রেণু খালা কমলার এক কোয়া অবন্তীর মুখে তুলে দিয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে বলে," অভ্রনীল তো আমারই।"
'
" মানে?"
'
মানুষ অতিরিক্ত খুশির মূহুর্তে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না খুব একটা । রেণু খালাও আজ খুব খুশি। তার অভ্রনীল বাবা হতে চলেছে। এই খুশির রেশেই হঠাতই এমন উত্তর দিয়ে ফেলেন তিনি। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সংযত করে নেন।
'
'
"মানে তনু আপার পরেই ওর দায়িত্ব তো আমিই নিই তাই না? সে হিসেবেই বলেছি আমার অভ্রনীল ।"
" ওহ আচ্ছা।"
" খালা আপনি বিয়ে করেন নি কেন?"
" বিয়ে মানে বসন্ত?"
" হুম।"
ততক্ষণে অবন্তীকে পুরো কমলা খাওয়ানো শেষ রেণু খালার। যেতে যেতে বলে," তোমার মতো আমার জীবনেও বসন্ত এসেছিল । বসন্তের পুষ্প আমিও ধারণ করেছি।"
'
'
রেণু খালার এসব কথা অবন্তীর বড্ড এলোমেলো লাগে । তবে এলোমেলোর মাঝেও গোছানো কিছু ইঙ্গিত আছে। হঠাৎই অবন্তী খেয়াল করে কিছুক্ষণ আগেও রেনু খালা বলেছিল, " এমন সময় আমিও পার করে এসেছি । আমার কাছে লুকোতে চাও?" এখন আবার বলছে বসন্তের পুষ্প ধারণ করেছে ।
" আচ্ছা দুয়ে দুয়ে চার মিলে যাচ্ছে না তো এখানে?"
অবন্তী নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে ।
'
রাতে অভ্রর সাথে আপেল খেতে খেতে অবন্তী জিজ্ঞেস করে, " আচ্ছা অভ্রনীল রেণু খালার ব্যাপারে আপনি কতটুকু জানেন?"
'
" এ আবার কেমন প্রশ্ন? পুরোটুকু চিনি।"
" আপনি রেণু খালাকে এত ভালোবাসেন কেন? সত্যি করে বলুন তো রেণু খালা আপনার কে?"
'
" রেণু খালা আমার কে তা জানো না বুঝি তুমি আজ আবার এতদিন পর এ প্রশ্ন?"
'
" না আপনি মিথ্যে বলেছেন আমি জানি । সত্যি করে বলুন। আপনার মিথ্যে বলার অভ্যেস এখনো যায় নি তা আমি ভালোই বুঝতে পারছি। আর এই মিথ্যে বলার অভ্যেস যে রেণু খালার কাছে থেকে পেয়েছেন তাই না? "
'
অভ্র এবার বেশ রেগে যায়। আর যা হোক রেণু খালার নামে কিছু বলা সে একদম পছন্দ করে না।
" তুমি আর একটা উল্টোপাল্টা কথা বলবে না । তুমি কেন বললে আমার রেণু খালাকে মিথ্যেবাদী? আর আমি নিজেও কোন মিথ্যে বলি নি। রেণু খালা আমার দুসম্পর্কের খালা হয় আমি এটাই জানি আর এটাই বলেছি। "
'
" দুসম্পর্কের খালার প্রতি এত কিসের টান আপনার? কই আমার তো নিজের খালার ওপরও এতো টান কাজ করে না? "
'
" কি বলতে চাইছ তুমি বলো তো? আমি একটু শান্তি চাই অবন্তী। মিছেমিছি কি একটা ব্যাপার নিয়ে অশান্তি করতে চাইছ তুমি? "
'
'
অবন্তী আর কোন কথা বলে না চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে ।অভ্র ও কিছুক্ষণ পর অবন্তীর দিকে পাশ ফিরে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গাল আর কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দেয়। কানের নিচে আলতো করে চুমু একে দেয়। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,'' আমাদের মধ্যে অবিশ্বাসের যত আগাছা ছিল আমি সব উপড়ে ফেলেছি , এখন সময় বিশ্বাসের বীজ বোনার।''
'
অবন্তী কোন উত্তর দেয় না ।কি জানি আবার একটা অবিশ্বাস তৈরি হয় অভ্রর প্রতি।
''অভ্র কি সত্যি কিছু জানে না? নাকি সবটাই মা ছেলে দুজনের প্ল্যান? উফফ কি সব ভাবছি আমি!!''
.
.
বেশ অনেক্ষন পর অভ্র'র উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করে অবন্তী। তার মানে ঘুমিয়ে পড়েছে। কোমর থেকে ওর হাত সরিয়ে উঠে বসে পড়ে । কোন কিছুতেই শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না যেন। একে তো রেণু খালা আর অভ্র'র ব্যাপার। আর তাছাড়াও আরো ব্যাপার, যে ব্যাপারে খটকা লাগার জন্যই ফিরে এসেছে ।হুম এবার নিজেকেই কিছু করতে হবে। আরো কিছু ব্যাপারে খোজ নিতে হবে নিজেকেই ।
'
'
বেলকনিতে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক্ষন। টাইলসে ঘেরা যে কবর দেখে প্রথম দিন ভয়ে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয়েছিল এখন সে কবর দেখলে মায়া হয়। একটা খুন, আর সেই খুনের সূত্র ধরেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয়া এক বিকৃত মস্তিষ্ক। পেছনে আবার তাকায় বেঘোরে ঘুমানো অভ্র'র দিকে।
ফজরের আযানের বেশ আগে অভ্র জাগা পেয়ে খেয়াল করে অবন্তী ঘুমিয়ে পড়েছে। সে উঠে চলে যায় রেনু খালার রুমে।
রেণু খালা গুনগুনিয়ে কাদছে । আজ বড্ড মনে পড়ছে সে সব বসন্তের দিনগুলো। এইতো সবে হেমন্তের শেষ । এরপর শীতকাল তারপর বসন্ত। অথচ আজ মনে পড়ছে সেই বসন্তের কথা । কৃষ্ণচূড়া সেদিনও ফুটেছিল, শিমুল ফুল ও ফুটেছিল। কেউ একজন হাতে একগুচ্ছ শিমুল দিয়েছিল।
অভ্র রেণু খালাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মা ময় শরীরের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলে,
" রেণু খালা তোমাকে না আমি কাদতে নিষেধ করেছি? আজ আবার কেন কাদছ তুমি? "
'
" আমাকে কি তোর একবার ও মা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে না?"
" হুম আগে তো মা বলেই ডাকতাম। কিন্তু সবাই যে নিষেধ করে ।''
'' তো এখন কি সমস্যা? এখন তো কেউ দেখছে না।"
" অভ্যেস হয়ে গেছে রেণু খালা বলতে বলতে। খালা বলেছি তো কি হয়েছে তুমি তো আমার মা ই। কি সুন্দর মা মা গন্ধ তোমার গায়ে। "
" পৃথিবীর সব মায়ের শরীরেই আল্লাহ্ তায়ালা বিশেষ এক সুবাস দেন। যা সন্তান ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারে না বাবা।"
'
" বাবাদের শরীরে সেই গন্ধ থাকে না?"
" হুম থাকে তো । এই যে তুমি এখন বাবা হচ্ছ তোমার সন্তান ও অনুভব করবে তোমার সুবাস। "
" রেণু খালা তুমি মাঝে মাঝে কেন কাদো বলো তো? "
" এমনি বাবা। তেমন কোন কারণ নেই। এমনিতেই।"
'' সত্যি তো?"
"হুম।''
" মিথ্যে কথা ।"
'' ঘরে যাও অবন্তী একা আছে হয়ত। ওকে ডেকে দাও নামাজ পড়ার জন্য আর নিজেও নামাজ পড়ো ।"
'
'
যেতে যেতে অভ্রর মনে পড়ে সে তো এসেছিল অবন্তীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে। ও কেন আজ হঠাৎ এমন সব প্রশ্ন করল। সে বিষয়ে জানতে এসেছিল রেণু খালার কাছে । কিন্তু খালার মন ভালো করতে ওসব আর মনেই ছিল না । অভ্র আবার যায় প্রশ্নগুলো করতে। কি যেন মনে করে আবার ফিরে আসে । খালার এমন মন খারাপ আর সে কি না নিজের সমস্যার কথা বলে আবার ঝামেলা বাড়াবে।
'
'
পরদিন অভ্র অফিস যাবার পর অবন্তী গার্ডেনের গোলাপ চারা গুলোতে পানি দিচ্ছিল। বছর ঘুরে আবার শীত পড়তে শুরু করছে ধীরে ধীরে । কিছু চন্দ্রমল্লীকার চারা লাগালে মন্দ হয় না । মালিকে বলে নীল, হলুদ , সাদা রঙের চন্দ্রমল্লিকার চারা আনিয়ে নেয়। চারা বুনতে বুনতে মনে পড়ে অভ্রনীলের কাছ থেকে শুনেছিল মায়ের প্রিয় ফুল নীল চন্দ্রমল্লিকা। নীল রং তার ভীষণ প্রিয় ছিল। তাই তো একমাত্র ছেলের নামের সাথে নীল শব্দটাই যোগ করেছিল। অবন্তীরও প্রিয় রঙ নীল । অবন্তী মায়ের কবরেও ক'টা নীল চন্দ্রমল্লিকার চারা বুনে দেয়।
'
'
অবন্তী সকাল থেকেই অভ্রর সাথে তেমন কোন কথা বলছে না । কেমন যেন ইচ্ছেই করছে না কথা বলার। ও কি আবার কোন মিথ্যে বলছে? কি জানি। অতিরিক্ত মিথ্যে বলা মানুষের কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে মিথ্যে তা বোঝা মুস্কিল।
.
.
.
চলবে..........................