অবন্তী সকাল থেকেই অভ্রর সাথে তেমন কোন কথা বলছে না । কেমন যেন ইচ্ছেই করছে না কথা বলার। ও কি আবার কোন মিথ্যে বলছে? কি জানি। অতিরিক্ত মিথ্যে বলা মানুষের কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে মিথ্যে তা বোঝা মুস্কিল।
অবন্তী দু-তিন দিন অভ্রর সাথে ঠিক মতো কথা বলে নি সন্দেহ জনিত কারনেই। তারপর আবার নিজে থেকেই সব স্বাভাবিক করে নেয়। অভ্রকে দু- তিন দিন বেশ ভালো করে লক্ষ্য করেছে সে। কিন্তু কোথাও মনে হয় নি অভ্র আবার কিছু লুকোচ্ছে।
'
আজ সকাল থেকেই অভ্রনীলকে বেশ ব্যাস্ত বলে মনে হচ্ছে । সকাল বেলা থেকেই সব কিছুতে তাড়াহুড়ো করছে । তাড়াহুড়ো করে অফিস গেল আবার তাড়াহুড়ো করেই ফিরে এসেছে দুপুর পরই। এসেই অবন্তীকে বলে পাচ মিনিটে তৈরী হয়ে নিতে। "এই অসময়ে কেন বেরোতে চাইছেন? কোথায়ই বা যাবেন?"
'
'' পুষ্পকুঞ্জে।''
''মানে?''
'' আজ আমরা ফুলের রাজ্যে যাব বুঝলে।''
'' বুঝলাম না ।''
'' বুঝতে হবে না ।তুমি তৈরি হয়ে নাও তো ।''
'
'
এ কথা বলে অভ্রনীল নিজেও গাঢ় নীল পাঞ্জাবি পড়ে তৈরি হয়ে নেয়।অবন্তী পড়ে নেভি ব্লু রঙের শাড়ি । অবন্তী চুলে খোপা করছিল কাটা দিয়ে । অভ্র পেছন থেকে গিয়ে চুলের কাটা খুলে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
'' নীল কন্যাদের এলো চুলেই মানায়।''
'' আমার নীল পুরুষকেও দেখছি নীল পাঞ্জাবিতেই সব চেয়ে বেশি মানায়।''
''আজ নীলে নীলে স্বপ্নিল ,
আমাদের গল্প যেন প্রজাপতির ডানায় বর্ণিল।''
'
-'' বলুন না অভ্রনীল আমরা কোথায় যাচ্ছি?''
-'' বললাম তো ।''
-'' আমরা কি সরিষা ক্ষেতে যাচ্ছি ফটোশুট করতে?''
-'' হঠাৎ এরকম কেন মনে হলো তোমার?''
-'' আজকাল শীতের শুরুতে তো সব কাপলই যায় সরষে ক্ষেতে ফটোশুট করতে। তারপর আপনি আবার নীল পাঞ্জাবি পড়লেন।তাই আমিও ভাবলাম। নীলের সাথে হলুদ রঙ খুব যায় তো ।''
-'' উহু। আমরা তো কৃষ্ণচূড়ার পথে হাটব। লাল গালিচার পথে। বসন্ত আসুক।''
'
'
যেতে যেতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ে । গাড়ি থামে একটা বাংল'র সামনে। বাংল'র নাম '' পুষ্পকুঞ্জ''। বাংল'র সামনে বেশ বড় ধরনের ভিড়। ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো, গেটে ফিতা বাধানো। ওরা নামার সাথেই সবাই হাত তালি দিয়ে স্বাগত জানায়।
'' অভ্রনীল এ আমরা কোথায় এলাম?"
'' পুষ্পকুঞ্জে।''
'' কার বাংল এটা?"
'' আমার । আমার নানাজান আমাকে দিয়েছে । আমার মার পুরো নাম সৈয়দা পুষ্প সিদ্দিকা তনু।''
'' ওহ আচ্ছা। ''
'' হুম ।তবে এটা আজ থেকে আমার না। ছোট ছোট পুষ্প দের কুঞ্জ এটা।''
'' মানে?"
'
অভ্র হাত দিয়ে ইশারা করে সামনে দাড়ানো বাচ্চাদের দেখিয়ে দেয়।
'' ওদের বাড়ি আজ থেকে পুষ্পকুঞ্জ।''
'
'' ওরা কে?"
'
'' ওরা আমার মতোই। পার্থক্য হলো আমার মা নেই
ওদের কারোর মা বাবা কেউ নেই, আবার কারোর মা নেই বাবা আবার বিয়ে করেছে, আবার কেউ ওদের বাবা মার অনৈতিক ফুর্তির বোঝা।''
'
'' বাহ অভ্রনীল! আপনি এটা ওরফ্যানেজ মানে এতিমখানা করতে চাইছেন তার মানে?"
'
" হুম। ওরা এতিম নয়। ওরা হচ্ছে নাম না জানা পুষ্পের মতো । নাম না জানলেও যাদের গুন আর সৌন্দর্য অসীম।''
'
'' অভ্রনীল আজ আপনাকে সবার সামনে আমার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আপনি আসলেই খুব ভালো । আপনাকে নিয়ে আমার গর্ব হাজার গুন বাড়িয়ে দিলেন আপনি আজ।আমার পুচকেও তার বাবাকে নিয়ে অনেক গর্ব করছে নিশ্চয় ।''
'
" হুম । ও কতগুলো খেলার সাথী পেল বলতো?"
" তা অবশ্য ঠিক। জন্মের আগেই অনেক খেলার সাথী পেয়ে গেল।''
'' আমাকে তো ছোট বেলায় খেলতেই দিত না কারোর সাথে । একদম ভালো লাগত না আমার । সব সময় একা একা খেলতে হতো । লুকিয়ে ওদের সাথে খেললেও পানিশমেন্ট দিত বাবা। মা ও মাঝে মাঝে । কিন্তু আমি এমন বাবা হবো না । আমি আমার ছোট্ট সোনার টুকরোকে কত কত ফ্রেন্ড জোগাড় করে দিলাম দ্যাখ। আমরা ওকে এখানে রোজ নিয়ে আসব। ও খেলবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখবো।''
'
'
ফিতা কেটে উদ্বোধন এর পর অভ্র অবন্তীকে ইশারা করে বাচ্চাদের বেলুন আর চকলেট দিতে। বাচ্চারা অবন্তীকে মৌচাকের মতো ঘিরে ধরে। অবন্তী সত্যি আজ খুব খুশি। আর যা হোক সে ও এখন এদের মতো, এতিম।
'
অভ্র'র ডক্টর ড.রেহানা ও উপস্থিত ছিলেন। কথায় কথায় অনেক কথা হয় অবন্তীর সাথে। অভ্র যেমন তাকে এখন নিজের বড় বোন করে নিয়েছে অবন্তীও তাকে নিজের বোনই মনে করে ।
'
'
'' আপু পৃথিবীর বেস্ট বাবা কিভাবে হতে হয়? এর জন্য কি আমাকে কোন কাউন্সিলিং করতে হবে? ''
'
ড .রেহানা অভ্রনীলের এমন প্রশ্ন শুনে না হেসে পারে না ।
'' বেস্ট বাবা হতে চাও?"
''হু''
'
অবন্তী বিরক্তির সুরে বলতে শুরু করে,'' আপু ও এখন থেকেই কি কি করতে শুরু করেছে জানেন? অফিস থেকে ফিরেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে '' How to be a good father, responsibilities of a good father '' এইসব আরো কত কি আর্টিকেল যে পড়ে । ম্যাগাজিন পড়ে । আমাদের রুমে এখন শুধু বাচ্চা সংক্রান্ত ম্যাগাজিন । আমাকেও মুখস্ত করায় সেসব,কি করে বেবির যত্ন নিতে হবে, কি করে ভালো মা হতে হবে। বাবুর জন্য কোন স্কুল ভালো হবে সে সম্পর্কে খোজ খবর নেয়া শুরু করেছে। ওকে একটু বোঝান আপু। ''
'
রেহানা জামান অভ্রর চুলে নাড়া দিয়ে বলে,'' অভ্রনীল ভাই আমার, সময় আর পরিস্থিতি মানুষকে সব কিছু শেখায়। অবন্তীকে বিয়ের আগে তুমি কি 'How to be a good husband ' এর আর্টিকেল পড়েছিলে? পড়ো নি তো । তবুও তো হাজব্যান্ড হিসেবে সব রেসপন্সিবিলিটি কত ভাল ভাবে পালন করে আসছ। শোন এত মাথা ঘামিও না । নতুন অতিথি আসলে সময় আর পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী ঠিক ই বেস্ট বাবা হতে পারবে দেখো । পৃথিবীর সব বাবা ই তার সন্তানের কাছে বেস্ট বাবা।''
'' ভুল কথা । পৃথিবীর সব বাবা বেস্ট বাবা হয় না । আমার বাবা আমার কাছে বেস্ট না ।'' অভ্র একথা বলতে বলতে চলে যায় বাচ্চাদের কাছে । গিয়ে খেলতে শুরু করে ওদের সাথে ।
'
'
অবন্তী আর ড.রেহানা একে অপরের দিকে তাকায় কেবল।
'
.
আজ জুম্মার নামাজ পড়ে এসে অভ্র অবন্তীর দিকে জিলিপি এগিয়ে দেয়। অভ্র জানে অবন্তী এটা খুব পছন্দ করে । এমনিতেই অবন্তী তার সাথে কথা বললেও রেণু খালার সাথে তেমন কোন কথা বলে না ইদানিং অভ্র তা খেয়াল করেছে । হুট করে রেণু খালাকে নিয়ে এমন কি সমস্যা হলো অবন্তীর তা অভ্রর মাথায় ঢোকে না।
জিলিপি এগিয়ে দিতে দিতে বলে,
" এই আমাদের মেয়ে হবে নাকি ছেলে হবে তা বুঝব কবে গো?"
অবন্তী জিলিপিতে এক কামড় বসিয়ে বলে," বোঝার সময় হলেই বুঝবেন । এত তাড়া কিসের? নাকি বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্টির মতো ছেলে চাই? মেয়ে হলে মেরে ফেলবেন? "
'
" কি বলছটা কি তুমি এসব? আমি আমার মেয়েকে কেন মেরে ফেলব?ছেলে হোক বা মেয়ে সবই আল্লাহর দান। আমি সবকিছুতেই খুশি। আল্লাহ খুশি হয়ে আমকে যা দেবেন আমি তাতেই খুশি। আমার শুধু পাপামুনি ডাক শোনার মতো একটা টেপ রেকর্ডার হলেই হবে। আর আমার বাপ দাদা কি করেছে শুনি?"
'
'
অবন্তী সেদিন যখন বলেছিল অভ্রকে তার জন্মের আগে থেকেই মৃত্যুর মিছিল তৈরি হয়েছে। অভ্র সেদিন ব্যাপারটা বোঝে নি। অবন্তী সেদিনই বুঝতে পারে অভ্র আসলে ওর তৃতীয় আর চতুর্থ বোনের ব্যাপারে জানে না । যাদের ভ্রূণ অবস্থায়ই মেরে ফেলা হয়েছে । কিন্তু আজ কথার ছলে সুযোগ যখন এসেছে এই ব্যাপারটাই কাজে লাগাতে হবে।
'
" আপনার বোনদের মেরে ফেলেনি আপনার বাবা দাদারা মিলে? "
'
" কিহ? কাকে মেরে ফেলেছে ? অর্পি আপু আর অর্নি তো দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে ওদের আবার কে মারল?"
" আপনি যাকে আপনার মা মনে করেন আপনি তার পাচ নম্বর সন্তান তা জানেন ? অবশ্য যদি সে আপনার সত্যিকারের মা হয় তবে।"
'
" আজে বাজে কথার একটা লিমিট আছে অবন্তী। আমি আমার মায়ের তৃতীয় সন্তান সবাই জানে তা। আর আমার মা আমার সত্যিকারেরই মা। মিথ্যে মা হতে যাবে কেন?"
" উহু। আরো দুজনকে মেরে ফেলা হয়েছে আলট্রা করার পর যখন জানতে পেরেছিল মেয়ে হবে।"
" কে বলেছে তোমায় এসব?"
" রেণু খালা।"
" রেণু খালা? কই আমাকে তো এসব বলে নি কেউ কোনদিন?"
" দেখেছেন রেণু খালা ও কথা লুকোতে পরে । তাও আবার আপনার থেকে। "
" কি বলতে চাইছ তুমি?"
" আমি এটাই বলতে চাইছি যে আপনি নিজেও এখনো আপনার নিজের ব্যপারে অনেক কিছুই জানেন না ।"
" কি জানি না আমি?"
" আপনার আসল মা কে সেটাই আপনি জানেন না ।"
" অবন্তী তুমি ঠিক কি বলছ কোন আইডিয়া আছে তোমার এ ব্যাপারে?"
" হ্যা আমি জানি আমি ঠিক কি বলছি। প্রথম কয়েকদিন আমিও ভেবেছিলাম যে আপনি হয়ত সব কিছু জানেন আর আপনার মা আর আপনি মিলেই হয়ত নাটক কষছেন । কিন্তু না আজ সকালে আমি নিশ্চিত হয়েছি আপনি নিজেও এসব জানেন না । আপনিও একটা খেলার পুতুল।"
" মানেহ?"
" জানতে চান সব কিছু?"
অভ্র মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, " হু।"
অবন্তী অভ্রর হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যায় নিচে রেণু খালার রুমে। রেণু খালা তখন নিজের শাড়ি ভাজ করে আলমারিতে তুলতে ব্যাস্ত।
অবন্তী রেণু খালাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে,
" এই মহিলা এ পুরো ফ্যামিলিকে ঘোল খাইয়ে রেখেছে। উনিই আপনার আসল মা। আপনি আসলে রেণু খালার ছেলে ।আর উনিই মেরে ফেলেছে উনার তথাকথিত পরম ভালোবাসার তনু আপাকে।''
.
.
.
চলবে...........................