ঘরের কাপড়েই বেড়িয়ে এসেছিলো ভিনা।টিউশনির টাকা আর প্রয়োজনীয় সবকিছু স্যুটকেসেই ছিলো।ছোট ফোনে চার্জ নেই,বন্ধ হয়ে গেছে।যাবিরকে অনেকক্ষণ আগে ফোন দিয়েছিলো।পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোন বন্ধ হয়ে গেছে।খুব সম্ভবত রাত দশটা বাজে। ও কথা বুঝেছিলো ছিলো নাকি জানে না,কথা বুঝে থাকলেও,আসবে নাকি,তাও জানে না।একজন ব্যাচেলর ছেলের পক্ষে হুট করে একটা মেয়ের থাকার ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সেটা আরো কঠিন হয়ে যায় খুব ছোট ফ্রেন্ড সার্কেল থাকলে।যদি যাবির না পারে,তাহলে কলোনির পুকুর পাড়ে রাতটা থেকে সকালে কিছু একটা ব্যবস্থা করবে। রুপিনের কথা মাথায় আনছে না।রুপিনকে কোনো কিছুর ব্যখ্যা দেয়ার ইচ্ছা নেই।তার চেয়ে বড় নিজের বাবাকে কেন যেন ছোট করতে চাচ্ছে না ভিনা।সৎ মা ওর বাবাকে বশ করে ফেলেছে,এটা বলে সিম্প্যাথি পাওয়ার কোনো অর্থ নেই। তাছাড়া রুপিন ব্যস্ত মানুষ, হটাৎ নিজের দায়িত্ব তার উপরে দেয়া উচিৎ হবে বলে মনে করে না ভিনা।গার্ড বারবার আশেপাশে ঘুরছে।চারবার জিজ্ঞেস ও করে ফেলেছে কোন বাসায় যাবে,কার বাসায় যাবে।ভিনা বুঝতে পারছে যে বেশিক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না।ভারি দুইটা লাগেজের দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে গেলো। সেসময় যাবির এসে ভিনার হাত ধরলো-
-রিয়েলি স্যরি ভিনা!বাট মা বাসায়,বুঝতেই পারছো।
-ইটস ওকে।
ভিনার সাথে থাকা লাগেজ দেখে যাবির কিছুটা হকচকিয়ে গেলো-
-ডোন্ট সে কথা না বলেই বাসা থেকে বের হয়ে গেছো!
-বের করে দিয়েছে.....
ভিনা মাথা নিচু করে রাখলো।নিজের এই অসহায়ত্বে সে নিজেই লজ্জিত।যাবির ভিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে,কপালে চুমু দিলো।ভিনা এবার পাগলের মত কাঁদা শুরু করলো।
-ছি!এভাবে কাঁদে না!জীবন এমনই হয় ভিনা।
-হয় না!সবার জীবন এমন হয় না যাবির।কারো জীবন খুউউউউব সাজানো থাকে!!বিশ্বাস করো,কথার জীবন এমন না!নওমির জীবন এমন না।নওমির মা নিজের মেয়ের জন্য ঢাল হয়ে থাকে।আমার কেন এমন?
-কারণ তুমি ওদের চেয়ে অনেক বড় হবে একদিন।
-এর জন্য যে বেঁচে থাকতে হবে....কীভাবে বেঁচে থাকবো?এই রাত কোথায় থাকবো সেটাই জানি না আমি,জীবন তো অনেক দীর্ঘ আমার জন্য....
-কোনো পরিচিত কেউ আছে?
ভিনা চুপ করে থাকলো।
-ভিনা?
-নেই যাবির....
-রাত পৌনে এগারোটা বাজে।শীত পড়েছে অনেক।আসো আমার সাথে।
ভিনা প্রাণহীন পুতুলের মত আচরণ করছে।ভিনা নিজেও বুঝতে পারছে না বিনা অপরাধে নিজের বাবার কাছে চরম অপমানিত হয়ে একজন প্রায় অচেনা করে রাখা ছেলের সাথে রাত এগারোটায় তার বাসায় যাওয়াটা কতখানি যৌক্তিক।যুক্তি দিয়ে ভাবতে পারছে না,চাচ্ছেও না।যুক্তি দিয়ে কী হবে,যেখানে বিবেক অন্ধ,অনুভূতি শূণ্য,ভালোবাসা ফিকে।
যাবির খুব সাবধানে গেট খুলে ভিনাকে নিজের রুমে নিয়ে গেলো।এরপর একটা করে লাগেজ ঘরে এনে রাখলো।পুরো কাজ করতে প্রায় আধা ঘন্টা সময় লাগলো।
ভিনার ঠোঁট একপাশে কেটে গেছে।গালে মারের দাগ স্পষ্ট। চুলগুলো এলোমেলো, দৃষ্টিও।যাবির দরজা আটকিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিলো।
-ঘরে লাইট জ্বালানো থাকলে মা আসতে পারে।
ভিনা কিছু বললো না। যাবির এক গ্লাস পানি আর আপেল নিয়ে ভিনার পাশে বসলো।
-তোমার বাবা তোমার খোঁজ করবে না?
-না....
-করবে ভিনা। বাবারা মেয়েদের এভাবে ছাড়তে পারে না।
-পারে।যখন দ্বিতীয় স্ত্রী আসে তখন পারে।
-ভুল মানুষের হয়।সে যদি খোঁজ নেয় কী বলবে ভেবে রেখেছো?
-না....প্রয়োজন পরবে না।আমি ঐ বাড়িতে কখনো ফিরবো না যাবির। কখনো না!
-এইচএসসি তোমার এটেন্ড করতেই হবে।একবার পিছিয়ে পড়লে আর আগানো সম্ভব হবে না।
-বেঁচে থাকবো নাকি জানি না।সুইসাইডের প্রয়োজন হবে না,আমি একদিন প্রচন্ড বুক ভার নিয়ে মারা যাবো।কেউ আমার জানাযায় ও আসবে না।চিন্তা করো,আমাকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হবে।আমার বাবা কখনো খোঁজ পাবে না।আমার জন্য কখনো শূণ্যতাও অনুভব করবে না,কারণ আরেকটা বাচ্চা হবে তার।চিন্তা করে দেখো,আমার অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই এখন!
-ফালতু কথা বলবা না ভিনা।একদম চুপচাপ শুয়ে পরো।
-শুবো না।আমার কথা তোমার শুনতে হবে যাবির!
-বলো,শুনছি।
-আমাকে মেরে ফেলো প্লিজ!
যাবির ভিনাকে বুকে জড়িয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে।ভিনা বিড়বিড় করে বললো,আমার ভালোবাসা চাই,অনেক ভালোবাসা।
•
শুধুমাত্র শিউলি মারা যাওয়ার দিন সোহেল কান্না করেছিলো। এরপর জীবনে অনেক খারাপ সময় এসেছে,কিন্তু কখনো নিজেকে ভাঙতে দেয়নি।আজকে যখন মুনা বললো,ভিনা অন্য ছেলের সাথে চলে যাবে,তখন মনে হলো এই জীবন ব্যর্থ।শিউলির মেয়ে কখনোই এমন করতে পারে না।দ্বিতীয় বিয়ে করলেও সে তো সবসময় ভিনাকেই প্রায়োরিটি দিত।ভিনা যেন মায়ের আদর পায়,এর জন্যই তো মুনার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিলো।সেই ভিনাই নিজের বাবার কথা ভাবলো না?
-সিগারেট খাওয়া বন্ধ করবে?জানো না প্রেগন্যান্সিতে এটা কত খারাপ?
সোহেল উত্তর দিলো না,হাত থেকে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ফেলে দিলো।
-রুপিন কে ফোন দিয়েছিলে?
-হ্যাঁ.....ভিনা ওখানে যায়নি।তুমি কী ভাবো?আমি বানিয়ে বলেছি?ভিনা আসলেই কোনো ছেলের কাছে চলে গেছে।
কথাগুলো সোহেলের বুক এফোড় ওফোঁড় করে দিলো।বাবা হয়ে মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার কথা শোনা কতটা যন্ত্রণাদায়ক,সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।একমাত্র বাবারাই জানে,মেয়ে যখন অন্য ছেলেকে তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করে ঘর ছাড়ে,তখন মৃত্যুর যন্ত্রণাও কম মনে হয়।অনেক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকও ধুলোর মত তুচ্ছ হয়ে যায়।তবুও সোহেল নিজেকে সামলে নিলো,নিজের দূর্বলতা মুনার কাছে প্রকাশ হতে দিলো না।ভারি গলায় বললো
-ছেলের কোনো খোঁজ খবর জানো?
-কীভাবে জানবো?আমি ওর গোয়েন্দাগিরি করেছি নাকি?
-না করে থাকলে এটা জানলে কীভাবে যে ভিনা কোনো সম্পর্কে আছে?
-চোখে যা পড়েছে তাই বলেছি।অত গভীরে ভেবেছি নাকি?গয়না চুরির হওয়ার পর চোখে চোখে রেখেছিলাম।
-গয়না চুরি করলো কীভাবে?
-সেটা তো ঐ জানে। বড় ছোট কিছু মানত নাকি ও?একদিন ঘর ভিড়িয়ে একটু শুয়েছি,হুট করে এসে জিনিসপত্র হাতাহাতি শুরু করলো।জিজ্ঞেস করায় উল্টো কথা শোনালো যে এটা নাকি ওর মার ঘর,যা খুশি করতে পারে।এরপর কখনো ঘর আটকায়নি,আসলেও কিছু বলিনি। এতটুক মেয়ে থেকে কড়া কথা শোনার শখ ছিলো না।
-ওর কাছে তো কোনো ফোন থাকার কথা না।
-মোমেনাকে কি এমনি বের করে দিতে বলেছি?মোমেনার ফোন দিয়েই হয়ত সব করত।
-মোমেনা গেছে দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে।
-মোমেনাই ফোন কিনে দিয়েছে হয়ত।যেই মেয়ে গয়না চুরি করতে পারে,সেই মেয়ে নিশ্চয়ই টাকাও চুরি করতে পারবে। চুমকি তো শুনেছিলো কার সাথে যেন কথা বলতে.....ঐ ছেলে নাকি বলেছিলো তোমার সাথে....
মুনা সাথে সাথে চুপ করে গেলো।মুখ ফসকে সত্যি কথা বের হয়ে গেলে আজকে কেলেঙ্কারিই হয়ে যেত। যা চেয়েছিলো তা তো হয়েছিই।এখন চুপ থাকাই শ্রেয়।
-কী হলো?বলো কী বলেছে চুমকি?
-বলেছে যে ঐ ছেলে নাকি বলেছে তোমার অনেক টাকা পয়সা,কিছু সড়ায় নিয়ে আসতে।
-চুমকি কীভাবে শুনলো এসব?
-ঐত,মানে,ভিনার কথা শুনে মনে হয়েছে আরকি।
-এত চতুর মেয়ে ঘরে ঢুকিয়েছো কেন?যেখানে সেখানে কান পেতে পাড়ায় পাড়ায় রটায় বেড়াবে,খুব ভালো হবে?
-আম্মাকে বলেছি।নতুন কাজের মানুষ আসলেই এটাকে বিদায় করবো।
-হুম....যাও এখন,রেস্ট নাও।
মুনা গেট চাপিয়ে চলে আসলো।সোহেলের রাগ দেখে বেশ ভয়ই পেয়েছে।যে মানুষ নিজের কলিজার টুকরা মেয়েকে মেরে ঘর থেকে বের করে দেয়,সে যদি কোনোভাবে মুনার এসব সুক্ষ্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পারে,তাহলে খুব খারাপ হবে।পরক্ষণেই মনে হলো প্রেগন্যান্ট অবস্থায় আর যা হোক এমন করবে না সোহেল।এছাড়াও শাশুড়ি কে নিজের সাথেই রেখেছে মুনা।সাত পাঁচ ভেবে নিজের ঘরে ঢুকতেই মনে পড়লো গয়নাগুলো নেয়া হয়নি ভিনার কাছ থেকে।যদিও মাথায় রেখেছিলো ঝামেলা চলাকালীন সময়ে গয়নাগুলো নিয়ে নেয়ার।
ধ্যাৎ! রাগে আলমারির দরজা ঠাশ করে লাগিয়ে দিলো মুনা।যতই চেষ্টা করুক,কিছু না কিছু ত্রুটি থেকেই যায়!
.
.
.
চলবে..............................................