অবন্তী বিড় বিড় করে বলে, ''এরই নাম বুঝি রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার!!'
'
অভ্র এসব শুনে না তাকায় অবন্তীর দিকে না তাকায় রেণু খালার দিকে। তাকাতে চাইলেও পারে না আসলে। মেঝের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রয়। বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। কার প্রতি রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি নাকি রেণু খালার প্রতি তা সে বুঝতে পারে না । সমস্ত রাগ যেন ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বের করতে চায় সে। বুড়ো আঙুল দিয়ে বার বার মেঝেতে আকি বুকি করতে শুরু করে । হয়ত কিছু লিখতেও শুরু করে ।
'
অবন্তী ওর হাত ধরতে চাইলে নিশব্দে ছাড়িয়ে নেয় ।
রেণু খালা এগিয়ে এসে অভ্রনীলের কপাল বেয়ে পড়া ঘাম শাড়ির আচল দিয়ে মুছতে মুছতে বলে,
''বলো অভ্রনীল আমি কি কোন ভুল করেছি? নিজের জিনিসের অধিকার কেউ না দিতে চাইলে তা তো ছিনিয়েই নিতে হবে তাই না? আমি আগের বার আমার অধিকার ছেড়ে দিয়েছি। আমার শুভ্রনীলের অধিকার আমাকে ছাড়তে হয়েছে । আমি বার বার আমার অধিকার কেন ছাড়ব বলো তো? আমি কি মানুষ না? শুধু দিয়েই যাব? নিজের সন্তান , নিজের দেহ, আর সব শেষে আমার শেষ অবলম্বন আমার শেষ সম্পদ তোমাকেও। কিছু পাবার অধিকার কি আমার নেই? তনু আপা কেন কেড়ে নিতে চাইত তোমাকে বার বার । তনু আপার চেয়ে আমার অধিকার তোমার ওপর অনেক গুনে বেশি। আমি একদিনে এমন হই নি অভ্রনীল । সব হারানো পথিক তার শেষ সম্বলটুকু নিজের সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখতে চায়। অভ্রনীল বাবা আমার তাকা একবার আমার দিকে''
'
'
অভ্র পাথরের মতো নিশ্চুপ বসে থাকে। চোখ তুলে একবারও তাকায় না । রেণু খালা ওর গালে কপালে হাজার চুমু আকে। রেণু খালা আবার বলে,
'' অভ্রনীল, অভ্রনীল কথা বলো । আমি ঠিক করেছি তাই না? বলো অভ্রনীল ।"
'
'
অবন্তী বুঝতে পারে অভ্র কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। এতকিছু শোনার পর যেধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত তার কোন কিছুই সে দেখাচ্ছে না । মেঝের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে তো আছেই। এদিকে শুভ্র'র ব্যাপার রেণু খালা এখনো জানে না । কি করে বলবে তাকে শুভ্রর কথা!
অবন্তী অভ্রর হাত দু হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু অভ্র আবার হাত ছাড়িয়ে নেয়। দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় নিজের ঘরে। বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে। স্মিত স্বরে বলে,
'
'' রেণু খালা !''
রেনু খালা দৌড়ে এগিয়ে যায় তার দিকে,'' কি হয়েছে বাপ আমার? এমন দেখাচ্ছে কেন? পুরো ঘেমে নেয়ে উঠেছ যে!''
'' তুমি জীবনে কিছুই পাও নি তাই না?"
'' কে বলেছে কিছুই পাই নি? তোমাকে পেয়েছি তো ! আর যেখানেই থাকুক যত দূরেই থাকুক আমার শুভ্রনীল ও আছে তো !''
'' আমার তোমাকে কিছু দেবার আছে।''
'' কি?"
'' এই যে তোমার প্রিয় বকুল। শুকিয়ে গেছে কিন্তু এর সুঘ্রাণ একটুও নষ্ট হয় নি দেখো । ''
'' এসময়ে এ ফুল কোথায় পেলে?"
'' তোমার ছেলের কাছে ।''
'' মানে?"
'' আমি তো তোমার ছেলের যেটুকু আমানত আমার কাছে ছিল তা ফিরিয়ে দিলাম । এখন তুমি আমার মাকে ফিরিয়ে দাও। আমার মায়ের সবটুকু না পারো কিছু অন্তত ফিরয়ে দাও।''
'' কি সব বলছ অভ্রনীল?''
'
'' হুম। দেবে না? কেন দেবে না শুনি? আমি তো ফেরত দিলাম । তুমি কেন দেবে না শুনি? আমার বাবা আমাকে ছোট বেলায় ভুল বুঝেছিল, আমি বাবাকে বড় হয়ে ভুল বুঝেছি, অর্নি আমাকে এখনো ভুল বোঝে ও আমাকে এই ব্যাপারটার জন্য কত ঘৃণা করে। আমিও ওকে পছন্দ করি না । আমার থেকে এভাবে তুমি ধীরে ধীরে সবাইকে দূরে সরিয়েছ । তুমিই তো আমাকে বুঝিয়েছিলে তাই না যে, লক খুলতে না পেরে বাড়িতে কেউ ছিল না বলে আমি বাবাকে যখন কয়েকবার ফোন করেছিলাম বাবা কেন সেদিন টেলিফোন রিসিভ করে নি। তুমি বলেছিলে বাবা ইচ্ছে করেই রিসিভ করে নি হয়ত। আমি বাবাকে বার বার জিজ্ঞেস করতাম বাবা বার বার বলত বাবা সত্যিই মিটিং এ ছিল । কিন্তু আমি বাবাকে কোন দিনও বিশ্বাস করি নি। আমি বিশ্বাস করেছি শুধু তোমাকে। আমার বাবার বাইরে অন্য কারো সাথে সম্পর্ক ছিল আর সেই সম্পর্কের জেরেই মার সাথে ঝগড়া আর সেই জের ধরেই মাকে বাবা মেরে ফেলে আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে এ ধরনের কথার ইঙ্গিত তুমি আমাকে দিতে না বলো? আমি শুধু তোমাকে বিশ্বাস করেছি। শুধু তোমাকে। অর্নি প্রায়ই আমাকে বলত তুমি নাকি আমার মাথা খাও। আমাকে উল্টো পাল্টা বোঝাও। আমি ওর কথা কানেই নিতাম না । ''
'
'
এসব বলে অভ্র হাসতে শুরু করে । কোমরে দু হাত দিয়ে শরীর ঝুকিয়ে হাসতে হাসতেই কেদে ফেলে। আবার হাসতে শুরু করে,
'' রেণু খালা আমি তো তোমাকে কিছু হলেও ফিরিয়ে দিলাম। এখন তুমিও দাও।''
'' আমার ছেলের আমানত তোমার কাছে গেল কি করে অভ্রনীল?''
'' তোমার ছেলের সব আমানতই তো আমার কাছে । আরো বড় আমানত দেখতে চাও?"
অবন্তীর হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে এনে বলে, '' এই যে তোমার ছেলের হবু বৌও এখন আমার বৌ । যার তোমার ছেলের বাচ্চার মা হওয়ার কথা ছিল সে এখন আমার বাচ্চার মা । তুমি যার নিজের দাদী হতে তার নিজের দাদী এখন আমার মা । তুমি আমার মাকে কেড়ে নিয়েছ আমি তোমার সব কেড়ে নিয়েছি। আমি শুভ্রকে মেরে ফেলেছি। আমার ও মা নেই তোমার ও ছেলে নেই। তোমারও ছেলে নেই আমার ও মা নেই । ''
'
অবন্তী বলে , '' অভ্র কি পাগলের মতো হাসতে শুরু করলেন আপনি বলুন তো । আর কি সব বলছেন পাগলের মতো?''
'
'
অভ্র হাসি থামাতেই পারে না । অবন্তীর হাতে শুভ্রর ডায়েরি তুলে দেয়।
'' এর কভারের সাদা বকুলগুলো রেণু খালাকে দিয়েছি। আর ডায়েরি টা তোমাকে দিলাম । যার যার আমানত তাকে ফিরিয়ে দিলাম । আমার এখন ছুটি। অন্যের বোঝা বইতে বইতে আমি ক্লান্ত। অন্যের ডায়েরির বোঝা , অন্যের ফুলের বোঝা , অন্যের বৌ এর বোঝা এমন কি অন্যের খুনের বোঝাও শেষ পর্যন্ত টানতে হলো । প্রথম তিনটে কে আমি বোঝা কোন দিনও মনে করি নি । নিজের সম্পদ ভেবেছি। কিন্তু আজ আমার কেমন ক্লান্ত লাগছে । সব কিছুতেই কেন এই অন্যের জিনিসের ভাগিদার আমি? আমি সত্যিই এবার ছুটি চাই ।অবন্তী তুমি একদিন বলেছিলে না এই মৃত্যুর মিছিল আমি সৃষ্টি করেছি ঠিক আছে আমি যখন সৃষ্টি করেছি এর বিনাশ আমিই করব ।''
.
.
.
চলবে..........................