এক পর্যায়ে হঠাৎ শাড়ি সমেত মেঝেতেও আগুন জ্বলে ওঠে।
অবন্তী চেচিয়ে ওঠে,'' রেণু খালা আমি আগুন আর অন্ধকার দুটোতেই ভয় পাই। এর চেয়ে পানিতে ডুবিয়ে মারো না হয় বিষ খাইয়ে।''
'
ওপার থেকে কোন শব্দই আসে না । অবন্তী বার বার চেচাতেই থাকে। কিচেন সিঙ্কের ট্যাপের লাইন ও অফ করে দেয়া হয়েছে । হাতে পায়ে আগুনের আচ লাগতে শুরু করে দেয় । কেরোসিনের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে সেই সাথে বাড়তে থাকে বহ্নিশিখা। ওর বার বার মনে পড়ে সেই প্রথম দিনের কথা সেই প্রথম যেদিন অভ্র ওকে আগলে নিয়েছিল বুকের ভেতর। সেদিন ও তো এখানেই রান্না করতে এসেছিল। অভ্র কোত্থেকে ম্যাজিকের মতো এসে ভয় পেয়ে বুকের ভেতরে জড়িয়ে নিয়েছিল সেদিন। পাজাকোল করে ওপরে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে সে কি কান্না। সে কি শাসন! ভয় পেয়ে মিছিমিছি সে কথা দেয়া। শুভ্রকে ফিরিয়ে দেবার কথা দেয়া । শুভ্রকে ফিরিয়ে দেবার জন্য তার কতই না চেষ্টা ! শুভ্র'র ছলে অভ্র নামক শুদ্ধ নেশায় জড়িয়ে পড়া । অগোছালো এলোমেলো সেই ম্যাজিশিয়ানের প্রেমে জড়ানো। অভ্রকে তার সত্যিই ম্যাজিশিয়ান মনে হয়। জাদুর ছড়ি নিয়েই যেন এসেছিল তার জীবনে। জাদুর ছড়ি ঘুরিয়ে এক তুরিতেই তার রংহীন জীবনকে যেন রং দেয়ার প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছিল অভ্রনীল । অভ্রর নিজের জীবনের রং ছিল না কিন্তু সদ্য বাবা মা ভাই আর বাগদত্তাকে হারানো রংহীন অবন্তীর জন্য যেন আকাশের নীল থেকে কিছু রং ধার করে এনে ছড়িয়ে দিয়েছিল অভ্রনীল তার জাদুর ছড়ি দিয়ে।
কোথায় তার ম্যাজিশিয়ান! কোথায় তার জাদুকর! আজ কি আর ম্যাজিকের মতো আসবে না ! সে তো আজও নিষেধ করেছিল। শাসন করেছিল । কি দরকার ছিল তার শাসন অমান্য করার । ধীরে ধীরে চোখ বুজে আসে অবন্তীর । দুহাত দিয়ে আগলে রাখতে চায় নিজের ভেতরে বেড়ে ওঠা আরেক প্রাণকে। যেন আগুনের কোন আচ তার গায়ে না লাগে ।
'
'
'রেণু খালা বাড়িতেই আছে ' অর্নির থেকে এমন কথা শোনার পর অভ্রর বুকের ভেতর হঠাৎ ই খচ করে ওঠে। অবন্তী ! সে ও তো রাগ করে বাড়ি চলে গেছে । বাবা ও তো সেই তখন থেকে হসপিটালেই আছে।তার মানে বাড়িতে রেণু খালা আর অবন্তী ! অভ্র ফোনে বার বার ট্রাই করে । রেস্পন্স না পেয়ে টেক্সট করে,
'
'' তখনকার বিহেভিয়ার এর জন্য সরি । জানি আমার নিষেধগুলো শুনতে তোমার ভালো লাগে না । 'আর নিষেধ করব না কোন কিছুতে' এমন কিছু বলে তোমার রাগ আমি কখনোই ভাঙাবো না । আমার যা কিছুতে আশঙ্কা কাজ করবে সে সব কিছুতেই আমি আজীবন নিষেধ করব, শাসন করব,তুমি যতই রাগ করো না কেন। এখন আপাতত এই নিষেধ টা শোন, বাড়িতে একা থাকার দরকার নেই । হসপিটাল চলে এসো। ''
'
'
বেশ কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে । টেক্সট এর উত্তর না পেয়ে অর্নির ফোন নিয়েও বেশ কয়েক বার ট্রাই করে । নাহ তাও কোন রেসপন্স নেই। বাধ্য হয়ে রেণু খালাকেও কয়েক বার ট্রাই করে । রাগ আর দুশ্চিন্তায় ফোন ছুড়ে মারে ।
'' এই আবার কি পাগলামো শুরু করলি বল তো! ভাঙচুর কেন শুরু করলি ?"
''উফ রেণু খালাও তো ফোন পিক করছে না । ''
'' তো কি হয়েছে? এত কিছুর পর রেণু খালা তোর ফোন পিক করবে?''
'' তাহলে অবন্তীর কি সমস্যা?"
'' ব্যাস্ত আছে হয়ত। ''
'' ব্যাস্ত না ছাই । আমি এক ডিগ্রি রাগ দেখিয়েছি কি না! তাই তার ফর্টি ডিগ্রি রাগ না দেখালে তো চলবে না! কেন এই সিম্পল ব্যাপারটা যে বোঝে না আমার টেনশন হয় বলেই তো এমন করি ।''
'' সত্যিই তো রেণু খালাকে আর বিশ্বাস নেই ! সব শুনে তো আমার উনাকেই মানসিক রোগী মনে হয়।''
'' অর্নিপু আমি বাড়ি যাব। ''
'' তোকে কাল ডিসচার্জ করে দেবে বলেছে ডক্টর। এই একটা রাত থাক তোর শরীরও তো ভালো না । রাতে না হয় আমি বাড়ি গিয়ে অবন্তীর সাথে থাকব।''
''আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না ,তোকেও না । আমার বৌ আর বাচ্চাকে আমাকেই আগলে রাখতে হবে । আমার শরীর ঠিকই আছে। আমি বাড়ি যাব। নার্স ডাক এই সব তার প্যাচ খুলে দিতে বল।''
'' কি বাচ্চাদের মতো শুরু করলি? ''
'
অভ্র নিজেই স্যালাইনের লাইন খুলে ফেলে। ওর বাবার থেকে জোর করে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ।
'
'
অভ্র চলে যাবার পর অর্নি বাবাকে জিজ্ঞেস করে," বাবা এত কিছু জানার পরও রেণু খালা বাড়িতে কি করে?"
'' অভ্রকে নিয়েই ব্যাস্ত ছিলাম দেখছ ই তো ।''
'' পুলিশে একটা ফোন দেয়াই যথেষ্ট ছিল বাবা। যা তুমি এখানে অভ্র'র পাশে বসেই করতে পারতে। রেণু খালাকে কেন পুলিশে দিচ্ছ না তুমি? ''
'' এতদিন তো এই দোষে অভ্র দোষী ছিল। ওকে কি পুলিশে দিয়েছিলাম?''
''এসব কি বলছ বাবা তুমি? অভ্র আর রেণু খালা এক হলো নাকি?"
'' দুজনই তো মানুষ ।''
'' বাবা! তুমিও পাগল হয়ে গেছ।''
'' আমার কাছে আমার অভ্র সব চেয়ে ইমপর্ট্যান্ট । তারপর অন্য কিছু । ও আমার একমাত্র ছেলে। আমার বংশের প্রদীপ। ''
'' সেটা আমি ভালো করেই জানি । ছেলে বলে আমাদের চেয়ে সব সময়ই তুমি অভ্রকে বেশি ভালোবাস । তোমার ছেলেই তো তোমার সব! যাক গে, এই বিষয় পুরনো লাগে এখন। রেণু খালাকে কেন তুমি পুলিশে দেবে না? ''
'' তোমার কি মনে হয় রেণুকে পুলিশে দিলে রেণু তার ছেলের ব্যাপারেও মুখ খুলবে না পুলিশের কাছে? হুম? তখন কেচো খুরতে কেউটে বেরোবে না? আবার অভ্রকে নিয়ে পুলিশি ঝামেলা হোক আমি চাই না । আমি চাই না আমাদের ফ্যামিলি রেপুটেশন আর অভ্র'র ইমেজে কোন দাগ লাগুক। আর এর প্রভাব আমাদের ব্যাবসায় ও পড়ুক। অভ্র সবে ব্যাবসা দেখতে শুরু করেছে । ''
'' তোমার কাছে ফ্যামিলি রেপুটেশন টাই সব? আর মা?''
'' আমার জন্য ফ্যামিলি রেপুটেশন আর অভ্র দুটোই সব। আর তোমাদের মা তো চলেই গেছে বহু আগে। এখন যে চলে গেছে তার জন্য ন্যায় করতে গিয়ে আমার অভ্র কোন বিপদে পড়ুক তা আমি চাই না । অতীতের চেয়ে বর্তমান আমার কাছে সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ । ''
'' বাহ এই সুযোগে রেণু খালা এত কিছু করেও পার পেয়ে গেল ! বাহ বাবা তোমার চিন্তাধারা হাত তালি দেবার যোগ্য। ''
'
'
অভ্র বাড়ি ফিরে গেটে দারোয়ানকে দেখতে পায় না । মেইন গেট থেকে বাড়ির মূল ভবন বেশ দূরে , একেবারে পেছনের অংশে। কিছু কাছে যেতেই অভ্র আলোর চ্ছ্বটা কিছুটা দেখতে পায় । আরো কাছে গিয়ে আর বুঝতে বাকি রয় না ব্যাপারটা ।
'
'
দুদিন পর,
নতুন কবরে হেসে হেসে ফিসফিসিয়ে গল্প করতে ব্যাস্ত অভ্র। এমন সময় বাদামি খামে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট হাতে পায় অভ্র। রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে ''সুইসাইড''
.
.
.
চলবে..................................