেষ বারের মতো আর একবার শুভ্র সাজলাম। শুভ্র সেজে খুব সুন্দর করে তোমায় বিদায় জানালাম। তারপর এক টুকরো তৃপ্তির হাসি হাসলাম।"
.
" বাহ। আর আমি গিয়ে যে দেখলাম আপনি মন খারাপ করে বসে আছেন।হাতে কি যেন নিয়ে ।"
.
" হুম ড্রাগস এর লিথাল ডোজ ছিল হাতে। ভাবছিলাম সুইসাইড তো আর করতে হলো না। আল্লাহ্ আমার সাথে আছেন হয়ত। তাই আজও আর ধরা পড়তে হলো না । এমনি ড্রাগসের গায়ে কি কি লেখা আছে তা পড়ছিলাম ।মনে মনে তো জেনেই গেছিলাম তুমি ফিরে আসছ। কিন্তু একটু মন খারাপের অভিনয় তো করতেই হয়েছিল। যেন সব কিছু ঠিকঠাক মনে হয়। যেন তুমি সামান্যতম সন্দেহটূকূও আমাকে না করো ।"
.
" তাহলে আমি পার্টিতে কাকে দেখেছিলাম? আমি শুভ্রকে চিনতে এতটাই ভুল করলাম?আমি ঐ পাঞ্জাবি নিজে হাতে বানিয়েছি অভ্রনীল । ঐ পাঞ্জাবি আমার চিনতে ভুল হবে না ।"
.
" ও তো আমারই এক গার্ড ছিল। আমি শুধু ওকে শুভ্রর পাঞ্জাবিটা আর ক্যাপ দিয়েছিলাম। ও হাইটে, গায়ের রঙে শুভ্রর মতোই ছিল । আর চুল ও ছাটতে বলেছিলাম ওভাবেই। তুমি অন্ধকারে শুধু সেই লাল পাঞ্জাবি আর ক্যাপ পড়া একটা অবয়ব দেখেছিলে। আর কিচ্ছু না। মুখ তো ঢেকে রেখেছিল ক্যাপে। আমি জানতাম তুমি শুভ্রর ঐ বাটি ছাটের চুল একদমই পছন্দ করো না। তাই শুভ্র তোমার সাথে দেখা করতে আসলে ও ক্যাপ পড়ে আসত মাঝে মধ্যে । আর আমিও ঐ সুযোগটাই নিয়েছিলাম। আর হানিমুন থেকে ফিরে এসে সেদিন রাতে আমি সব কিছু পুড়িয়ে ফেলি শেষ বারের মতো , শুভ্রর যত কিছু ছিল আমার কাছে সব কিছু । নিজের ভেতরকার শুভ্র নামক সত্ত্বা কেও মেরে ফেলেছি। "
.
"এসব শুনে আমি উত্তর দেবার মতো ভাষাই আর খুজে পাচ্ছি না বিশ্বাস করুন।"
.
" বলতে তো তোমাকে হবেই। আমাকে শাসন করো,যা ইচ্ছে তাই করো কিন্তু দোহায় লাগে আমার সাথে ফিরে চলো । আমি তোমাদের ছেড়ে পারব না থাকতে বিশ্বাস করো ।"
.
" তোমাদের?"
.
" হ্যা, তুমি আর আমার ছোট্ট অভ্রনীল বা অভ্রনীলা ছাড়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে থাকা। ফিরে চলো তুমি। আমি ফেরাতে এসেছি তোমাদের।"
.
" আমি একবার যখন ও বাড়ি থেকে বেরিয়েছি আর ফিরব না । আমি চাই না আমার বাচ্চা আপনার মতো একটা লোকের সান্নিধ্য পাক। আর সে নিজেও আপনার গুনগুলো পাক। আমি ওকে একটা সুস্থ জীবন দিতে চাই। আপনার মতো বিকৃত মস্তিষ্কের বাবার সাথে থাকলে ও যে আরো কত বড় বিকৃত মস্তিস্কের অধিকারি হবে তা আমি বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি। "
.
.
.
চলবে.........................