অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৬৪ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


 -চলে যাবি?

সোহেল অনেক কষ্টে কান্না চেপে ভরাট গলায় ভিনাকে জিজ্ঞেস করলো।

-থাকবো কার জন্য?

ভিনা মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিৎ বুঝতে পারছে না।সোহেলের মুখোমুখি হলে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া পাবে আশা করেনি।বোঝা যাচ্ছে যে কোনো না কোনোভাবে মুনার চাল ধরা পরেছে,সোহেল এর জন্যই অনুতপ্ত। 

-বাবা হয়ে যা করেছি,এর ক্ষমা আমি চাবো না।শুধু বলবো এই বাড়ি তোর মার ও।মার খাতিরেই থেকে যা,নাহলে অনেক কষ্ট পাবে শিউলি।দরকার হলে মোমেনা কে নিয়ে এখানে থাক।আমি চলে যাবো।কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে যাস না।

-ধরে নাও মার সাথে আমিও চলে গেছি।আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।

সোহেল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।কান্না আটকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টায় চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।
পেছন থেকে মোমেনা এসে থমকে দাঁড়ালো।কিছু না বুঝতে পেরে শেষে সোহেলের হাতে গয়নাগুলো দিয়ে চলে গেলো।নিরক্ষর,তবে এতটুকু বুঝ আছে কখন মুখ বন্ধ রাখতে হয়।

সোহেল বাক্স খুলে গয়নাগুলোতে হাত বুলালো।ভিনা এতক্ষণ পাশেই ছিলো,

-এক জোড়া কানের দুল পরে আছি আমি।বাকি সবকিছু ঠিক আছে।কোনো সমস্যা নেই।

সোহেল এই কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো।করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো একদম অচেনা ও হটাৎ বড় হয়ে যাওয়া মেয়ের দিকে।

-শুধু গয়নাই দিতে আসছিস?

-না,ডায়রি আর মায়ের ছবি ও নিতে এসেছি।খারাপ মেয়ে আমি,কাউকে শুধু দিতে পারি না।

কথাটা বলে ভিনা সোহেলের দিকে তাকিয়ে থাকলো।সোহেল নিজের রুম থেকে চাবি আনতে চলে গেলো।

সেদিনের তুই আর আজকের তুই এর মাঝে কী বিস্তর তফাৎ!সময় কীভাবে সব বদলে দেয়!এটাই মনে হয় সময়ের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা,পরিবর্তন ।যত দিন যায়,তত পরিবর্তন। কিছুই এক থাকে না,ভালোও না,খারাপের ও না।

-যেয়ো না ভিনা।পায়ে পরি তোমার।

ভাঙ্গা গলা আর শ্রান্ত শরীর নিয়ে দরজায় চৌকাঠ ধরে মুনা দাঁড়িয়ে আছে।ভিনার বুঝতে বাকী থাকলো না বাচ্চার কিছু হয়েছে।তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য অন্যভাবে প্রশ্ন করলো।

-উঠে আসলেন কেন?এই অবস্থায় হাঁটা চলা ভালো না।আপনি বিশ্রাম নিন।

-কার জন্য করবো এসব?তোমাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি আমি পেয়েছি।আমার বাচ্চা আমার মত নোংরা মানুষের কাছে আর আসেনি।

ডুকরে কেঁদে মুনা মাটিতে বসে পড়েছে।সোহেল বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না দেখিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

-চাবি দাও,আমি কিছু জিনিস নিয়ে চলে যাবে।

-তুই থাক।আমি যাই।এ বাসা তোর।

-কখনো না।এ বাসার সাথে আমার মার সম্পর্ক ছিলো।সে যখন নেই,আমার ও নেই।

ভিনা সোহেলের হাত থেকে চাবি নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।এদের সাথে কোনোভাবেই থাকা সম্ভব না।এই বাচ্চা মারা গেছে দেখে তাদের এই অনুতাপ,অনুশোচনা।নিজের জীবনে এখন এদের কোনো জায়গা নেই।নিজের বিছানায় বসে বেশ অনেক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করলো। হুট করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সহজ না।

তবুও হতে হবে...নিজেকে বললো ভিনা।গয়না দিয়ে আসার পর যাবিরের সাথেও সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে।জীবনে এখন যদি আসলেও কারো মূল্য থেকে থাকে,সে হলো যাবির।টানাপোড়েন সব সম্পর্কেই থাকে।তার মানে এই না যে হাত ছেড়ে দিতে হবে।
ডায়রি আর ছবি ব্যাগে ঢুকিয়ে যখন বেরোবে,তখন টেবিলে চিরকুট পরা দেখলো,যেটা মুনা এক সময় ওকে দিয়েছিলো।এক টুকরো কাগজের ক্ষমতা দেখে হাসলো ভিনা।একেই মনে হয় বলে 'কারমা'। 

দরজা বন্ধ করে যখন বের হবে,দেখলো মোমেনা দাঁড়ানো।আর কেউ নেই।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলো,আগে এই বিষয়গুলো কত যন্ত্রণা দিত,আর এখন,মানুষের মিথ্যে সান্নিধ্যের চেয়ে একা থাকাটাই বেশি শান্তির মনে হয়।

-খালা গেলাম আমি।

-এহন না।আমিও এই বাড়ির কাম ছাইড়া দিমু জলদি।খালি বাচ্চাডা মইরা গেসে দেইখা আমারে কইসে,তাই আইসি।নাইলে আইতাম না।এই মাস কইরাই যামুগা।তখন তোমারে ক্যামনে পামু কও।

-পাবা।ভাগ্যে থাকলে পাবাই।

-বড় বড় কথা কইয়ো না এত।আমার কথা শুনতে হইবো।আজকে দুপুরে খাইয়া যাবা।আমি পাকামু।তুমি তোমার কথা শুনবা।এখন নিজের রুমে বও।মন চাইলে দরজা বন্ধ রাহো।ডাক দিলে খাইতে আইবা।

-ঠিক আছে।আর এমন করবা না কখনো।আজকেই মানলাম।

ভিনা নিজের রুমে যেয়ে দরজা আটকে দিলো।এখন সাড়ে এগারোটা বাজে,দুপুরে খেয়ে বের হতে অন্তত দুইটা বাজবে।অনেক দিন পর নিজের বিছানায় অন্যরকম লাগছে।আগে প্রায়ই শিউলি ওর সাথে ঘুমাত বিছানায়,এখন নিজেরি ঘুমানো হয় না।রুম থেকে প্রয়োজনীয় আরো কিছু জিনিস ব্যাগে নিয়ে নিলো ভিনা।এরপর হটাৎ ক্লান্ত লাগায় একটু হেলান দিলো বিছানায়।আগের চেয়ে মানসিকভাবে অনেক শক্ত হলেও সবকিছু ভীষণ চাপে ফেলেছে ওকে।বোধহয় এ কারণেই কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে তলিয়ে গেলো।


কারো স্নেহভরা স্পর্শে ঘুম ভাঙছে ভিনার।কেউ অতি যত্নে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠতে কিছুটা সময় লাগলো।

-রুপিন আন্টি!

-কিছু বলিস না অসভ্য মেয়ে!কিছু বলবি না তুই!
কোথায় ছিলি এতদিন!কীভাবে ছিলি?কিছু জানালিও না।

-কী জানাবো?কার ব্যাপারে অভিযোগ করবো?যার কাছে অভিযোগ করার কথা,সেই তো দোষ করেছে।

-আমাকে কেন পর বানালি ভিনা?হতে পারে আমি তোর সাথে তেমন যোগাযোগ করিনি,তার মানে তো এই না যে আমি তোর পাশে নেই।একবার বলে দেখতি,যেখানেই থাকতাম,ছুটে আসতাম।

-তুমি জানলে বাবাও জানত।তাই আমি কাউকেই জানায়নি।

-কবে এত বড় হয়ে গেলি?সব বুঝা শিখে গেছিস।

-না,মোটেও না।সব বুঝতে পারলে আজকে এমন হত না আন্টি।

-ভুলে যা সব।তুই আর কোথাও যাবি না।

-সত্যিটা জেনেও কীভাবে এমন বলছো?

-নিজের কাছেই রাখতাম আমি।আমি ট্রিটমেন্ট এর জন্য বাইরে যাচ্ছি এক মাসের জন্য।কথা দিলাম,ফিরে এসেই তোকে নিয়ে যাবো,এখানে থাকতে হবে না।

-না,প্লিজ।আমাকে একটু বুঝো।

-পরীক্ষা কি দিবি?

-হ্যাঁ, আমি প্রিপারেশন নিয়েছি।

-খুব খুশি হলাম,সত্যি।পরীক্ষা কবে?

-দুই সপ্তাহ পর।

-ঠিক আছে।তুই এখানে থেকে পরীক্ষা এটেন্ড কর।দেখ ভিনা,পরীক্ষার সময় ওত খেয়াল ও থাকবে না কোথায় আছিস,পরীক্ষা দিয়েই আমি তোকে নিয়ে যাবো বাইরে।

-আমি দেশের বাইরে যাবো না।

-কেন?

-মানে,এখনি যাবো না।গ্র‍্যাজুয়েশনের পর যাবো।

-আচ্ছা,তোর সব কথা শোনা হবে।আগে আমার কথা শোন।

-কী?

-তুই এখানে থেকে পরীক্ষা দে,নাহলে আমি অনেক কষ্ট পাবো ভিনা।আমি প্রমিস করছি,সোহেল,মুনা কেউ তোর সামনে আসবে না।মোমেনাই সব কাজ করে দিবে।তাও তুই এখানে থাক।

-পারবো না আমি আন্টি।

-একটা বারের জন্য আমার কথা শোন।শুধু আমার জন্য।আমিই তোকে নিয়ে যাবো সবার থেকে দূরে।

-আন্টি....

রুপিন ভিনার হাত নিজের হাতে নিলো।এমনভাবে অনুরোধ করলো,যেন ভিনা না করতে পারে।আসলেও ভিনা না করতে পারলো না।শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরে তাকালো।
.
.
.
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন