'' আপনার জন্য আমি কিছুই হারাইনি অভ্রনীল।''
কথা শেষ না করতেই আজমির সাহেব অবন্তীকে ইশারায় চুপ করতে বলে।
'
অবন্তীর হাতে খাবার দেখে অভ্র উঠে বসে । হাত থেকে খাবারের বক্স কেড়ে নেয়। বক্স খুলে সব পছন্দের খাবার দেখে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় অবন্তীর দিকে।
'
'' আমি বাড়ি নেই আর সে সুযোগে এসব শুরু করেছ তুমি?"
'' না ..মা ..মানে। আমি রাধি নি। বুয়াকে বলেছিলাম এসব রাধতে । ''
'' আমি খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি এসব কে রেধেছে। আমার জন্য কারোর কোন আদিখ্যেতা দেখানোর দরকার নেই বলে দিলাম।'' অভ্র খাবারগুলো অবন্তীর গায়ে ছুড়ে মারে।
'
'
''এসব কি ধরনের অসভ্যতা অভ্র? তুমি কি কোন দিনও সভ্য হবে না? '' বাবার ধমক শুনে চোখ নিচে নামিয়ে নেয় অভ্র।
'
''না । আমার বারণ কেউ না শুনলে আমি তো অসভ্যতা করবই। খুব রান্না করার শখ তাই না? আমাকে ছেড়ে চলে গিয়ে কোন হোটেলে বাবুর্চির চাকরি নিলেই তো পারে । তাহলেই তো কেউ আর নিষেধ করবে না ।''
'
'' আপনি আমার সাথে এমন বিহেভ কেন করতে শুরু করেছেন বলুন তো? আমার কথা সহ্য করতে পারছেন না, আমার রান্না করে এনেছি সেটাও সহ্য হচ্ছে না । মানছি আপনি প্রথম প্রথম আমকে কিচেনে যেতে দিতেন না। ভয় পেতেন। কিন্তু যখন এসাইলেমে ছিলেন ওখানকার খাবার খেতে পারতেন না ।কে রেধে নিয়ে যেত আপনার জন্য? আমার রান্না করা খাবারই তো খেতেন আমারই হাতে । ফেরার পরও মাঝে সাঝে রেধে দিই নি আমি আপনাকে? আজ আবার পুরোনো দিনের মতো আচরণ কেন করছেন? রেণু খালার আসল রুপ তুলে ধরে আমি কি খুব বেশি অপরাধী হয়ে গেছি আপনার কাছে? সত্য মেনে নিতে এতটা সমস্যা আপনার? মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মতো একই বৃত্তে ছটফট কেন করছেন? মেরুদণ্ডহীন কেচো দেখেছেন কখনো? সোজাপথে হাটার চেয়ে এরা বৃত্তাকারে বার বার নিজের দেহ প্যাচতে চায়। আর একি বৃত্তে ঘুরপাক খায় অনেক্ষন। ''
'
'
অভ্র কোন উত্তর দেয় না । চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকে।
শাড়ির বেশির ভাগেই ঝোলের দাগ লেগে গেছে । অবন্তী বাড়ি ফেরে চেঞ্জ করার জন্য ।অবন্তী চলে যাবার পর অভ্র একা হু হু করে কেদে ওঠে।
'' ঘরপোড়া গরু সিদুরে মেঘে ডরায় ''
'
'
বেশখনিক্ষন পর অর্নি আসে। ওর মাথায় হাত রেখে এলোমেলো চুল ঠিক করে দেয়। অভ্র'র সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপই নেই।
'' অভ্র তুই তাকাবি না আমার দিকে?"
'' হু।''
'' দ্যাখ কে এসেছে তোকে দেখতে । অর্থি এসেছে । ওকে তো তুই কত আদর করিস । ওর সাথে কথা বল। ''
অর্থি কে বেডে তুলে দিতেই ও অভ্রর গায়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে । " অভ্য মামা''
'
অভ্র ওকে কোলে তুলে নেয়। অনেক্ষন ধরে আদর করতে করতে অর্নির দিকে তাকায় ।
'
'' তুই রাগ করবি না? ''
'' না ।''
'' তুইও এখন আদিখ্যেতা করবি?''
'' না রে । আমি আদিখ্যেতাটাও ঠিক মতো পারি না। আমি যা বলি সোজা সাপ্টা । এতদিন তোকে পছন্দ করতাম না এটাও যেমন সোজাসাপ্টা প্রকাশ করেছি। এখন সব কিছু শোনার পর আমার নিজের প্রতি খারাপ লাগছে এটাও সোজা ভাবেই বলতে এসেছি। অভ্র আমি আসলে সরি ।''
'
'' অর্নিপু আমি মরে গেলে তো তুই সব চেয়ে বেশি খুশি হতি তাই না? তুই তো বলিস আমার কৈ মাছের প্রাণ ।''
'
'' হুম । সত্যি তো তোর কৈ মাছের প্রাণ। আর আমি সত্যি কথাই বলি । আমি তোকে সত্যিই সহ্য করতে পারতাম না রে। তুই আসার পর আমি আমার আদর থেকে কিছুটা হলেও বঞ্চিত হয়েছি তাই। সবার মনোযোগ শুধু তুই কাড়তি তাই। আমার সব আদর গুলো তোর সাথে ভাগাভাগি ব্যাপারটা আমার ভালো লাগত না । আর সেদিন আমি কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরি। হঠাৎ ফিরে দেখি তুই দরজার লক ধরে ওমন টানাটানি করছিস। তুই যে ছোট থেকেই কি পরিমান দুষ্টু আর অকাজে ওস্তাদ তা আমরা সবাই জানি । আর তোর ঐ দরজা লক করার খেলা খেলতে যে তুই কি পরিমান মজা পেতি তা সব চেয়ে ভালো আমি জানি । কারণ তোর ঝগড়া আর মারামারি সব চেয়ে বেশি আমার সাথে হতো আর তুই সব চেয়ে বেশি লক আমাকেই করতি । আগুনের প্রতিও তোর যথেষ্ট আকর্ষণ ছিল। ছোটখাট জিনিস পোড়াতে ওস্তাদ ছিলি তুই। তাই আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম সকালে মা'র সাথে রাগারাগি হবার বদলা নিতেই তুই হয়ত... আমি সত্যিই বুঝি নি রে তোর এই ছোটখাট দুষ্টুমির ফায়দা রেণু খালা এভাবে তুলবে। ''
'
'' রেণু খালা কই?"
'
'' কই আর থাকবে। বাড়িতেই আছে হয়ত। তোকে নিয়েই তো সবাই ব্যাস্ত ওদিকে অতটা খেয়াল করা হয় নি ।''
'
'
অবন্তী বাড়ি ফিরে শাড়ি চেঞ্জ করে নিয়েছে । আগের শাড়িতে বেশ ঝোলের দাগ লেগে গেছে । সহজে যে এদাগ ওঠার নয় তা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। শাড়িটা ওর মায়ের ছিল। বিয়ের সময় সাথে করে মায়ের কিছু শাড়ি এনেছিল। এর মধ্যে এই শাড়িটা সব চেয়ে সুন্দর। নীল পাড় আসমানী শাড়ি। ঝোলের দাগ তুলতে লেবু বেশ কার্যকরী । ব্লিচিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে ।
'
কিন্তু লেবু! লেবু তো কিচেনে। অভ্র'র নিষেধের কথা মনে পড়ে । তারপর ও বুয়াকে ডেকেও সারা না পেয়ে নিজেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। শরীর কিছুটা হলেও ভার হয়ে আসছে এখন সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতে এখন আগের তুলনায় সময় কিছুটা বেশি লাগে ।
'
অবন্তী কিচেনে লেবুর রস করতে ব্যাস্ত। দাগ লাগা জায়গা কিছুক্ষণ লেবুর রসে ভিজিয়ে রেখে ডিটারজেন্ট এ ধুয়ে ঝোলের হলুদের দাগ পুরোপুরি তোলা সম্ভব । হঠাৎ তার কানে আসে দরজা আটকানোর শব্দ । দরজায় গিয়ে খোলার চেষ্টা করাতে বুঝতে পারে লক করে দেয়া হয়েছে বাহিরে থেকে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে ওর । অনেকবার দরজা ধাক্কিয়েও কোন কাজ না হওয়ায় দরজার পাশ ঘেষে বসে পড়ে । কিছুক্ষণ পর ইলেকট্রিসি ও অফ হয়ে যায় । অন্ধকারে প্রচন্ড ভয় পায় মেয়েটা। রুমে একফোটা আলো ও নেই, নিকষ কালো অন্ধকার যাকে বলে। এই মূহুর্তে রুমে আলো জ্বালাবার একমাত্র উপায় হলো মোম জ্বালানো। কিন্তু কিচেনে তো মোম নেই। তাহলে গ্যাসের চুলা! মুহূর্তেই মনে পড়ে আগুন জ্বালালে যদি শাশুড়ি মায়ের মতো কিছু হয়। দাতে দাত চেপে অন্ধকারেই চুপচাপ বসে থাকে। দরদর করে ঘামতে শুরু করে সে। কিছুক্ষণ পরেই লক্ষ্য করে দরজার নিচ দিয়ে কেউ কেরোসিন রুমে ঢেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। অবন্তী বুঝতে পারে সে প্রথম টোপে ধরা দেয় নি। আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে নি । তাই এখন রুমে কেরোসিন ঢেলে দেয়া হচ্ছে । দরজার নীচ দিয়েও ছোট একটা ম্যাচের কাঠি ধরিয়ে দিলেও যথেষ্ট। অবন্তী ঝোলের দাগ লাগা শাড়িটা দিয়ে কেরোসিন গুলো শুষে নেবার চেষ্টা করে । কিন্তু এক পর্যায়ে হঠাৎ শাড়ি সমেত মেঝেতেও আগুন জ্বলে ওঠে।
অবন্তী চেচিয়ে ওঠে,'' রেণু খালা আমি আগুন আর অন্ধকার দুটোতেই ভয় পাই। এর চেয়ে পানিতে ডুবিয়ে মারো না হয় বিষ খাইয়ে।''
.
.
.
চলবে...........................