অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৪৮ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


বিছানায় শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে ভিনা।দেয়াল আর ফ্যানের চারপাশে করা নকশাগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছে।দীর্ঘদিন পর আবার নির্ঘুম রাতের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠা শুরু করেছে।কলেজের সময়টা বেশ ভালোই গিয়েছিলো, এখন আবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে,খুব ভালোমতো টের পাচ্ছে,খুব বড় একটা ধাক্কা খেতে হবে সামনে।
প্রায় ঘন্টাখানেক এপাশ ওপাশ করার পর ভিনা বুঝলো আজকে আর ঘুম আসবে না।বিছানা থেকে উঠে টেবিলে চলে গেলো,পড়ার বইগুলো সাইডে রেখে ডায়রি বের করে ধুলা পরিষ্কার করে লিখতে বসলো।কিছুক্ষণ কলম হাতে নাড়াচাড়া করেও যখন কিছু লিখতে পারলো না,তখন পুরোনো লেখায় ডুব দিলো।

কী যন্ত্রণাময় ছিলো সেই দিনগুলো!একাকীত্ব,বিষন্নতা নিয়ে সিগারেটের ধোয়ার মত বিষাক্ত।একটা মানুষের সান্নিধ্যে কত বদলে গেছে সব।আজকে যাবির পাশে না থাকলে কীভাবে কী হত জানে না ভিনা।অথচ এই মানুষের সাথেই স্বেচ্ছায় দিনের পর দিন কথা না বলে থাকে।মনে হয় একটু আগালেই কাচের টুকরোর মত সব ভেঙ্গে যাবে।

'সময় হোক,সব হবে'
নিজেকে নিজেই বলে ভিনা।এই সময় যে বেশি দূরে নেই,সেটাও বুঝে।আর দুই বছর,বড়জোর তিন।এরপরই নতুন জীবন শুরু করবে যাবিরকে নিয়ে,সম্পর্কের সুন্দর আর ভারি নামও থাকবে।ততদিন ভিনার এই রুক্ষতাকে মেনে নিতে হবে যাবিরের।মনে বিশ্বাস আছে,যাবির মেনে নিবেও।সেদিন ছাদের ঘটনা মনে এখনো শিহরণ জাগায়।কিছুই হয় নি,তবুও মনে হয় কতকিছু যেন হয়ে গেছে।একটা মানুষের স্পর্শে এত মোহ থাকে,জানা ছিলো না আগে।জানলে হয়ত ভিনা এই দেখা করাটাও বন্ধ করে দিত।আসলেই কি পারত না দেখে থাকতে?উত্তর দিতে পারলো না।ভিনা জানে বাস্তবতা আর সমাজ কী পরিমাণ ধারালো।মকবুল স্যারের ঘটনায় যেখানে ওর সামান্য পরিমাণ দোষ ছিলো না,সেখানেও নওমির মা ক্যারেক্টারলেস ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে।নিজের মাঝে সবসময় ভয় কাজ করে,মনে হয় এখনি কেউ এসে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ বানিয়ে সবার কাছ থেকে আলাদা করে নিবে।এই ভয় থেকেই চাওয়া সত্ত্বেও প্রায়ই বিকেলে যাবিরের সাথে দেখা হয় না,হাত ধরে হাঁটা হয় না,মন খুলে কথা হয় না।শুধু অপেক্ষা করে যেতে হয়।কারণ মা নামের সেই মানুষ নেই যে ঢাল হয়ে এসব তীক্ষ্ণ ব্যাপারগুলো থেকে ওকে বাঁচাবে।আর যদি ভুল হয়ে যায়....তাহলে হয়তবা যাবিরকেও হারাতে হবে। 

নির্ঘুম মাঝরাতে স্বাভাবিক ব্যাপারও কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে যায়।সহজ জিনিসগুলোও জটিল মনে হতে থাকে। জীবনে করা ভুল 'পাপ' মনে হয়।অদৃশ্য যন্ত্রণাদায়ক বোঝা বুকের উপর ভর করে।ভিনা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে যে মাথা ভারি হয়ে আসছে চিন্তায়।কথা বলে হালকা হতে হবে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুইটা আটচল্লিশ। এসময়ে যাবির ঘুমেও থাকতে পারে,নাও থাকতে পারে।যাবিরের সাথে এমনিই কথা খুব কম হয়,রাতে তো হয় না বললেই চলে।আজকে হোক একটু ব্যতিক্রম।

-হ্যালো?!ভিনা?!

-হুম

-কিছু হয়েছে?

-কেন?

-এত রাতে ফোন... তাই

-এমনিই দিলাম।ঘুমাওনি হয়ত।

-ঠিক ধরেছো।ঘুমাইনি।

-সামনে এক্সাম

-হ্যাঁ, জীবনের অনেক বড় পরীক্ষা।

-মানে?

- তোমাকে বিয়ে করবো।

-আচ্ছা

-আজকে তেমন রিয়েক্ট করলে না,বিয়ে নিয়েই কি ভাবছিলে?

-ভাবলে ক্ষতি কী?

-না ভিনা,আমি সত্যিই জানতে চাচ্ছি,তুমি কি আসলেও ভাবো আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে?বিয়ে নিয়ে?

-ভাবতেই পারি।

-ভেবে কী সিদ্ধান্ত নিলে?

-এখনো নেইনি সিদ্ধান্ত।ভার্সিটিতে উঠতে দাও।এরপর দেখি।

 -এটার সাথে ভার্সিটিতে পড়ার কী সম্পর্ক?

-আমি আসলে এখানে থাকতে চাই না।কেন যেন মনে হচ্ছে দুইজনের সংসারে আমি থার্ড পার্সন হয়ে থাকছি এবং সেটা একজন বিশেষ পছন্দ করছে না।বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমার এটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমি কীভাবে সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট হয়ে থাকবো।

-বাবাকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে?

-প্রশ্নটা এক বছর আগে করলে উত্তর হয়ত সরাসরি না হতো।আমার নিজের ও ইচ্ছা নেই বাবাকে ছাড়া থাকার।কিন্তু পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে আমি সড়ে আসবো।দূরে থেকে যদি সম্পর্ক ভালো থাকে,তিক্ততা না আসে,সেটাই কি ভালো না?

-কথায় ভুল নেই,কিন্তু সম্পর্কে তিক্ততা আসবে কেন?

-স্বার্থের জন্য,সময়ের সাথে প্রয়োজন বদলে যায়,সেজন্য।

-গভীর রাতের প্রভাব,আপসেট মনে হচ্ছে,কী হয়েছে বলো তো।

-জানোই তো উত্তর দিবো না,তাও কেন প্রশ্ন করো?

-এমনি।সত্যি কথা বললে মনে হয় না আর এরকম ফোন পাবো রাত বিরাতে।

-যাক,বুঝেছো তাহলে।

-এত কথা জমিয়ে লাভ কি বলো তো?

-ভবিষ্যৎ....এখন সব বলে দিলে সারাজীবন কথা না বলে কি কাটবে?

- কাটবে..

-আচ্ছা রাখি,অনেক রাত হয়ে গেছে।

ভিনা সাথে সাথে ফোন রেখে দিলো।আসলেই কথাগুলো জমিয়ে রাখছে,ঠিক এমনি এক রাতে মন খারাপের সময় একি মানুষ কে বলার জন্য।

রান্নাঘরে কফি বানিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হালকা শীতের বাতাস উপভোগ করছে ভিনা,ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে ভোর দেখার ইচ্ছা আছে।কানে হেডফোন লাগিয়ে পুরোনো দিনের গান ছেড়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ঘুমন্ত শহর দেখতে দেখতে কফির মগে একটু করে চুমুক দিচ্ছে।

সোহেলের সাথে ভিনার বিষয়ে কথা বলার পর থেকেই সোহেল বেশ আপসেট ছিলো।সপ্তাহে একদিন সোহেল ঘরেই থাকে,ব্যবসায়িক কাজে বাইরে যায় না। কালকেও ঘরে থাকার কথা ছিলো।ভুটান থেকে আসার পরে সোহেল একদিনও মুনার কাছে যায়নি।ভিনা বিষয়ক নানা ব্যাপারে মুনা যে মানসিক চাপের সৃষ্টি করেছে,এর কারণে দূরে থাকছে সব থেকে।মুনার ইচ্ছা ছিলো আজকে একটা সুন্দর রাত কাটানোর,কিন্তু সোহেল অনীহা তো দেখিয়েছেই,অপমান ও করেছে। 

'এই বয়সেও কম বয়সী মেয়েদের মত ছোক ছোক করার অভ্যাস ছাড়ো মুনা,ভুটানে অনেক করেছো।'

মুনা ভাবতেও পারেনি সোহেল এমন কিছু বলবে।আত্মসম্মানে চরমভাবেই আঘাত লেগেছে। এতটাই যে সোহেলের পাশে ঘুমাতেও নিজের উপর ঘৃণা লাগছিলো।বারান্দায় ভিনাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ করুণা হলো নিজের উপর।যার জন্য এতকিছু করছে সে কী সুন্দর বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরিবেশ উপভোগ করছে,আর মুনা নিজের আত্মসম্মান আর আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্বে শেষ হয়ে যাচ্ছে।


সকালে নাস্তার টেবিলে তিনজন একসাথে বসেছে আজকে।যেদিন সোহেল বাসায় থাকে,সেদিন একসাথেই নাস্তা খাওয়া হয়।ভিনা ভোর দেখার পর ঘুমালেও সকালের নাস্তা মিস করলো না।খাবার টেবিলে ঘন ঘন হাই তোলা দেখে সোহেল জিজ্ঞেস করলো

-কী হয়েছে?ঘুম হয়নি রাতে?

-হয়েছে,ছাড়া ছাড়া আরকি।

মুনা কোনো কথাই বললো না।যে যার মত খেয়ে চলে গেলো রুমে।

-সোহেল,কিছু কথা ছিলো।

-শুনছি,বলো।

-ভিনা খাবার টেবিলে ঝিমাচ্ছিলো কারণ সারারাত ও ফোনে কথা বলেছে এক ছেলের সাথে।

-কী?তুমি জানলে কীভাবে?

-কালকে আমি রুমে ঘুমাইনি,সেটা যাই হোক,বারান্দায় দেখলাম ফোন হাতে কার সাথে যেন কথা বলছে।

-কী কথা বলছে?

-সেটা শুনিনি।

-জিজ্ঞেস করোনি?

-না,কী না কী ভাবে।তুমি সরাসরি কিছু বলো না, কিন্তু বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে দেখো।এর আগেও কিন্তু বলেছিলাম যে ভিনাকে এক ছেলের সাথে দেখেছি।

-সিদ্দিকের সাথে কথা হয়েছিলো আমার মুনা..

-সিদ্দিক ভাই বয়স্ক মানুষ,সারাদিনই আমি তাকে ঘুমাতে দেখি।বয়স হয়েছে দেখে তাকে বাদও দিয়ে দেয়া হয়েছে।তুমি তার কথা বিশ্বাস করলে?মেয়েকে ঘরে একা রেখে যাচ্ছো,আমি বলছিনা তুমি বিশ্বাস করো না,কিন্তু অন্ধবিশ্বাস ভালো না,কারণ বয়সটাই খারাপ।আমি মা হিসেবেই বলছি।

-ঠিক আছে,আমি দেখবো। 


সন্ধ্যাবেলা সোহেল ভিনার রুমে গিয়ে বিছানায় বসলো।ভিনা তখন পড়তে বসেছিলো টেবিলে।ঘুম থেকে উঠার কারণে চোখ ফুলে ছিলো।

-তোমার রুটিনে বেশ অনিয়ম এসেছে দেখছি।

-আসলে শীত পড়েছে তো,তাই ঘুম এসে পড়েছে।

-রাতে কি ঘুম হচ্ছে না ঠিকমতো? 

-মাঝে মাঝে হয় না আরকি।

-মনে হয় মোবাইলের জন্যই এমন হচ্ছে।

ভিনা অবাক হয়ে গেলো।সাথে সাথে স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-মোবাইলের জন্য কেন হবে বাবা?আমি তো মোবাইল তেমন ইউজই করিনা।

-দিনে করো না হয়ত।

-কী হয়েছে? আমাকে বলো বাবা।

-কিছু না।সামনে তোমার বোর্ড এক্সাম।মোবাইল ততদিন আমার কাছে জমা থাকলো।

এই বলে সোহেল ভিনার ফোন নিয়ে চলে গেলো।কী হলো ভিনা কিছুই বুঝতে পারছে না।পুরোনো মোবাইল,যেটা ডিসপ্লে ই ঠিকমত কাজ করে না,সেই মোবাইল পড়াশোনার এমন কী ক্ষতি করলো ভেবে পাচ্ছে না।খুব বেশি অসুবিধা হবে না,কিন্তু যাবিরের সাথে যতটুকুই কথা হত,সেটা বন্ধ হয়ে গেলো।

'ব্যাপার না' বলে বিষয়টা আমলে নিলো না।এমনিও কথা হত না তেমন।আরেকটু কমে গেলেও বিশেষ পার্থক্য হবে না,যে অপেক্ষা করার,সে এমনিই অপেক্ষা করবে। তবুও খারাপ লাগছে,তবুও।


বেশ কয়দিন এভাবেই চলে গেলো।ভিনা খেয়াল করলো সোহেল ঠিকভাবে কথা বলছে না ওর সাথে।প্রথম কয়দিন গুরুত্ব না দিলেও এখন বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে।আগে যাও একটু রুমে আসত,এখন তাও আসে না।এমনকি দেখাও হয় না প্রায় দিন।শেষে একদিন মুনাকে জিজ্ঞেসই করে ফেললো ভিনা-

-বাবা কি কোনো কারণে টেনশনে আছে? 

মুনা এই প্রশ্নেরই অপেক্ষা করছিলো।

-আর বলো না।কী সব আজগুবি চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে থাকে সেইই জানে।

-কেন?হয়েছেটা কী?

-সে ভাবছে তুমি বোধহয় কোথাও ইনভলভ হয়েছো।

-মানে!

-জানি না,কোথা থেকে এসব মাথায় আসে।সেদিন আমাকে বলছে আগে তুমি সিগারেট খেতা,এখন প্রায়ই বাসায় একা থাকো।কী না কী করো এসব নিয়ে চিন্তায় আছে।

ভিনা কান্না চেপে কথা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো

-সিগারেট?সেটা তো প্রায় দুই বছর আগের ঘটনা, এখন এসব কেন বলছে?

-কী জানি।বলছে তুমি নাকি আগের চেয়ে চেঞ্জ হয়ে গেছো।মোবাইল নিয়ে রাত বিরাতে থাকো বারান্দায়।

-কী আশ্চর্য! আমি তো গান শোনার জন্য সেদিন বারান্দায় গিয়েছিলাম!

-তোমার বাবাকে বোঝায় কে!অহেতুক সন্দেহ করে খালি।সেদিন যে কী উল্টাপাল্টা কথা বলছিলো।বলে কি তুমি নাকি বাসায় একা থাকো,তোমার দিকে ঠিকমতো খেয়াল রাখা হয়নি,তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিবে।

-ডাক্তারের কাছে?কেন?

-বাদ দাও ভিনা।তোমার বাবা এসব হুজুগের মাথায় বলেছে।

-বাবা কী বলেছে?

-তোমার মেডিকেল টেস্ট করাবে....

ভিনা সোফায় বসে পরলো।মনে হলো কেউ মনে হয় গলা চেপে ধরে কেটে ফেলছে।

-তুমি এসব বাজে জিনিস নিয়ে ভেবো না তো।আমি তোমার বাবাকে সব বুঝিয়ে বলেছি।সে বুঝেছে।

-সামান্য ফোন নিয়ে বাবা এত বড় কথা বলে ফেললো!

-বাবা তো!চিন্তা করবেই।তুমি এসব ভেবো না।রুমে যাও ভিনা।

ভিনা মূর্তির মত বসে থাকলো।শ্বাস নেয়াও ভুলে গেছে হয়ত।মেডিকেল টেস্ট?নিজের বাবাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করবেই বা কীভাবে,এত স্পর্শকাতর বিষয়ে নিয়ে যে কখনো বাবা মেয়ের মাঝে দূরত্ব আসবে ভিনা ভাবতেও পারেনি।আজকের পর থেকে আর কখনো সোহেলের মুখোমুখি ও হতে পারবে না।নিজেকে এত বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী হলো?নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করা গেলো না?ভিনা নিজের ঘরে যেয়ে বালিশ চেপে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।শুধু এতটুকুই বুঝলো,এ ঘর ছেড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
.
.
.
চলবে................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন