ভিনা কলিংবেল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।এখন সকাল এগারোটা বাজে।এই সময় সোহেল বাসায় থাকে না।ভিনা চাচ্ছে না সোহেলের সাথে ওর দেখা হোক।আগে পরিকল্পনা ছিলো কলিংবেল দিয়ে দরজার কাছে গয়নার বক্সটা রেখেই দ্রুত চলে যাবে।কিন্তু ঘরে ডায়রি আছে, যেই ডায়রির মায়া ভিনা ছাড়তে পারছে না।ডায়রিটা ওর একাকিত্বের সঙ্গী ছিলো সবসময়।
শিউলির গয়না বলতে দুইটা চুড়ি,একটা চেইন,দুইটা আংটি আর দুই জোড়া কানের দুল।এর মাঝে শুধু এক জোড়া কানের দুল নিজের কাছে রেখেছে,স্মৃতি হিসেবে।চুমকি যদি দরজা খুলে,তাহলে ও সাড়া শব্দ ছাড়াই নিজের রুম থেকে ডায়রি উদ্ধার করতে পারবে,কেউ জানবেও না,কারণ চুমকি যাদের বলবে,তারা জানা না জানা একি কথা।এসবকিছু ভেবে অনেক্ষণ সময় চলে গেলো।দ্বিতীয় বার কলিং বেল বাজানোর পরও কেউ খুললো না দরজা।খুব সম্ভবত বাইরে সবাই।বাইরে গেলেও কোথায় যেতে পারে?ডেলিভারি কি মুনার?কিন্তু এখন তো মাত্র ছয় মাস হতে পারে।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন লাভ হলো না,তখন ভিনা হোস্টেলের দিকে রওনা দিলো। ফেরার পথে যাবিরকে ফোন দিলো জানানোর জন্য।সেদিন গয়না বিক্রি নিয়ে যে মনোমালিন্য হয়েছিলো,সেটার শীতলতা সম্পর্কে এখনও রয়ে গেছে।যদিওবা সে ঘটনার বেশ কয়দিন হয়ে গেছে।
-বাসায় কেউ নেই মনে হয়।কাউকেই পায়নি।
-সত্যি?কেউই নেই?
-মিথ্যা কেন বলবো আমি?এক জোড়া কানের দুল শুধু রেখেছি নিজের কাছে।কোনো লোভ নেই আমার মাঝে।
-লোভের কথা কে বললো?ঐ বাসায় ফেরার ইচ্ছা নেই তোমার।তাই প্রশ্ন করেছিলাম।
-করা উচিৎ হয়নি যাবির। আমি মিথ্যা বলি না তোমাকে।
-তুমি কিছুই বলো না ভিনা।
-আমি কী করেছি যাবির?যার জন্য এমন করছো?
-স্যরি আমি।রাখি।
ভিনা কিছুতেই বুঝতে পারছে না কী হয়েছে।দিন দিন এভাবে দূরত্ব বাড়তে থাকলে,বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে পরবে।
•
দুই সপ্তাহ আগে মুনা জেনেছিলো তার মেয়ে হবে।সেই মেয়েকে নিয়ে আগামীর দিনগুলোও সাজিয়ে নিয়েছিলো সুন্দরভাবে।মাত্র দুই সপ্তাহ,এরি মাঝে মেয়েকে কোন স্কুলে দেয়া যেতে পারে,বিয়ের সময় কী হবে এরকম নানা ভাবনায় ডুবে ছিলো।সকাল থেকে তলপেটে ব্যাথা করছে। প্রথমে আমলে না নিলেও ব্লিডিং শুরু হলে অশুভ আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠে মুনার।সাথে সাথে সোহেল কে বিষয়টা জানালে সোহেল ইমার্জেন্সি ডাক্তারের এ্যপোয়েন্টমেন্ট নেয়।মুনা কান্না করে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে।সন্তানের সামান্যতম ক্ষতিও মুনা মেনে নিতে পারবে না,পাগল হয়ে যাবে।এই সন্তানই তার সব।ডাক্তারকে গভীর রাতে ফোন দেয়া হয়েছে বিধায় সকাল এগারোটার আগে এ্যপোয়েন্টমেন্ট পাওয়া সম্ভব হয়নি।ডাক্তার সকালে হস্পিটালে এ্যডমিট হতে বলেছে।হস্পিটালেই উনি মুনাকে এ্যটেন্ড করবেন।ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ডাক্তার সেদিনই ঢাকার বাইরে গিয়েছিলো,এবং কম হলেও তার ফিরতে সকাল হবে।একদম প্রথম ডাক্তার সোমা,উনি দেশেই নেই।মানুষের বিপদে একটা দরজা বন্ধ হলে অন্য দরজা খুলে বলে শুনেছে মুনা,কিন্তু আজকে নিজেকে বদ্ধ ঘরে আটকে থাকা বন্দির মত মনে হচ্ছে,যেখানে কোনো জানালাও নেই আলো আসার।রাত বাড়ার সাথে সাথে ব্যথা বাড়তে থাকলে মাঝরাতে সোহেল মুনাকে হস্পিটালে ভর্তি হয়।এই চরম খারাপ পরিস্থিতিতেও মুনার মা লতিফা খালি একটাই বলছিলেন
-এই বাচ্চাটার কিছু হইলে তোর মুখ জীবনেও দেখুম না আমি।এই বাচ্চার যেন কিসু না হয়।মেয়ে হইসে যা হইসে।বাচ্চার জানি কিসু না হয়।
সোহেল মানুষের স্বার্থপরতা আর নির্মমতার চূড়ান্ত দেখলো সেদিন।সন্তানের কষ্টে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই তার।মুনা মারা গেলেও হয়ত তার কিছু যায় আসবে না।হস্পিটালে ইমার্জেন্সি তে নেয়ার পর ইন্টার্ন এক মেয়ে ডাক্তার মুনাকে এটেন্ড করলো।এই মুহূর্তে কোনো গাইনি প্রফেসর ও নেই হস্পিটালে।এদিকে মুনার ব্লিডিং বেড়েই চলেছে।সকাল থেকে বাচ্চা একবার ও নড়াচড়া করেনি।সোহেল এই মুহূর্তে পুরো অনুভূতি শূন্য হয়ে গেলো।কেন যেন মনে হলো,মুনা নিজের পাপের শাস্তি পেতে যাচ্ছে।তবে সন্তান দিয়ে কেন?মেয়ে শোনার পর থেকেই আলাদা মায়া জন্মেছিলো এই বাচ্চার প্রতি।এক মেয়ে চলে গেছে,আরেক মেয়েও চলে যেতে পারে হয়ত।তার মেয়েরা এত অভিমানী কেন?
.
.
.
চলবে...............................................