-সোহেল,একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো?ভিনা কিন্তু কেমন আচরণ করছে ইদানিং,কারো সাথেই কথা বলে না।
-হুমমম,আমার সামনেও আসে না,দেখা হলেও এড়িয়ে যায়।এমন তো ছিলো না আগে।
-ঐত,মোবাইল নিয়ে গেছো যে,যার সাথেই কথা হত,তার সাথে কথা হচ্ছে না দেখে মনে হয় রেগে আছে।বয়স কম তো,বাইরের মানুষকেই বেশি আপন মনে হয়।
সোহেল কোনো উত্তর দিলো না।মুনার কথা ভুল না,আসলেও মোবাইল নিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভিনা এড়িয়ে চলছে,কথাও বলে না বেশ কয়দিন হয়ে গেছে।যদিও সোহেল বেশ উদারমনা,তবুও উঠতি বয়সী মেয়ের সাথে প্রেম বিষয়ক কথা বলতে বেশ অস্বস্তি হয়।শিউলি মারা যাওয়ার পর থেকেই ভিনার সাথে দূরত্ব বেড়ে গেছে অনেক,আজকে শিউলি থাকলে হয়ত এই বিষয়গুলো খুব সহজেই সর্ট আউট হয়ে যেত।মুনা হাজার হোক আপন কেউ না।তবুও যে ভিনার কথা ভাবছে এটাই বেশি।
সোহেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে চলে গেলো রুম থেকে। মেয়ের উপর এ বিষয়ে মানসিক চাপ দেয়ার কোনো ইচ্ছা নেই সোহেলের।ভুল মানুষেরই হয়,হয়ত ভিনার ও হয়েছে। সোহেলের একটাই ইচ্ছা,ভিনা যেন জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।কয়েক বছরেও এত দূরত্ব আসেনি,কয়েকদিনে যতটা এসেছে,এ কারণে হুট করে এ বিষয়ে কথাও বলা যাচ্ছে না।কীভাবে কী করবে ভেবে না পেয়ে আবার রুমে এসে মুনার পাশে বসলো।
-আমি বুঝতে পারছি না কী করবো।আমার মনে হয় এভাবে ওর থেকে মোবাইল নেয়াটা উচিৎ হয়নি।আগে কথা বলে নেয়া দরকার ছিলো।
মুনা বেশ বিরক্ত হলো একথায়।মেয়ে প্রেম করছে,এ বিষয় নিয়ে একজন বাবার এ ধরনের প্রতিক্রিয়া কোনোভাবেই ভাবতে পারছে না।মুনার নিজের বাবা হলে এতক্ষণে মেরেই ফেলত। সোহেলের কাঁধে হাত রেখে মুনা কথা বলা শুরু করলো।
-আসলে এসব বিষয় একজন মা ভালো হ্যান্ডেল করতে পারে।তোমার কোনো দোষ নেই এখানে।তুমি ওর চিন্তা করো দেখেই তো মোবাইল নিয়েছো,তাই না?
-হ্যাঁ, তাতো অবশ্যই।
-মোবাইল ঘাটিয়ে কিছু পাওনি?
-ঘাটাইনি।ইচ্ছা হয়নি।আমি চিনি আমার মেয়েকে। খুবজোড় কোনো নাম্বারই পাবো হয়ত,অথবা কোনো মেসেজ।
-বেশিই হেলাফেলা করছো।ভিনা অবশ্যই ভালো,কিন্তু বয়সটা না।
-শিউলি মারা যাওয়ার পর থেকে আমি ওকে তেমন সময়ই দেইনি মুনা।আর আমাদের বিয়ের পর তো....
-জানি,আমি অনেক অন্যায় করেছি।
-আমি তোমাকে ব্লেম দিচ্ছি না মুনা,কথা বোঝার চেষ্টা করো।ভিনা যদি কোথাও ইনভলভ হয়েও থাকে,সেটার জন্য কোনো না কোনোভাবে এই পরিস্থিতি দায়ী।
-এখন কী করবে ভেবেছো?
-না,এখনো ভাবিনি।কিন্তু বেশি দেরী করবো না।ওর সাথে খোলাখুলি কথা বলতে হবে।
মুনার ভেতরটা কেঁপে গেলো।যাই ভাবছে,ঠিক তার বিপরীত ফল পাচ্ছে।বাপ মেয়ের এই আচরণে ধৈর্য্য রাখা দায় হয়ে পড়েছে।
-তুমি কি শিওর কথা বলবে?
-কেন?তোমার কী মনে হয়?আমার কী করা উচিৎ?
-আমি কথা বলি ওর সাথে,এমনিই তুমি মোবাইল নিয়ে যাওয়ায় রাগ হয়ে আছে,ঠিকভাবে কথা নাও বলতে পারে।
-ঠিক আছে।
মুনা নিজের ঘর থেকে বের হয়ে সোজা ভিনার ঘরে ঢুকলো।গত কয়দিন ধরে খাওয়া দাওয়া ঠিকমত না করায় চেহারা ভেঙ্গে গেছে ভিনার।অসময়ে বিছানায় শুয়ে আছে,পুরো ঘর অগোছালো।
-ভিনা?
-হুম?
-একটু কথা বলতাম আরকি।
-হুম,বলুন...মানে...বলো।
-তোমার বাবা তোমার বিষয় নিয়ে বেশ আপসেট। অনেক রেগে আছে তোমার উপর।এর জন্য আমি কথা বলতে দেইনি,নিজেই আসলাম।সত্যি করে বলো তো,তোমার কি কোনো ছেলেবন্ধু আছে?আর যদি থেকেও থাকে,তার সাথে সম্পর্ক কেমন তোমার?
ভিনার মাথায় রক্ত উঠে গেলো,'সম্পর্ক কেমন তোমার' প্রশ্নে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে নিজের বাবা এমন ধারণা রেখেছে।কেন যেন মনে হচ্ছে যা না,মুনা সেটাই বলছে।মনে হওয়া বললে ভুল হবে,ভিনার বিশ্বাস যে মুনাই বাড়িয়ে কথা বলে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।
-সামান্য ফোনে কথা বলা নিয়ে এমন প্রশ্ন করা কি ঠিক হচ্ছে?
-কালই তো বললাম,তোমার বাবার একটু টেনশনে আছে।এর জন্য উল্টাপাল্টা কথা বলছে।তাইতো আমি আসলাম,কারণ তার মাথা গরম।
-মাথা গরম হলেই এসব বলতে হবে?নিজের মেয়ের...
-আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা,বাবা তো তাই এমন করে।আমাকে খুলে বলো তো,ছেলে কী করে?
-যার জানার প্রয়োজন তাকে ডাকুন,আমি তার সাথেই কথা বলবো।আমিও জানতে চাই এমন কী করেছি যে বাবাকে এমন ভাবতে হচ্ছে।
-আমাকে বলো,তোমার বাবার সাথে কি বলতে পারবে বলো?
-বললাম তো!!আমি বাবার সাথেই কথা বলবো,আপনি যান!
ভিনা চিৎকার করে মুনাকে চলে যেতে বললো।ছোট একটা মেয়ের কাছে এমন অপমানিত হয়ে মুনার পুরো শরীর রাগে থরথর করছে।সাথে সাথে উঠে চলে গেলো,যেয়েই নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোহেলকে ডাক দিলো।
-কী ব্যাপার মুনা?কী হয়েছে?
-আমি আন্দাজ করেছিলাম কিছু হয়েছে,কিন্তু ভিনা যে এমন করবে ভাবিনি।
-কথা ঘুরিয়ে বলো না,কী হয়েছে সেটা বলো।
-ভিনাকে শান্ত গলায়ই জিজ্ঞেস করলাম সম্পর্কের ব্যাপারে। চেঁচিয়ে উঠলো। বললো আমি কে এসব জিজ্ঞেস করার।বুঝিয়ে বললাম সব,আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলো,প্রচুর মিসবিহেভ ও করেছে।
-সামান্য ফোন নিয়ে নেয়ায় এত রিয়েক্ট?
-প্রেমের পাল্লায় পরলে এমনই হতে থাকে।দোলার এক বান্ধবী যে কী করেছে!একদম হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলো।
-আমি কথা বলবো,চলো আমার সাথে।
-এখন যেয়ো না,পরে যেয়ো।
-পরে কেন?এখনি যাবো,তোমার কোনো সমস্যা?
-ন....না...সমস্যা হবে কেন...
সোহেল ভিনার রুমে ঢুকেই ওর হাত ধরে বিছানা থেকে টেনে তুললো-
-এসব কী হচ্ছে?মুনার সাথে এমন বিহেভ করছো কেন?
ভিনার চোখ লাল হয়ে আছে।চিৎকার করে কিছু বলতেও পারছে না,মেডিকেল টেস্টের কথা মনে পড়তেই আরো চুপ হয়ে গেলো,শুধু মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকলো।
-কী?এত জেদ কার জন্য?কী হয়েছে যে এমন করছো?উত্তর দাও ভিনা!
ভিনা চিৎকার করে উঠলো-
-তুমি কেন আবার বিয়ে করলে!কেন!
-মুনা কী দোষ করেছে?
-কিচ্ছু করেনি!কিচ্ছু না!সব দোষ তোমার! তোমার কারণেই আমার মা মারা গেছে!তুমি নিশ্চয়ই এমন কিছু বলেছো যে সে এভাবে মারা গেছে!
সোহেল ভিনাকে একসাথে পরপর তিনটা চড় মারলো।
-তুই আমার মেয়ে না!কেউ না তুই আমার।
সোহেল নিজের রুমে চলে গেলো,ড্রয়ার থেকে ভিনার মোবাইল বের করে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেললো।
-আমার মেয়ে?সামান্য মোবাইল....এর জন্য....কার না কার জন্য....আমাকে এসব বললো?
সোহেল ভাঙ্গা গলায় কথাগুলো বলে বসে পড়লো।কিছুক্ষণ পর সিগারেট নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো।
মুনা ভাবতেও পারেনি আজকে এমন কিছু হবে।তৃপ্তিতে মন ভরে যাচ্ছে।এ ঘটনার পর সোহেলনার ভিনার সম্পর্ক কখনোই ঠিক হবে না।ভিনা আগে বলেনি কিছু,এখন আরো বলবে না।এভাবে বেশিদিন থাকতেও পারবে না,ঠিকি চলে যাবে।ভালো সময়ের শুরু হলো নিজের,ভাবতেই মুনার চোখ চকচক করে উঠলো।
•
প্রায় দশ বারোদিন হয়ে গেছে,সোহেল আর ভিনা কেউ কারো সাথে কথা বলে না।সোহেল মেয়ের জিদ আর ক্ষোভ দেখে মনে কষ্ট পুষে রেখেছে,ভিনার নিজের বাবার এমন আচরণে নিজেকে এতিম মনে হচ্ছে।পুরো বাসায় এমন গুমোট পরিবেশে হাপিয়ে উঠেছে দুজনই।এদিকে বাবা মেয়ের মৌনতাকে মুনা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পিছপা হয়নি।কোনোভাবেই যেন এই সম্পর্ক ঠিক না হয়,এর জন্য প্রতিদিন একটু একটু করে সোহেলের মন বিষিয়ে তুলছে।ভিনার বাড়ির কারো সাথেই কথা হয় না,মোমেনা খালা ছাড়া।যাবিরের সাথে কথা বলার জন্য বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে,কিন্তু মোবাইল নেই কোনো। বাসা থেকেও বের হতে পারছে,কারণ সোহেল নতুন লক লাগিয়ে নতুন চাবি এনেছে।প্রতিদিন জানালা দিয়ে বাইরে অপলক তাকিয়ে থাকে ভিনা,যদি যাবিরকে একবার হলেও দেখা যায়....এভাবে প্রথমদিকে কেঁদে সময় পার করলেও,এখন শুধু জানালার পাশে বসে থাকে।পড়ার বইগুলো ধরা হয় না,ভিনা জানে না কীভাবে বোর্ড এক্সাম পার করবে।তিন মাস পরে পরীক্ষা দেয়ার জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে নাকি,সে বিষয়েও সন্দিহান।দিন গুনে গুনে অনেকগুলো পার হয়েও গেলো।
-চা দিমু তোমারে?
-না খালা
-কিসু খাও ও তো না,একটু গরম ভাত দেই?
-কিছু লাগবে না খালা
-এমনে বইসে থাইকো না,তোমার মলিন চ্যাহারা দেইখা খুব কষ্ট হইতাসে আমার।
ভিনা মুচকি হাসলো,এরপর আবার বাইরে তাকিয়ে রইলো।ঠিক তখনি সোহেলের রুম থেকে মুনার চিৎকার শোনা গেলো।
.
.
.
চলবে.................................................