পরিণয়ে পরিপূরক - পর্ব ৩৬ - স্পৃহা নূর - ধারাবাহিক গল্প


আমাদের ছেলের নাম শুভ্রনীল রাখলে কেমন হয়? আর মেয়ে হলে শুভ্রা? আমি উনার বুকে মাথা রেখে বললাম হ্যা আমাদের অনাগত সন্তানের নাম হবে শুভ্রনীল সাখাওয়াত অথবা শুভ্রা সাখাওয়াত । "
'

অভ্র চমকে উঠে বলে, " কি বললে রেণু খালা শুভ্রনীল সাখাওয়াত? কোন শুভ্রনীল সাখাওয়াত?"
'
'
অবন্তী ওকে ইশারায় চুপ করতে বলে। এই মূহুর্তে রেণু খালার পুরো কথা শোনা জরুরি। নাম টা শুনে অবন্তী ও যে চমকে ওঠে নি তা নয়। 

" হ্যা আমার ছেলের নাম শুভ্রনীল সাখাওয়াত । আর ওর বাবার নাম সজীব সাখাওয়াত ।হ্যা, অভ্রনীল তোমার মতোই ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান আমার ও আছে। তবে ছেলের আমার পোড়া কপাল। বাপের আদর সোহাগ পেল না । জন্মের এক মাস ছাব্বিশ দিন আগেই বাপকে হারালো আমার ছেলে। উনি চলে যাবার পর আমার আর ঠাই হলো না ও বাড়িতে। অপয়া বলে বের করে দিল। আমি আবার ভাইয়েদের বোঝা হয়ে গেলাম। মা ও মারা গেছে আগের বছর। তারা সাফ সাফ বলে দিল আমার বাচ্চার বোঝা তারা নিতে পারবে না । দিন এনে দিন খাওয়া সংসার আমাদের। এর মধ্যে আরো দুজনের অন্নের জোগান তারা করতে পারবে না । চেহারা খুব একটা খারাপ ছিল না তার মধ্যে কম বয়সে বিধবা। গ্রামের অনেকেরই কু নজর পড়ল আমার ওপর । বড় ভাই ঠিক করলেন আমার আবার বিয়ে দেবেন। শুভ্র জন্মানোর পর বাবার বয়সী গ্রামের বুড়ো মোড়ল এর সাথে ঠিক হলো আমার দ্বিতীয় বিয়ে । আমি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হলাম। ভাইদের সংসারে থাকলে আমার ছেলের লেখাপড়া তো দূরের কথা দুবেলা ভাতও জুটবে না তা আমার বোঝা হয়ে গেছিল। আমি বিয়ের আগেই বলে দিয়েছিলাম আমার ছেলের দায়িত্ব নিলে তবেই আমি রাজি হবো বিয়েতে। তারা রাজিও হলো । শুভ্রর বয়স তখন চার মাস। বিয়ের দিন বিদায় এর সময় আমি শুভ্রকে কোলে নিয়েই গাড়িতে উঠলাম। বড় ভাবি আমার কোল থেকে ওকে নিয়ে নিল। বলল আজ রাত আমাদের কাছে থাক কাল বৌ ভাতের সময় দিয়ে আসব। আমি দিতে না চাইলেও জোর করেই ওরা শুভ্রকে নিয়ে নিল। ও বাড়িতে যাবার পর বুঝলাম আমার দ্বিতীয় স্বামী আমাকে শুধু শরীরের জন্যই বিয়ে করেছে। আর কিছুই না । পর দিন বৌ ভাতের সময় সে সাফ সাফ জানিয়ে দিল সে কোন উটকো ঝামেলার দায় নেবে না । তার আগের পক্ষেরই চার ছেলে মেয়ে । তার অন্যের ছেলের কোন দরকার নেই। তার আগের পক্ষের জোয়ান ছেলেরাও বলে দিল আমি নাকি সম্পত্তির ভাগ নিতে আমার ছেলে কে নিয়ে আসতে চাইছি। এসব নিয়ে অনেক অশান্তি হলো আমি তালাক চাইলাম তার কাছে । কিন্তু উনি দিলেন না তালাক। আমাকে সারাদিন ওবাড়ির কাজ করতে হতো আর রাতে নর পশুর চাহিদা মেটাতে হতো । পালাতে চেয়েছি বহুবার, পারিনি। এর মধ্যে খবর পেলাম শুভ্রর দাদার বাড়ির লোকেদের হ্ঠাৎ ওর ওপর ভালবাসা জন্মেছে। ওর দাদা দাদী এসে ওকে নিয়ে গেছে । মনে মনে একটু শান্তি পেলাম । ছেলেটার আমার তার নিজের বাড়িতে গতি হয়েছে। আড়াই বছর পর আমার এই স্বামী ও মারা গেল । ভিলেজ পলিটিকস এর রেশে খুন হন উনি। এবার আরো বেশি করে সবাই বলতে লাগল আমি অপয়া। উনার ছেলেরা আমাকে ও বাড়ি থেকে বের করে দিল। ভাবিরাও আর রাখতে রাজি হলো না আমার মতো অপয়াকে। সংসারে হানি আসবে ভেবে। আমি ভাবলাম চলে যাব অনেক দূর। ভাবলাম ছেলেকে গিয়ে চেয়ে আনব । ছেলেকে যেভাবে পারি নিজেই মানুষ করব। শুভ্র ততদিনে একটু বড় হয়েছে । হাটতে পারে, দৌড়তে পারে , বেশ টুকরো টুকরো কথাও বলতে পারে । আমি ওবাড়িতে গেলাম ওকে আনতে।ও আমাকে চিনতেই পারল না । আমি বললাম আমি তোমার মা । ওর কোন ভ্রূক্ষেপই নেই এ কথায়। 'মা' নামে আদৌ যে কোন বিষয় বস্তু আছে তা ই ও বোঝে নি সম্ভবত। আমার শাশুড়ি আমাকে যা তা বলে তারিয়ে দিল। বলল দুই স্বামীকে খেয়ে এবার আমি ছেলেকে খেতে এসেছি। আমি নিজেও আমাকে অপয়া ভাবতে শুরু করেছিলাম। আমিও ভাবলাম যদি আমার সাথে থেকে আমার ছেলেটারও ভালো মন্দ কিছু হয়ে যায় । অনেক দূর কোথাও চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাড়ি ফিরে কাপড় গোছগাছ করছিলাম । এর মাঝে চাচি মানে তনু আপার মা আসল আমাদের বাড়িতে । প্রায়ই বেড়াতে আসত আমাদের বাড়ি । একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে বাড়ি ফাকা তাই বাড়িতে ভালো লাগত না বলে পাড়া ঘুরে বেড়াতেন চাচি। গ্রামের প্রতিবেশি হিসেবে চাচি ডাকতাম। উনারা অনেক বড়লোক । সব কিছু শুনে উনি আমাকে জোর করে তার সাথে নিয়ে গেলেন। বলল আজ থেকে তুই আমার তনু। আমি ওখানে বেশ ছিলাম। চাচা চাচির দেখভাল করতাম। নতুন করে বাবা মা পেয়ে গেছিলাম । এরপর তনু আপার গর্ভে অভ্রনীল এলো । তার পরের কাহিনি তো জানোই আমি চলে এলাম এ বাড়িতে। চাচিই পাঠিয়েছিল তনু আপার দেখাশোনা করতে। অভ্রনীল আসার পর আমার শুভ্রনীল এর অভাব যেন ঘুচে গেল কিছুটা হলেও। অভ্রনীলের ছোট্ট ছোট্ট হাত গুলো আমাকে যখন আকড়ে ধরত আমি আমার শুভ্রনীলকে অনুভব করতাম। তনু আপা তো অসুস্থ ছিল আমিই ওর সব দেখভাল করতাম। সময় মতো খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, গোসল করানো, ওকে নিয়ে রোদ পোহানো, অসুখ বিসুখ হলে রাতের পর রাত কোলে করে নিয়ে বসে বসেই কাটিয়ে দিয়েছি, ওর আঙুল ধরে হাটতে শিখিয়েছি, কথা বলতে শিখিয়েছি। মোট কথা একজন নিজের মা যা দেখভাল করে আমিও অভ্রনীলের জন্য তা করতাম। সত্যি বলতে তনু আপা শুধু অভ্রনীলকে জন্মই দিয়েছিল মায়ের আর কোন দায়িত্ব সে পালন করে নি বা করতে পারে নি। আপা অসুস্থতার জন্যে ফিডিং করাতে পারত না । এদিকে অভ্রনীল বাজার থেকে কেনা কৌটোর দুধ মুখেও দেয় না । তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে ফিডিং করাতাম। আমি আমার শুভ্রনীল কে যা দিতে পারি নি আমার অভ্রনীল কে আমি তা দিয়েছি। আপা জানলে যদি রাগ করে তাই কাউকে কিছু বলিনি। কারণ আপা আমাকে তার বোনের মতো ভাবলেও অভ্রনীল আসার পর যখন শশুড় বাড়িতে তার আদর যত্ন বেড়ে গেল তখন আপার চোখে আমি তার 'বোনের' চেয়ে 'বাচ্চাদের আয়া' হয়ে বেশি উঠেছিলাম। কিন্ত একজন মায়ের সব দায়িত্ব তো আমিই পালন করে আসছিলাম। আপা আমাকে প্রায়ই বলত রেণু আমার প্রিয় রঙ নীল । আমার এই রাজপুত্তুর এর নামেও আমি নীল রাখব। আমি আপাকে একদিন বলেছিলাম আপা ওর নাম শুভ্রনীল রাখবে? আপা রাখল না । আপা তামাসা করল। বলল রেণু তোর ঐ কুচকুচে কালো ছেলের নামে হবে আমার এই ফুটফুটে লাল টুকটুকে ছেলের নাম? কি দেখে ওর নাম শুভ্রনীল রেখেছিস রে? ও তো নেভিব্লু কালার। আগেরবার গ্রামে গিয়ে দেখেছি তো আমি ওকে।আমার ছেলের নাম আমিই রাখব। আমার ছেলের নাম হবে অভ্রনীল । সেদিনই আমার আপার ওপর খুব রাগ হয়েছিল। আমার সন্তানকে নিয়ে তামাসা করার অধিকার অন্তত আপার নেই। আমার ছেলে ওর বাপের গায়ের রঙ পেয়েছে। শ্যাম বর্ণ, হ্যা মানছি আপা বা অভ্রনীলের চেয়ে বেশ চাপা রঙ। তবে মোটেও কুচকুচে কালো নয়। আর যদি কুচকুচে কালো ই হতো? তো? তাই বলে আপা এভাবে তামাসা করতে পারে না । পৃথিবীর সব মায়ের কাছে তার সন্তান সব চেয়ে সুন্দর। আমার কাছেও আমার শুভ্রনীল আর অভ্রনীলই সব চেয়ে সুন্দর । আপা বড়লোক এক বাপের এক মেয়ে, আবার বড়লোকের বৌ , চেহারায় অতি সুন্দরী ছিল বলে অহংকারের কোন কমতি ছিল না। অর্পি আর অভ্রনীল ওর মায়ের রঙ আর চেহারা পেলেও অর্নি পেয়েছে ওর মায়ের স্বভাব । অভ্রনীল আপার অতি আদুরে ছেলে ছিল তাই ওর সাথে কখনো খিটখিটে স্বভাবে আচরণ করত না , আর অভ্রনীল ওর মায়ের কাছে থেকেছেই বা কতক্ষণ। তাই ও জানে না ওর মায়ের সঠিক স্বভাব। ভাইজান ঠিক ই বলে আপা অর্নির মতো খিটখিটে, অহংকারী ছিল। তাছাড়া নিজের জিনিসের ভাগ কাউকেই দিতে চাইত না । ছোট থেকেই সব কিছু একা ভোগ করেছে, একা বড় হয়েছে নিজের জিনিস ভাগাভাগি করার মধ্যেই যে আসল আনন্দ তা বুঝতই না আপা। আমি চাইনি একটা মৃত মানুষের নামে নিন্দা করতে তাই সেদিন অবন্তী তোমাকে আপার নামে কোন বদনাম করি নি। কিন্তু আজ সব সত্যি যখন শুনতেই চাইছ আমিও দ্বিধা করব না। বলছি সব। আমি ধীরে ধীরে যতই অভ্রনীলকে আপন করে নিতাম নিজের ছেলে ভেবে নিতাম , শুভ্রনীল এর অভাব ওর মধ্যে মেটাতে চাইতাম, আপা ততই আমাকে ওর আয়া বানিয়ে রাখতে চাইত। আমি শুধু অভ্রনীলের মুখে মা ডাক শুনতে চেয়েছিলাম। অভ্রনীলের মুখে যখন একটু আধটু বুলি ফুটতে শুরু করল ও আমাকেই মা বলে ডাকতে শুরু করল। আমাকেই নিজের মা ভাবত ও। এতেও আপার আপত্তি। তার ছেলে আয়াকে কেন মা বলে ডাকবে? নিজের মা থাকতে অন্যকে কেন মা বলে ডাকবে? আমি বললাম, আপা একটু ডাকুক না আমায় মা বলে? সামান্য একটা মুখের বুলিই তো । আমি ওর মধ্যে আমার ছেলেটা কে খুজে পাই। আপা সাফ সাফ বলে দিল দিন দিন নাকি আমার চাওয়া বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমি যেন মনে রাখি আমি শুধুমাত্র আয়া। আরো অনেক অপমান করল আপা আমায় সেদিন। খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন। অভ্রনীলকে কোলে নিয়েই খুব কেদেছিলাম সারারাত। কাদতে কাদতেই বললাম আমাকে আর মা বলে ডাকবি না । ও তখন অবুঝ । সবে আধা আধা কথা বলে। ও কি আর বোঝে এসব নিষেধ? সারাদিন তোতা পাখির মতো আমাকেও মা মা বলে ডাকত, আপাকেও ডাকত । আর আপা আমার ওপর রাগ করত। এভাবেই দিন যেতে থাকল। অভ্রনীলও একটু বড় হলো । আপাও একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছিল।
এদিকে অভ্রনীলের এই মা ডাক শুনতে শুনতে একদিন খুব ইচ্ছে হলো আমার শুভ্রনীলকে একবার দেখার। পরের দিন আপাকে বললাম, আপা আমি একবার বাড়ি যাব শুভ্রকে দেখতে। আপা বলল কবে যাবি? আমি বললাম আজ যেতে দিলে আজই । আপা বলল, আজ কাল আর যাস না । একা একা বাস ধরে যাবি দূরের পথ। তার চেয়ে বরং পরশু যাস তোর ভাইজানের সাথে বাড়ির গাড়িতেই। তোর ভাইজান জমিজমার কাজে পরশু যাবে আমাদের বাড়ি । তুই আব্বা আম্মাকেও দেখে আসিস সাথে শুভ্রকেও। আব্বা আম্মা দেখতে চায় প্রায়ই তোকে। আপা আবার এসব বিষয়ে খুব ভালো ছিল। একা একা গেলে বিপদ ঘটতে পারে, তাই আমাকে একা দূরে কোথাও যেতে দিত না । আমার এ বাড়িতেও যেন কোন অসুবিধে না হয় সে বিষয়েও খেয়াল রাখত। এ বাড়ির চাকর বাকরদের মোটামুটি আমার কথা মেনে চলতে হতো । আপা সে অধিকার ও আমাকে দিয়েছিল। যাই হোক, আমাদের যাবার কথা শুনে অর্পি অর্নি ও জেদ ধরল নানা বাড়ি যাবে। আপা অসুস্থ তাই আপা তো যেতে পারে না বহু দিন।তাই ওদের ও যাওয়া হয় নি বহু দিন। চাচা চাচি শুনে অভ্রনীলকেও ওদের সাথে নিয়ে যেতে বলল। তিন নাতি নাতনিকে এক সাথে দেখতে চায়। চাচা চাচির ছেলে ছিল না ভাইজান একমাত্র জামাই হওয়ায় জমিজমার দিক ভাইজানই দেখাশুনা করত। তাই ভাইজানকে প্রায়ই যেতে হতো । তো ওখানে পৌছেই আমি শুভ্রনীল কে দেখতে চলে গেলাম। চাচা ভাইজানের সাথে ব্যাস্ত। চাচি অর্পি অর্নিকে নিয়ে ব্যাস্ত, আর অভ্রনীল ছোট হলে কি হবে যে পরিমান জ্বালাতন আর দুষ্টুমি করত এই বয়সে চাচি ওকে সামলাতেও পারবে না । তাই আমি অভ্রনীলকে কোলে করেই নিয়ে গেলাম পাশের গ্রামে আমার শশুড় বাড়িতে । গিয়ে শুভ্রনীলকে দেখলাম বাড়ির আঙিনায় খেলছে অন্য বন্ধুদের সাথে । বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা হয়েছে । বাবার মতোই চেহারা পেয়েছে। আমি আড়াল থেকে ওকে দেখতে চেয়েছিলাম । কিন্তু ছেলেকে এতদিন পর দেখে আর আড়ালে থাকতে পারি নি। কাছে গিয়ে ওর গালে চোখে যে কতগুলো চুমু খেয়েছি হিসেব নেই। ততক্ষণ শুভ্র আমার দিকে হা করে চেয়ে রইল। এসব দেখে অভ্র ভাঙা ভাঙা কথায় বলল'' মা আমাকেও আদর দাও'' তারপর ওকেও আদর করছিলাম ।
হঠাৎ শুভ্র বলল "তুমি কে?"
আমি বললাম '' আমি তোমার মা শুভ্রনীল।আমাকে একবার মা বলে ডাকো । '' 
ও অভ্রকে ইশারা করে দেখিয়ে বলল,'' তুমি আমার মা? তাহলে ও তো তোমায় মা বলে ডাকল। তুমি তো ওর মা । ''
'' আমি ওর ও মা তোমারও মা। ও তোমার ভাই। তুমি জানো ওর নাম আর তোমার নামে কত মিল। তোমার নাম শুভ্রনীল ওর নাম অভ্রনীল । ''
অভ্র ছোট বেলা থেকেই মিশুকে স্বভাবের ছিল নতুন মানুষ দেখলে খুব মজা পেত তার কোলে যেতে চাইত। ও শুভ্রর হাত ধরে, গেঞ্জি ধরে টানতে শুরু করল। আমি বুঝলাম ও ওর সাথে খেলতে চাইছে বা কোলে উঠতে চাইছে। শুভ্রকে বললাম তোমার ছোট ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলো বা খেলো । ও খেলতে চাইছে তোমার সাথে । শুভ্র আমাদের দিকে আবার কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর বাড়ির ভেতর গিয়ে ওর দাদীকে ডেকে আনল। ব্যাস আম্মা এসে আবার শুরু করলেন আমি কেন এসেছি, এতদিন পর কি চাই, কোলে অভ্রনীলকে দেখে উনিও জিজ্ঞেস করলেন ও কে? আমি উত্তর দেবার আগেই শুভ্র উত্তর দিল মায়ের নতুন ছেলে ও। আমি কথা ভাঙিয়ে দেবার আগেই আম্মা অভ্রনীলকে জিজ্ঞেস করতেই ও আবার তোতা পাখির মতো বলতে শুরু করল '' এটা আমার মা '' আমি বারবার বললাম ও তনু আপার ছেলে। আমাকেও মা বলে ডাকে। কে শোনে কার কথা । ''ছোট বাচ্চারাই নাকি সত্য কথা বলে'' এই নীতিতে আজীবন বিশ্বাসী বাঙালি। ঐ দুটো ছোট মানুষের কথা শুনেই সবাই ধরে নিল অভ্রনীল আমার ছেলে, আমি আবার বিয়ে করেছি। এক হিসেবে অভ্রনীল শুভ্রনীলের ভাই ই তো হয় তাই না? আমি সেজন্যই শুভ্রকে বলেছিলাম ও তোমার ভাই। ও ছোট মানুষ কি বুঝতে কি বুঝে নিয়েছে । আর অভ্রতো মা বলেই ডাকে। আম্মার সাথে এবিষয়ে কিছুটা কথা কাটাকাটি হতেই গ্রামের লোকজন জড়ো হতে শুরু করল। আমি চাইনি এ বিষয় নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করতে। অভ্রনীলকে নিয়ে চলে আসি আমি।আর গ্রামের ব্যপার তো বোঝই তিল কে তাল বানাতে ওস্তাদ সবাই। আর গ্রামে কোন একটা খবর বাতাসের আগে মানুষের কানে পৌছে। অভ্রনীল আমকে মা বলে ডাকে এটা চাচার বাড়িতেও কাজের লোকেরা লক্ষ্য করেছিল। ব্যাস এবার রটে গেল তনু আপার ছেলে হচ্ছিল না তাই হয়ত ভাইজান আমাকে আবার বিয়ে করেছে গোপনে আর অভ্রনীল আমাদেরই ছেলে। কিন্তু ফ্যামিলি রেপুটেশন এর জন্য এসব প্রকাশ না করে আমরা নাকি বলছি ও তনু আপার ছেলে। এসব শুনে চাচি আমাদের সেদিনই এখানে ফিরে আসতে বললেন। ভাইজানের কানে এসব গেলে উনি হয়ত রেগে যেত আমাকে নিয়ে আর ফিরতে চাইতেন না । কিন্তু আমি না থাকলে আপার আর বাচ্চাদের দেখভাল কে করবে। আসলে চাচি আমার মতো অন্য কারোর প্রতি আস্থা পেতেন না । তাই চাচি ভাইজানের কানে এসব আসার আগেই অন্য কথার ছলে আমাদের বাড়ি পাঠান । বাড়ি ফেরার পর আপা আমাকে সেদিন প্রথম থাপ্পড় মারে। চাচি আপাকে ব্যাপারটা টেলিফোনে বলেছিল। আপা বলল ''আরো শেখা মা ডাকতে। আমার ছেলের দখল তো নিয়েই নিয়েছিস। এখন এসব রটিয়ে আমার স্বামীর ভাগ ও নিতে চাস? দু দুটো স্বামীতে হয় নি তোর? এখন আরো একটা চাই? আমার স্বামীকে যতই হাত করার চেষ্টা করিস না কেন ও আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসবে না কোনদিন বুঝলি? '' আমি ভাবতেও পারিনি আপা আমাকে এতটা নীচ ভাববে। অভ্রকে কড়া করে নিষেধ করে দিল আমাকে আর মা বলে না ডাকতে । রাগ আমার সেদিন ও হলো প্রচন্ড আপার ওপর । অভ্রনীলকে শেখালাম সবার সামনে আমাকে মা বলে না ডাকতে। সবার অগোচরে ডাকতে।তবে আপা যেকোনো বিষয় খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যেত মানে কারো ওপর বেশিদিন রাগ করে থাকতে পারত না । মিটিয়ে নিত। আমার সাথেও মিটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আমি পারিনি । এরপর আপা দিন দিন যতই সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল ততই বাচ্চাদের দায়িত্ব নিজে নিতে লাগল বিশেষ করে অভ্রনীলের।আমি লক্ষ্য করলাম ধীরে ধীরে আমার কাছে খুব একটা ঘেষতেই দিচ্ছে না ওকে। কিন্তু আমার তো ওকেই চাই।আমি শুভ্রনীল কে আমার কাছে পাই নি। অভ্রনীলকে পেয়েও হারাতে চাই নি আমি। অভ্রনীলের আমার প্রতি বেশি টান দেখে আপার ধারনা আমি তার ছেলেকে দখল করে নিতে চাইছি। অভ্রনীল ছোট মানুষ কথায় কথায় একদিন ওর মাকে বলে ফেলল আমি ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে মা ডাকতে বলেছি। আপা সেদিন ওকে তার মাথা ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করে নিল আমাকে যেন সব সময় রেণু খালা বলেই ডাকে। মাথা ছুয়ে বলেছে এ প্রতিজ্ঞা ভাঙলে মা মারা যাবে এমন ভয় দেখালো। ও ছোট মানুষ এটাই বিশ্বাস করে নিল । আমি বারবার বলি আমার কাছে এসো, মা বলে ডাকো । ও আর আসে না । আমাকে মা বলেও ডাকে না । রেণু খালা বলতে শুরু করল। এই ডাক যতবার শুনতাম ততবার ই আমার আপার ওপর রাগ হতো । কি এমন হতো একটা ডাক ই তো? ডাকতে দিলে কি খুব ক্ষতি হতো? আর সত্যি বলতে আমিই তো ওর মায়ের কোন অংশে কম না বরং বেশিই। ওর নিজের মায়ের চেয়ে আমি ওর দায়িত্ব বেশি পালন করে এসেছি। আপার কি কোন কৃতজ্ঞতা বোধ বলেও কিছু কাজ করে না আমার ওপর ? এত কিছুর পরও আমি কি শুধুই আয়া ছিলাম? এরপর আপা আরো সুস্থ হবার পর আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে চাইল। বলল এখানে তো তোর আর কোন কাজ নেই। বাচ্চাদের আমিই দেখতে পারব এখন। তুই বরং বাড়ি ফিরে যা । আব্বা আম্মার দেখভাল কর। আমি আপার পায়ে পড়লাম। বললাম অভ্রনীলকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না । অভ্রনীলই আমার একমাত্র বাচার অবলম্বন।শুভ্রকেও ওরা আমায় দেবে না । শুভ্র নিজেও আমার কাছে আসবে না । আমি ঐ ঘটনার পরও দু এক বার শুভ্রকে দেখতে গেছি। ও আমাকে একদম পছন্দ করে না । ওর মাথায় সবাই ঢুকিয়ে দিয়েছে আমি খারাপ, লোভী। টাকার লোভে ওকে ছেড়ে গিয়েছি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি এক ছেলেকে হারিয়েছি অন্য ছেলেকেও এভাবে হারাতে পারি না । এ জন্য আমাকে যে সিদ্ধান্ত নিতে হয় নেব আমি। অভ্রনীল আমারই ছেলে। জন্ম দিই নি তো কি হয়েছে ও আমারই ছেলে। আপা স্বামী সোহাগ নিয়েও খুব অহংকার করত। ভাগ্য করে এমন স্বামী পেয়েছে এত বছর আপা অসুস্থ ছিল তাও দ্বিতীয় বিয়ে করে নি। এসব আমায় প্রায়ই খুচিয়ে খুচিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বলত। কেননা আপা ভেবেছিল আমি গ্রামে ওরকম একটা রটনা রটিয়ে ভাইজানের ও ভাগ নিতে চেয়েছিলাম অর্থ্যাৎ উনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম,হয়ত আমি ভাইজানের প্রতি দুর্বল। কি হাস্যকর ভাবনা আপার তাই না? আমি আমার জীবনে শুভ্রর বাবা ছাড়া কাউকে ভাবতেও পারিনি । আমার দ্বিতীয় স্বামীকেও না । সেখানে আমি যাকে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করি তাকে নিয়ে সন্দেহ? আমি প্রথম অস্ত্রও এটাই করে নিলাম । আমি আপার কানে ধীরে ধীরে ভাইজানের নামেই বিষ ঢাললাম । ভাইজান এত রাত করে কেন বাড়ি ফেরে, শুধু কি কাজেরই চাপ নাকি অন্যকিছু । আর এরা তো জমিদার বংশ। এদের রক্তেই আছে মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি। মাঝে মধ্যেই ভাইজান কেন মদ খেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, শুধুই কি পার্টি থাকে?এসব বোঝাতে শুরু করলাম আপাকে। আপাকে এ ও বোঝালাম তুমি এত বছর অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলে আর ভাইজান পুরুষ মানুষ চাহিদা বেশি । অন্য কোন মেয়েতে আসক্ত হওয়া এমন কোন অস্বাভাবিক বিষয় না । ব্যাস এসব শুনে সুখের সংসারে আগুন লেগে গেল । প্রায়ই ঝগড়া রাগারাগি হতে শুরু করল ওদের। ভাইজান রাগ করত অযথা ভুল বোঝার জন্য আর আপার ব্রেইন তো আমি ওয়াশ করেই দিয়েছিলাম ঐ একি যুক্তি দেখাতো। শেষ দিনে তো ভাইজান সহ্য করতে না পেরে গায়েই হাত তুলেছিল আপার। আমি বুঝলাম এটাই মোক্ষম সুযোগ। এর পরের দিন কিছু করলে দোষ ভাইজানের ওপর পড়বে। পুলিশ ভাইজানকেই আগে সন্দেহ করবে কেননা আগের রাতেই গায়ে হাত তুলেছে । ঝগড়াও অনেক দিন ধরে। কিন্তু ভেজাল শুরু করল অভ্রনীল । হ্ঠাৎ স্কুলে যাবে না বলে জেদ শুরু করল। আপার ও মন মেজাজ খারাপ থাকায় ওর ওপর হাত তুলল। ওর আরো জেদ স্কুলে যাবে না । আমি বুঝতে পারলাম এটা তো আরো ভালো সুযোগ। কারণ আমি জানতাম সেদিন ওর স্কুলের ফিস দেয়ার ডেট।ও না গেলে আপা আমাকেই পাঠাবে। আর আমি বাড়ি না থাকলে আমার প্রতি সন্দেহের কোন প্রশ্নই ওঠে না । আমি অভ্রনীলের হরলিক্সে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ওকে খাইয়ে দিলাম । তারপর আপার থেকে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু গোরস্থানের ঐ দিক দিয়ে পেছন গেট দিয়ে আবার ফিরে এলাম। আমি জানতাম আপা রান্নাঘরে ঢুকবে। কারণ আপা রান্না করতে পছন্দ করত। আর ছেলেমেয়েকে কোন কারণে শাসন করলে ওদের পছন্দের খাবার তখনই রান্না করে দিত। আদর করে নিজেই তুলে খাওয়াতো তারপর । তাই আমি গ্যাসের লাইন আগেই লিক করে রেখেছিলাম । পরের বার ঢুকে শুধু আস্তে করে কিচেন এর দরজা বাইরে থেকে লক করে দিয়েছিলাম। তারপর বেরিয়ে আবার পেছন দরজা দিয়ে চলে গেলাম অভ্রনীলের স্কুলে । ব্যাস এরপর সব শেষ ! আমি অপাকে চাইলে অন্যভাবেও মারতে পারতাম। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম যে রুপ নিয়ে আপার অস্বাভাবিক অহংকার সে রুপই শেষ করে দিতে । আমার ছেলেকে কুচকুচে কালো বলে তামাসা করেছিল তাই না? মৃত্যুর আগে নিজে কয়লার মতো কালো হয়ে গেছিল। নিজের ছেলে অভ্রনীলই দেখে ভয় পেয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছিল। আপার প্রতি দিনে দিনে টুকরো টুকরো রাগ গুলোই আমার কাছে দাবানল হয়ে উঠেছিল । আমি তো খুব বেশি কিছু চাই নি। ছেলের একটু ভাগই তো চেয়েছিলাম । ''
'
অবন্তী বিড় বিড় করে বলে, ''এরই নাম বুঝি রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার!!''
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন