অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৫৩ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-হুম....ইট সিমস লাইক আপনি ফিফটিন উইকস প্রেগন্যান্ট। 

সোহেল আর মুনা ডাক্তারের মুখোমুখি বসে আছে।প্রেগন্যান্সি টেস্ট আর আলট্রাসাউন্ড এর রিপোর্ট নিয়ে। সোহেল মনে প্রাণে চেয়েছিলো রেজাল্ট যেন নেগেটিভ আসে।চোখের সামনে সেই আশা চূর্ণ হতে দেখে বুকে চাপ লাগলো,কিন্তু মুনার প্রাণোচ্ছল চেহারার দিকে তাকিয়ে সেই কষ্ট আর জেকে বসতে পারলো না।

-আপনারা কি এ্যবোর্ট করতে চান?

-কখনোই না!এ্যবোর্ট কেন করবো,এটা আমার প্রথম বাচ্চা।

-প্রেগন্যান্সি কম্পলিকেটেড হবে।কিছু মেডিসিন দিচ্ছি আর ঔষধ দিচ্ছি।বেড রেস্টে থাকবেন।প্রয়োজন ছাড়া হাঁটাচলা করবেন না।

খুবই কম কথায় সব বুঝিয়ে দিলেন ডাক্তার সোমা।এও জানালেন না যে একটা মেডিকেল কনফারেন্স এটেন্ডের জন্য বাইরে যাবেন,এবং দেশের বাইরে মেয়ের কাছেও থাকবেন কিছুদিনের জন্য। আরেকটা ডাক্তার রেফার করে দিলেন তাই। মুনার ইচ্ছা ছিলো উনার আন্ডারে থাকার,এর জন্য দুঃখ ও প্রকাশ করলো,কিন্তু ডাক্তার সোমা সেটা আমলেই নিলেন না।পরের সিরিয়ালের রোগীকে আসতে বলে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।

-আমাদের ভুটান ট্যুর আমাদের জন্য লাকি ছিলো!

-হুম...

-লাকি ছিলো কারণ সেখানে ভিনা ছিলো না...

মুনার দুঃসাহসিকতা আর স্পর্ধা দেখে সোহেল অবাক হলো।এই বাচ্চা মুনার মাঝে অন্যরকম দাম্ভিকতা এনে দিয়েছে।যার আগমনের খবরই বিষাক্ততা সৃষ্টি করছে মানুষের মনে,সে যে দুনিয়ায় ভালো কিছু নিয়ে আসছে না,সেটা সোহেল ভেতরে ঠিকি টের পাচ্ছে।

-এভাবে সবকিছুতে ভিনাকে জড়িয়ো না।

-আচ্ছা?তিন বছর হলো বিয়ের,চেষ্টা তো আগেও করা হয়েছে,তখন তো কন্সিভ করলাম না।

সোহেল চুপ করে থাকলো।শিউলির চেহারা বারবার ভেসে উঠছে।এখন,এই মুহূর্তে যদি শিউলি ওর সামনে থাকত?কী বলত?


ভিনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।শীত পড়ছে,তাই হালকা শাল গায়ে দেয়া।খুব বেশি ইচ্ছে না হলে এই শাল বের করা হয় না,কারণ এটা ওর মার,শাল গায়ে জড়ালেই মার ঘ্রাণ পাওয়া যায়।আজকে শাল জড়িয়ে পুরোনো দিনে হারিয়ে গেছে ভিনা,মায়ের মমতার যে উষ্ণতা সেটা এই পাতলা শালের প্রতিটা সুতোয় খুঁজে ফিরছে।কী অসহায়ত্ব চোখে মুখে।

-ভিইনা 

ভিনা ঘুরে তাকিয়ে দেখলো মুনার মা লতিফা দাঁড়ানো।এতদিনে এই প্রথম ভিনার রুমে আসলো উনি।

-জ্বি আন্টি?

-এমনিই কথা কইতে আইলাম। 

এসেই উনি পুরো ঘরে সড়ু চোখে চোখ বুলিয়ে নিলেন। এরপর ভিনার পাশে এসে দাঁড়ালেন।

-জানোই তো,ঘরে নতুন মেহমান আইতাসে।

-হুম...

-তোমার যে খুব বেশি খুশি লাগতাসে না,হেইয়াও আমি জানি।

ভিনা তেমন কিছু বললো না।শুধু হু বলে দাঁড়িয়ে থাকলো।

-আমি তোমার মনের অবস্থাডা বুঝতে পারতেসি,সৎ ভাই বুইন কেউই চায় না।

ভিনাকে চুপ থাকতে দেখেও লতিফা দমে গেলেন না।বরং দ্বিগুণ উৎসাহে কথা চালিয়ে গেলেন।

-আমি কইতাসি কী,তোমার বেশি কষ্ট হইলে তুমি হোস্টেলে চইলা যাও।

-যাবো....

লতিফার চোখ চকচক করে উঠলো।

-কবে যাইবা?

-এক বছর পরে....

-কী?!এত পরে?

ভিনার মাথায় এবার চরচর করে রাগ উঠে গেলো।

-আন্টি,আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন,বাসাটা আমার বাবার...আর মায়ের ও....

লতিফা আশা করেনি যে ভিনা মুখের উপর এভাবে বলবে।প্রায় মাস খানেক ধরে এখানে আছেন,কখনো এত রাগ দেখেননি।

-শোনানো লাগবো না।কিন্তু তুমি হয়ত টের পাইতাসো যে তোমার আব্বা এহন কারে ঘরে রাখবার চায়।তোমার ভালার জন্যই বলসিলাম আমি।বাইর করার আগে,বাইর হইয়া যাও।

শেষ কথাটা ভিনার বুকে তীরের মত লাগলো।কিছু বলতে গিয়েও আর বললো না।দাঁতে দাঁত চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।

-শোনো ভিনা।শুনলাম মুনা পোয়াতি হইসে আরো মাস তিনেক আগেই,আর পাঁচ ছয় মাস পরই তুমি থাকবার পারবা না।সামনে তোমার কলেজ পাশের পরীক্ষা,অন্য জায়গায় গিয়া পড়াশোনা করো।ওরা ওগো মত সংসার করুক,তুমি তোমার মত পড়াশোনা করো গা।

-আপনি যান এখন।

-বলা লাগবো না।থাকতে আসি নাই তোমার ঘরে।এই খানে কিসু টাকা আসে খামে,আর তোমার মায়ের গয়না।তোমার বাপ মুনা রে এই গয়নাটি দিসিলো।আমার মাইয়া সোনার মানুষ দেইখা তোমারডা তোমারে দিয়া দিতাসে। 

কথাগুলো বলে লতিফা চলে গেলো। ভিনা বাক্সে রাখা গয়না গুলো খুলে দেখতে লাগলো।মায়ের তেমন কোনো গয়না ছিলো না।যাইই ছিলো,সেগুলো পড়তো ও না।আজকে এই গয়না গুলো দেখে নিজেকে ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ভিনার জন্য। একটা বছরই তো,তাও কেন এত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গভীর রাত পর্যন্ত এসব বিষয় নিয়ে ভিনা চিন্তা করলো।এরপর স্টোর রুম থেকে দুইটা লাগেজ নিয়ে আসলো।ধুলা পরিষ্কার করে মেঝেতে রেখে ভাবতে লাগলো,ঘরটা না ছাড়লে হয় না?
.
.
.
চলবে.................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন