চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় স্পষ্ট কিছু দেখতে পারছে না ভিনা।এই রাতের বেলায় দুইটা স্যুটকেস নিয়ে দিশেহারা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।গলির নিয়ন বাতির একটা নষ্ট,আবছা আলোয় নিজেকে অনুভব করতে পারছে না ভিনা।বড় হওয়ার পর থেকেই জীবনের শুধু সাদা কালো রূপটাই দেখে আসছে।কিছু ছেলে পাশে দাঁড়িয়ে হাসি ঠাট্টা করছে।
'যাবা নাকি?'
'তোমারে নিয়া একটু জান্নাত দেইখা আসি'
'আহা এত রাতে পরির মত মেয়েটা কই যাবেএএএ'
'আরে মামা আমরা আসি না?'
'রানির মত রাখবো'
'রাজার মত করবোও'
'রাজা কন্ডম দিয়া?'
'তোরা অনেক ফাযিল রে,এত খুইলা কেউ বলে?'
'তাই মামা?যখন খুইলা করবা?তখন শরম লাগবো না?'
চোখ মুছে হাঁটা ধরলো ভিনা।ভেতরে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে,তবু মুখে যথাসম্ভব রুক্ষতা রেখে চলতে লাগলো। এটাই জীবন।মানুষ যাকে ভাঙতে দেখে,তাকে আরো পুরো ভেঙে দিতে চায়।
•
-আপদ বিদায় হইলো!এখন আর একদম পেরেশানি নিবা না মুনা।বাচ্চা আর নিজের খেয়াল রাখবা।
লতিফা বিছানায় পা উঠিয়ে বসতে বসতে কথাটা বললো।মুনা ম্যাক্সি পরে জোরে ফ্যান ছেড়ে মায়ের পাশে বসে কাঁধে মাথা রাখলো।
-আম্মা রে,জানো না আমি এই মেয়ের জন্য কত সাফার করেছি।
-জানি তো,এর জইন্যই তো এত কিছু করলাম।গ্রাম থেইক্যা এই মাইয়ারে আনতে আমার অনেক কাঠ খড় পুড়ান লাগসে।কইতে হইবো,মাইয়া চতুর আসে।
-এই মেয়ে কে বেশিদিন কিন্তু রাখবো না। এত সেয়ানা মেয়ে ঘরে রাখার মানেই নেই।
-আরেকটা মানুষ না পাওন পর্যন্ত রাখ এইটারে।
-কত ভাবো তুমি আমার কথা!অথচ আব্বা যাওয়ার পর তুমি এমন কেন করেছিলা?তুমি জানো আমি মরে যেতে নিয়েছিলাম।
-কী!কী বলোস তুই!
-হ্যাঁ।একটাবার খোঁজ ও নিলানা।সোহেল তারেক কে ফোনও দিয়েছিলো,তারেক বলেনি তোমাকে?
মুনা অভিমান ভরে কথাটা বললো।
-ঐ পোলা?হারামজাদা একটা। কিচ্ছু জানায় নাই আমারে।
লতিফা এক নিমিষেই ছেলের কাঁধে দোষ চাপিয়ে দিলেন,যদিও তারেক বলেছিলো মুনার সুইসাইড এটেম্পটের কথা। তিনি উটকো ঝামেলা কাঁধে নিতে চাননি।
মুনা নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে নিজের সব অভিমান ভুলে গেলো।ক্ষণিকের জন্যও মনে হলো না মা হারা মেয়েটাকে পৃথিবীর কুৎসিত রূপ দেখিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।বিবেক একবার পাপের নিচে চাপা পড়লে সহজে জেগে উঠে না।
ভিনা লতিফার কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো রুপিনের বাসায় যাওয়ার।তার আগে সোহেলের সাথে পুরো বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলে যেতে চেয়েছিলো।কিন্তু সকাল থেকেই বাসার নতুন কাজের মেয়েটা এটা ওটা করতে রুমে আসছিলো।ভিনা ধমক দেয়ার পর ও গায়ে লাগাচ্ছিলো না। ভিনা গভীরভাবে নিলো না ব্যাপারটা। নিজেই অনেক দুশ্চিন্তা আর মানসিক অশান্তিতে ছিলো।নতুন মেয়ের নাম চুমকি।চুমকি এসে ভিনাকে জিজ্ঞেস করলো-
-কী রে আপা?যাইবা নাকি কোথাও?
-কেন?
-ব্যাগ গুসাইসো যে।
-হ্যাঁ যাবো,কোনো সমস্যা?
-না এমনি,কোনো হ্যাল্প লাগলে বইলো।
-পরে বলবো।
চুমকি আবার বিশ মিনিট পরে আসলো ঘরে।
-গুছান শ্যাষ হইসে?কখন যাইবা?
-আজকে যাবো না।আমার কাজ আছে।কাজ করে যাবো আমি।তোর এত কী?
-এমনিই জিগাইলাম। কী কাজ কওন যাইবো?আমি কইরা দেই?
-না।আমার আর বাবার কাজ এটা। তুই যা রুম থেকে। বারবার আসবি না।
চুমকি গেট সামান্য খোলা রেখে চলে গেলো।এমনি দিন শুধু রাতে কথা বললেও আজকে দিনেই ফোন দিলো যাবিরকে। যাবির স্পষ্ট জানিয়ে দিলো সোহেলের সাথে কথা না বলে যেন ভিনা ঐ বাড়ি থেকে বের না হয়। একবার বের হয়ে গেলে আর কিছু ঠিক হওয়া সম্ভব না।হাজার হলেও,পৃথিবীতে এক বাবা ছাড়া ওর আপন কেউ নেই,তাই এই সম্পর্ক কোনোভাবেই যেন শীতল না হয়।ভিনা সব শুনে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিলো,হাজার হোক,কথা সব বলতে হবে।চুপ থেকে লাভ নেই।
সোহেল বিকেলে আসলো।ফ্রেশ হতে ন্যূনতম যতটুকু সময় লাগে,ততটুকু অপেক্ষা করলো।কিন্তু এর আগেই সোহেল রেগে ঘরে ঢুকলো,একবার পাশে রাখা লাগেজের দিকে তাকিয়েই ভিনার চুল মুঠি করে চড় মেরে বসলো।হতভম্ব ভিনা কোনো রিয়্যাক্ট করতে পারলো না।
-মায়ের গয়না চুরি করলি তুই শেষ পর্যন্ত?সব নিয়ে গেলি আমার থেকে!?সব!
ভিনা চুপ করে আছে। পেছনে নির্বিকার লতিফা আর চুমকিকে দেখে পুরো বিষয়টা ধরতে পারলো।
-কী?চুপ কেন?বল?এমনিই পালায় যেতি।গয়না নিলি কেন?এত যখন মায়ের দরদ,তাহলে কীভাবে তুই এই কাজ করতে পারলি?অন্য ছেলে এত আপন হয়ে গেলো?মুনা ঠিকি বলেছিলো,তুইই এই বাড়িতে থাকতে চাস না।তুইই কাউকে আপন ভাবিস না।
সোহেলের মুখে এই প্রথম তুই তোকারি শুনলো ভিনা।একের পর এক অপবাদ পরাস্ত করে ফেললো ওকে।
হাত টান দিয়ে সোহেল ভিনাকে ঘর থেকে বের করে দিলো।দুটো লাগেজ বাইরে ছুড়ে ফেললো।
-যা খুশি কর।ঐ ছেলেই তো আপন?মর তুই ওর সাথে।
কলোনির সামনে দাঁড়িয়ে ভিনা পুরো সন্ধ্যার ঘটনা ভাবতে লাগলো,মানুষ এত নীচ?এতটাই নীচ?বয়সকালেও বিবেক জাগ্রত হয় না?
.
.
.
চলবে...............................................