নতুন কবরে হেসে হেসে ফিসফিসিয়ে গল্প করতে ব্যাস্ত অভ্র। এমন সময় বাদামি খামে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট হাতে পায় অভ্র। রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে ''সুইসাইড''
'
'
অভ্রদের বাড়ির বেশ অনেকটাই পুড়ে গেছে । বাড়ি ঠিকঠাকের কাজ চলছে। অবন্তীর এ খবর শুনে অর্পি ও এসেছে। অর্নি ও আছে সেদিন থেকেই এ বাড়িতে। অভ্রর সাথে সাথেই থাকার চেষ্টা করে সব সময় কেউ না কেউ। যদি অভ্র কিছু করে বসে। অভ্র এ ঘটনার পর থেকে কেমন যেন থমকে গেছে । বাড়ির কারো সাথে কথা বলে না তেমন। শুধু তাকিয়ে রয় সবার দিকে।
অভ্র পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এনে বাবাকে দেখায়। ''সুইসাইড '' লেখা দেখে উনিও বেশ চমকে যান ।
'
'' মানে কি?"
অভ্র হাসতে হাসতে বলে,'' সুইসাইড মানে আত্নহত্যা।''
'' অভ্র সুইসাইড মানে যে আত্নহত্যা তা আমিও জানি । কিন্তু কি করে সম্ভব তা?"
'' হয়ত আমার ওপর রাগ করে । আমি শাসন করেছিলাম কি না!''
'' আচ্ছা রেণু কি তোমাকে কিছু বলে গেছে, কোথায় গেছে ? ''
''না তো ।''
'' এই ঘটনার সাথে সাথেই রেণু উধাও হয়ে গেল তোমার সন্দেহ হয় না ব্যাপারটা নিয়ে?"
'' সন্দেহ করে কি করব? তুমি তো আগেই স্টেপ নিতে পারতে সব কিছু শোনার পর রেনু খালাকে পুলিশে দিতে পারতে । তা তো তুমি করো নি। আর রিপোর্ট বলছে সুইসাইড। তো কাকে সন্দেহ করব? কাউকে না ।''
'' রেণুকে পুলিশে দিলে তুমি শুভ্রর ব্যাপারে ফেসে যেতে অভ্র। আবার ঐ এক্সিডেন্ট এর ব্যাপারেও।''
'' হ্যা। দোষ করলে শাস্তি তো আমারও প্রাপ্য।''
'' অভ্র যা কিছু হয়েছে ধীরে ধীরে ভুলে যাবার চেষ্টা করো বাবা। কিছুদিন পর না হয় আবার নতুন করে ...''
'' তুমি পেরেছিলে নতুন করে?"
'' অভ্র আমার তো বাচার অবলম্বন ছিলে তোমরা তিন ভাই বোন ।''
'' আমারও আছে । ''
'' কি আছে?''
'' অবলম্বন ।''
''কোথায় তোমার অবলম্বন শুনি?''
'' আমার ভেতরে।''
'
'
বসন্ত পেরিয়ে আবার বসন্ত এসেছে । কৃষ্ণচূড়া গাছ আবার রক্তাভ রঙ ধারণ করেছে। পথ ছেয়েছে লাল গালিচায় ।দু বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে ।
অভ্র'র এই ছন্নছাড়া ভাবের জন্য অর্পি এখানেই রয়ে গেছে । এখন তো আগলে রাখার মতো রেণু খালা নেই। অবন্তীও নেই। দ্বিতীয় বিয়ের কথা অভ্র'র কানে তোলাই যায় না । অভ্র আর ব্যাবসা ও দেখে না । সারাদিন বাড়িতে থাকে না । ওর সেই 'পুষ্পকুঞ্জে' সময় কাটায় সব সময়। বাচ্চদের নিয়ে হেসে খেলে সময় পার করে দেয়।
অভ্র বেশ অনেক্ষন অর্পির পায়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে । কোন কথা নেই । অর্পি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
'' অভ্র তুই সারাদিন কই থাকিস বল তো? "
'' বাচ্চাদের সাথে ।''
'' বাড়িতেই তো কত বাচ্চা আছে আমার রিহাম,রেহান আর রিহাব আছে অর্নির অর্থি আর অর্ক আছে । ওদের সাথেই তো সময় কাটাতে পারিস। খামোখা অন্যের বাচ্চার সাথে সময় কাটাতে হবে কেন তোর? ''
'' ইচ্ছে ।''
'
'
আজ সকাল বেলা থেকেই অভ্র'র বেশ তাড়া সব কিছুতেই। নতুন সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পড়ে বেরিয়েছে । আতরের গন্ধে মো মো করছে চারপাশ। চোখে চিকন করে সুরমা পড়েছে।অভ্র'র এই সাজসজ্জা বাড়ির কারোরই ভালো ঠেকছে না । অর্নি জিজ্ঞেস করেই বসে," এভাবে কোথায় যাচ্ছিস?"
অভ্র মুচকি হেসে বলে,'' কাজ আছে।''
'' ফিরবি কখন?''
'' জানি না ।''
'
অর্পি তখন নিজ রুমে ক্লাবের বান্ধবীদের সাথে তাস খেলতে ব্যাস্ত। অর্নি রুমে এসেই জিজ্ঞেস করে,
'' আর্পিপু অভ্রকে দেখছ আজ?"
'' হ্যা দেখলাম তো একটু আগে। কেন কি হয়েছে?"
'' জানি না । আচার আচরণ বেশভুষা তো সুবিধের ঠেকছে না। সুইসাইড করে ফেলে যদি? ''
'' করুক।'', বলে অর্পি আবার তাসের কার্ডগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়। অর্নি হাত ধরে অর্পিকে টেনে আনে খেলার আসর থেকে ।
'' অর্পিপু তুমি সত্যি করে বল তো অবন্তীর কেস তুমি সুইসাইড কি করে প্রমাণ করলে?"
'' কি সব যা তা বলছিস? ও তো সুইসাইডই করেছে।"
'' অবন্তী যে সুইসাইড করেনি তা আমার আর তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না ।''
'' আমি কি জানি আমি কিছু জানি না । তুই কিছু জেনে থাকলে সেটা তোর ব্যাপার। ''
'' তুমি এভাবে সব কিছু অস্বীকার করতে পারো না । সব কিছু গন্ডগোল পাকিয়ে বাবার কাছে ফাসিয়ে দিয়েছিলে তুমি আমাকে । ''
'' আবার তো আমিই বাচিয়েছি। বাবাকে বুঝিয়ে বলেছি তোকে মাফ করে দিতে। আর গন্ডগোল আমি পাকিয়েছিলাম? গন্ডগোল তো পাকিয়েছিল...''
'' তুমি রেণু খালাকেও কিছু করেছ তাই না?"
'' না রে। বেচারি রেণু খালা । কিন্তু সত্যি বলতে এই অবন্তীর রিপোর্টে সুইসাইড কেন দেখাচ্ছে এই ব্যাপারটা আমিও আজো বুঝি নি। ''
'' তার মানে ঐ রিপোর্ট তুমি চেঞ্জ করাও নি?"
'' আরে না রে।''
'' তাহলে !''
'
'
''তাহলে আমি বলি ?" অভ্র'র গলার স্বর পেয়ে ওরা দুজনই চমকে ওঠে । পেছনে তাকিয়ে অভ্রকে দেখে যত না চমকায় তার চেয়ে বেশি চমকায় অভ্রর এক কোলে লাল টুকটুকে পাঞ্জাবি পড়া কাউকে দেখে। হাতে এক টুকরো লাল আপেল , একটু পর পর খরগোশের মতো ছোট ছোট কামড় বসাচ্ছে তাতে । আরেক কোলে টুকটুকে লাল ফ্রক পড়ে অভ্র'র কাধে ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটাকে দেখে। অর্পি নিজের কৌতূহল আর ধরে রাখতে পারে না ।
অর্পি অবাক হয়ে বলে,''ছেলেটা তো হুবহু...''
'' আমার চেহারা পেয়েছে। ''
'' হ্যা ছোট বেলায় একদমই এমন ছিলি তুই। ''
'' বড় হয়েও একদমই আমার মতোই হবে। আর আমার মেয়েটা ওর মায়ের মতো ঘুম কাতুরে হবে ।'' এ কথা বলে অভ্র ওদের দুটো চুমু খায় ।
'' কোত্থেকে ধরে এনেছিস এদের? ওদের মা কে শুনি? তুই আমাদের লুকিয়ে আবার বিয়ে করিস নি তো? ওরা কে ঠিক করে বল। "
'' ওরা আমার রাজপুত্র আর রাজকন্যা ।''
অর্পি এবার বেশ রেগে যায়," অভ্র হেয়ালি না করে ঠিকঠাক বল এরা কে?"
'' আমি নিলাভ্য ,তুমি কে?'' অভ্র উত্তর দেবার আগেই এক কামড় আপেল মুখে দিয়ে ভ্রূ কুচকে গোমড়া মুখে ভাঙা কথায় উত্তর দেয় অভ্রনীলের কোলে থাকা নিলাভ্র।
''ওটা তোমার বড় পিপিমুনি নিলাভ্র।''
'' পিপিমুনি - পাপামুনি , পাপামুনি-পিপিমুনি, মামুনি-নীলামুনি-এপেলমুনি'' বলে হাসতে হাসতে নিলাভ্র অভ্রর গালে চুমু খেয়ে আবার আপেল মুখে দেয়।
'' কিসের পিপিমুনি? কার না কার বাচ্চাকে ধরে এনেছিস? মামুনি নীলমুনি এপেলমুনি কি সব বলছে ও? কোথায় ওর মামুনি?''
'' নীলামনি হচ্ছে এই যে আমার অন্য কোলে ওর বোন নীলাদ্রিতা আর নিলাভ্র আমার মতো আপেলখোর তাই আপেল কে আদর করে এপেলমুনি বলে। ''
'' আর ওর মামুনি?''
'' ওদের মা কে দেখবি তুই অর্পিপু? ভয় পাবি না তো?"
'' ভ ..ভ ভয়ের কি আছে? ''
'
'
'' ভয় পাবেন না বলছেন অর্পি আপু?'' এ কথা বলে রুমে ঢোকে অবন্তী। সাদা শাড়ি লাল পাড় পরনে। লাল আচল দিয়ে বড় করে ঘোমটা টেনে রেখেছে। ঘোমটা ফেলে হাসতে হাসতে অবন্তী বলে,'' আমার এই পোড়া মুখের পোড়া হাসি দেখেও ভয় পাবেন না এ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না অর্পি আপু।''
'
অর্পি আতকে ওঠে অবন্তীকে দেখে। পোড়ার ছাপ এখনো মুখে হাতে আছেই । আগের মতো সেই সুন্দর মুখ মুখশ্রি কোনটাই আর নেই। চামড়ায় শুধু ছোপ ছোপ পোড়া দাগ ।
'' এটা কি করে সম্ভব? তু ...তু... তুমি বেচে আছ কি করে? তাহলে ঐ লাশ? ঐ পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট?''
অভ্র উত্তর দেয়,'' তুই কি মনে করিস তুই একাই চালাক? আমাদের মাথায় কোন ঘিলু নেই? হ্যা মানছি তুই সুপার ট্যালেন্টেড কিন্তু হালকা পাতলা ঘিলু আল্লাহ তা'য়ালা আমাকেও দিয়েছেন । মনে রাখিস অর্পিপু আমি শুভ্রনীল নই আমি অভ্রনীল । ''
'' হ..হ..হঠাৎ শুভ্র'র কথা উঠছে কেন এর মধ্যে?"
'' সেটা তো আমাদের চেয়ে আপনারই ভালো জানার কথা তাই না অর্পি আপু? যাই হোক আমাকে দেখে বেশি ভয় করলে বলবেন আমি ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলব।''
'' আমি শুভ্র'র ব্যাপারে কিছু জানি না ।''
'' কিন্তু আমরা জানি । ব্যাপার না অর্পিপু তুই আমাদের সব না বললেও পুলিশের থার্ড ডিগ্রি পেলে এমনি হর হর করে সব বলে দিবি । কিন্তু হাজার হলেও তুই আমার বোন । আমার একটাই সমস্যা আমি তোদের মতো স্বার্থপর কোন দিনও হতে পারি নি। তাই আজও চাই ভালোয় ভালোয় সব কিছু নিজেই স্বীকার কর তাহলে অন্তত থার্ড ডিগ্রি পড়বে না তোর ওপর । আর আমি বাবার মতোও না যে সব জেনে শুনে সবাইকে মাফ করে দেব শুধুমাত্র ফ্যামিলি রেপুটেশন আর বিজনেসে ইফেক্ট পড়ার ভয়ে। বল বল সব বলতে শুরু কর । কুইক ! ''
'
'' অভ্র তুই কি পাগল হয়ে গেলি?"
'' হুম । আমি পাগলই । শুভ্রকে কি করে রাজি করিয়েছিলি বল ? ''
'' কি ব্যাপারে রাজি করব আমি ওকে?''
'' আমাকে খুন করার ব্যাপারে। "
'' কি যা তা বলছিস?''
'' আর তুই যে যা তা কান্ড একটার পর একটা ঘটিয়েছিস? তোর কি মনে হয় আমার সেদিন ক্লাবে ড্রাগস এর হাই ডোজ, হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়া, বমি করার পরও নেশা না কেটে যাওয়া, হুট করে শুভ্র উদয় হওয়া, শুভ্র মারা যাওয়া সবই কাকতালীয় ছিল? অবশ্যই কাকতালীয় ছিল না । আর পরের বার তুই তো আমার সবকিছু, আমার শেষ সম্বলে হাত দিয়েছিলি! মেরে ফেলতে চেয়েছিলি আমার ফুটফুটে দুটো বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই। "
'
'' অভ্র ভাই আমার, আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা কর। আমি তো দেশেই ছিলাম না । অ ..অর্নি হয়ত এসব করেছে । তুই ভুল বুঝছিস আমাকে।''
অর্নির নাম নেয়ায় অর্নি চেচিয়ে ওঠে," বাহ অর্পিপু কি সহজেই আমার নাম বলে দিলি তাই না? তোর আসলেই তুলনা হয় না রে। সব সময় শুধু আমাকেই কেন ফাসিয়ে দিস তুই? সব কিছুর মাস্টার মাইন্ড তো তুই ছিলি।''
'
'
অনেক জোরাজুরির পর অবশেষে অর্পি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সে বলতে শুরু করে,
'' হ্যা সব কিছু আমিই ঘটিয়েছি । অভ্র ছোট থেকেই আমার কাছে থাকতো। আহমেদ এর সাথে বিয়ের পর আহমেদ আমাকে প্রায়ই বলত আমি বেকার বেকার খাটছি অভ্রর জন্য । বাবা তো সব ওকেই দিয়ে দেবে আর আমাদের সারাজীবন ওর চাকর হয়েই থাকতে হবে । আমিও জানতাম বাবা সব চেয়ে বেশি ওকেই ভালোবাসে । বাবার সব টেনশন যেন ওকে নিয়েই ছিল। আমরা দুই বোন যেন কিছুই ছিলাম না বাবার কাছে । মা যদিও আমাদের তিনজনকে সমান ভালোবাসত। কিন্তু অভ্র আসার পর বাবা আমাদের প্রতি গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছিল। বড় হয়ে বুঝতে পারলাম বাবার ইচ্ছা সব কিছু অভ্রকেই দেবার । আমাদের দুবোনের কপালে জুটবে যথা সামান্য। এজন্য আমিও ধীরে ধীরে আহমেদ এর কথার গুরুত্ব দিই। আমি ইচ্ছে করেই অভ্রকে কোন শাসন করতাম না । ওকে ওর মতো ছেড়ে দিয়ে রেখেছিলাম। আমি জানতাম অভ্র একটু বেয়াড়া তাই এ সুযোগই কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম। আমি আহমেদ প্রায় প্রতিদিন ক্লাব পার্টি এসবই করতাম। আর ফিরে অভ্র'র সাথে গল্প জুড়ে দিতাম এসবে খুব মজা এটা ওটা। ও তখন টিনেজার। অবশ্যই এসব শুনে শুনে ওর আগ্রহ বাড়ত। ও ধীরে ধীরে ড্রীঙ্কস ড্রাগস পার্টি জুয়া এসবে আসক্ত হয়ে গেল । এভাবে আমি চেয়েছিলাম অভ্রকে বাবার কাছে অযোগ্য প্রমাণ করতে । যাতে করে ব্যবসার ভার ওকে না দিয়ে জামাইকে দেয় বাবা। পরে বুঝলাম এত অল্পতে কাজ হবে না । দেশে ফিরলে বাবা যদি ওকে রিহ্যাবে দেয় ও তো ঠিক হয়ে যাবে । তাই যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়ে নিয়েছিলাম আমরা । অভ্র দেশে ফেরার আগে আমি প্রায়ই দেশে আসতাম। কাজে , বেড়াতে বা শশুড় বাড়ি যেতে বিভিন্ন কাজেই আসা পড়ত আমার । আমি লক্ষ্য করতাম আমাদের বাড়ির গেট থেকে কিছু দূরে কেউ মাঝে মধ্যেই ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকে, বসে থাকে। অন্যরা কেউ খেয়াল না করলেও এ ব্যাপারটা আমার চোখে পড়েছিল। আমি একদিন নিজে থেকেই ওর সাথে কথা বললাম। বলে জানতে পারলাম ও শুভ্র। শুভ্র'র ঘটনা নিয়ে যেবার গ্রামে ঝগড়া হয়েছিল সেবার আমি আর অর্নিও গেছিলাম বাবা রেণু খালার আর অভ্র'র সাথে । ওরা ছোট হলেও আমি বেশ বড় ছিলাম তখন। তাই আমি এবার কথা বলে সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম এ সেই শুভ্র। ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে জানতে পারলাম ও এখনো মনে করে রেণু খালা আমাদের বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী । আর অভ্র ওর সৎ ভাই। ও রেণু খালাকে মাঝে মধ্যে দূর থেকে দেখতে আসে। সব সময় দেখা পায় না তবে মাঝে মধ্যে দেখা পায়। আমি বললাম বাড়ির ভেতরে চলো কাছ থেকেই দেখবে। কিন্তু না ও যেতে নারাজ। ওর মা টাকার জন্য ওকে ছেড়ে গেছে ,ওর মা লোভী, ও ঘেন্না করে মাকে, অভ্রকেও। এসব বলতে শুরু করল। আমি আর সেদিন ওর ভুল ভাঙাই নি। ফিরে গিয়ে আহমেদ এর সাথে আলোচনা করলাম ব্যাপারটা । আহমেদ বলল ওর এই রাগকেই আমাদের কাজে লাগাতে হবে । আমিও পরের বার গিয়ে উস্কে দিলাম শুভ্রকে। অভ্রর জন্যই তোমার মা তোমাকে ছেড়েছে , আমার বাবাকে বিয়ে করেছে। ওকে কত ভালোবাসে, তোমার কথা একবার মনেও করে না , তোমাকে সারাজীবন লাথিঝাটা খেয়ে বড় হতে হয়েছে আর অভ্রকে দেখো বিদেশ পাঠিয়ে পড়ালেখা করাচ্ছে। এভাবে ধীরে ধীরে শুভ্রর মন বিষিয়ে দিয়েছিলাম আরো বেশি করে অভ্র'র প্রতি। শেষ পর্যন্ত রাজিও করাতে পেরেছিলাম অভ্রকে খুনের ব্যাপারে। অভ্র দেশে ফেরার পর থেকেই শুভ্র ওকে ফলো করছিল। আর অভ্রর দেশে নতুন বন্ধুদের মধ্যে একজনকে শুভ্রই ঠিক করেছিল যে অভ্র'র খুব ক্লোজ হয়ে উঠবে সহজেই আর অভ্রকে সেদিন অতিরিক্ত ড্রীঙ্ক করাতে বাধ্য করবে আর ড্রাগসের ডোজ ও চেঞ্জ করে দেবে। আর অভ্র নেশার ঘোরে ড্রাইভ করতে গিয়ে নির্ঘাত এক্সিডেন্ট করবে আর সোজা ওপরে চলে যাবে প্ল্যান এমনই ছিল। কারন অভ্রর নেশা করার অভ্যেস ছিলই। তাই এটাকে কেউ মার্ডারের চোখে দেখতই না । ঠিকঠাকই হয়েছিল সব কিছু । কিন্তু অভ্র বিপত্তি ঘটায় মাঝপথে এসে বমি করে । বেশ কয়েকবার বমি করে ওর নেশার ঘোর প্রায় একদমই কেটে যায় । কিন্তু শুভ্র'র যে ওর প্রতি এত রাগ তা আমিও জানতাম না । ও পিছু পিছু ওকে ফলো করেই যাচ্ছিল। বমি করে অসুস্থ হলেও নেশার ঘোর কেটে গেছে দেখে শুভ্র পানি মেডিসিন দেয়ার নাম করে আবার এগিয়ে যায় । হাই ডোজের ঘুমের মেডিসিন আর পানিতেও কিছু ড্রাগস মিশিয়ে দেয় । অভ্র বমি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওসব কিছুই বুঝতে পারে নি আর ওসব খেয়ে ওর আবার নতুন করে ঝিমুনি আর মাথার যন্ত্রণা শুরু হয় । এই পর্যন্ত আপডেট শুভ্র আমাকে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর যে কি এমন হলো এক্সিডেন্ট এর পরে অভ্রর কাছ থেকে শুনি শুভ্রই নাকি অভ্রকে বাচাতে চেয়েছিল। এই শুভ্র কাজের কাজ তো করতেই পারে নি বরং গন্ডগোল পাকিয়ে নিজে এক্সিডেন্ট করে অসুস্থ হলো অন্য একটা ফ্যামিলিকে এদের জন্য মরতে হলো আর অভ্র'র কি হলো সামান্য চোট পেল। কৈ মাছের প্রাণ হলে যা হয়! কিন্তু অভ্র এক্সিডেন্ট এর পরে বার বার বলছিল শুভ্র ওকে বাচাতে চেয়েছে অভ্র নেশার ঘোরে ড্রাইভ করতে পারছিল না বলে শুভ্র নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে যেতে চেয়েছে । এসব শুনে আমি দুয়ে দুয়ে কিছুতেই চার মেলাতে পারছিলাম না । পরে অভ্রকে বার বার জিজ্ঞেস করার পরে জানতে পারি আমার সোনার টুকরো মিশুকে স্বভাবের ভাই ঐ কয়েক মিনিটে শুভ্র'র সাথেও খুব সহজেই মিশে গেছিল আর কথায় কথায় বলে দিয়েছে রেণু খালা তার মা না, মায়ের মতো । ওর মা মারা গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না এসব শুনে শুভ্র নিজের ভুল বুঝতে পেরে অভ্রকে বাচাতে চাইছিল। কিন্তু পুরোটা বুঝে আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম । শুভ্র সুস্থ হলে সব বলে দিলে আমি শেষ কিন্তু কোনভাবে সন্দেহ যেন আমার ওপর না আসে তাই আমি দেশেও আসি নি। অর্নিকে বলেছিলাম শুভ্রকে যে কোনভাবে শেষ করে দিতে। কিন্ত আমি যা চেয়েছিলাম কাজের কাজ তো কিছুই হলো না বরং এই অবন্তী এলো বাড়িতে। অভ্র'র প্রটেকশন আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেল । রেণু খালা আর অবন্তী দুটোই ওর পেছনে পড়ে থাকত সব সময় । অভ্র সমস্ত বাজে নেশা ছেড়ে দিল । সব দায়িত্ব নিজেই বুঝে নিল। এর মধ্যে শুভ্রর ব্যাপারে অর্নি বাবার কাছে ধরা পড়ল। আমি বুঝলাম সময় এখন আমার অনুকূলে নেই। কিছুদিন অপেক্ষা করতে থাকলাম সঠিক সময় আর সুযোগ এর। তারপর ভাবলাম অবন্তীকে সব জানানো দরকার। সব জানলে ও নিশ্চয় স্টেপ নেবে অভ্রর বিরুদ্ধে আমার আর কিছু করতে হবে না । তাই আমিই শুভ্রর ফুফুকে কিছু টাকা দিই আর অবন্তীকে সব কিছু জানাতে বলি । কিন্তু এতেও আমার ভাই সেদিনই বেরিয়ে কি করে যেন ভুলিয়ে ভালিয়ে পরের দিনের মধ্যেই অবন্তীকে নিয়ে এলো । তারপর আমি আবার অপেক্ষা করছিলাম । এরই মধ্যে অবন্তী আবার কি করে যেন রেণু খালার ব্যপারে জানতে পারল। আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম ও কি শুধু রেণু খালার ব্যাপারেই জানতে পেরেছে নাকি আমাদের দুবোনের ব্যাপারেও। ও যেভাবে রেণু খালার কথা অভ্রকে বলে দিয়েছে আমাদের কথা বলে দিলেও কপালে খারাপই আছে । সত্যি বলতে রেণু খালা অর্নির সাথে সাথে আমাকেও কিছুটা সন্দেহ করত। বার বার বলত ঘরে বাহিরে শত্রুর অভাব নেই। অভ্র হসপিটালে এডমিট হবার পর অর্নি বাড়ি গিয়েছিল কিছু কাজে সম্ভবত। তখন বাড়িতে রেণু খালাকে কোথাও না দেখতে পেয়ে ওনার রুমে যায়। রুমে অভ্রকে লেখা চিঠি দেখতে পায় অর্নি। চিঠিতে রেণু খালা জানায় সে চলে যাচ্ছে এ বাড়ি ছেড়ে তাকে যেন কেউ কোন দিন না খোজে।অর্নি প্রথমে আমাকে জানায় ব্যাপারটা । আমি ওকে বললাম এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না, চিঠি সরিয়ে ফেল তুই । আমি ভাবলাম এই সুযোগই আমাকে কাজে লাগাতে হবে, এবার সহজেই সব দোষ রেণু খালার ওপর দেয়া যাবে । যেহেতু অভ্র রেণু খালার ওপর প্রচন্ড রেগে আছে। অভ্র হসপিটালে ওকে নিয়েই ব্যাস্ত সবাই । অবন্তী একবার না একবারের জন্য হলেও একা বাড়ি আসবে। তাই আমি অর্নিকে দিয়ে লোক ঠিক করাই। আমি জানতাম অবন্তী হয়ত রান্নাঘরে যাবে না। তাই কেরোসিন এর ব্যাবস্থা ও রাখতে বলেছিলাম । বাড়ি থেকে ফায়ার এলার্ম ,ফায়ার এক্সটিং সব সরাতে বলেছিলাম ।কারণ অবন্তী মরলে আমার দুটো সুবিধে হতো ও যদি আমাদের ব্যাপারে কিছু জেনেও থাকত তা আর বলতে পারত না আর অভ্র এমনিতেই রেণু খালার এত কিছু জানার পর মেন্টালি কিছুটা সিক হয়ে পড়েছিল আর এই রেশ কাটতে না কাটতেই অবন্তীর সাথে মা'র মতো কিছু হতে দেখে নির্ঘাত পাগল ই হয়ে যাবে এটাই আমি আশা করেছিলাম । ও এত কিছু এক সাথে কোনদিনও সহ্য করতে পারবে না । ''
'
'
অভ্র এবার বলতে শুরু করে," তোর বয়ান শেষ হলে এবার আমি বলতে শুরু করি? মে আই?''
'' বল ।''
'' তোদের ইকুয়েশনে একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল লাস্ট বার। আমি রেণু খালার মুখ থেকে সব কিছু শোনার পর আর কাউকেই বিশ্বাস করতাম না । বিশ্বাস নামের কিছু যে আছে তাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম । অবন্তী বাড়ি চলে যাবার পর অর্নির হুট করে হসপিটাল আসা , আমার সাথে ভালো বিহেভ করা কোন কিছুই আমার ঠিক মনে হয় নি। এরপর আমি বাড়ি যেতে চাইলে অর্নি আমাকে বার বার আটকাতে চাইছিল । অথচ আমি এতটাও অসুস্থ ছিলাম না । আবার রেণু খালার ফোন অফ পেয়ে কিছুটা সন্দেহ যে রেণু খালাকে করি নি তাও নয়। আমি বাড়ি ফিরে দেখি অবন্তীর কোন জ্ঞানই নেই । শরীরের অনেকটা পুড়ে গেছে । ওকে ঐ অবস্থায়ই হসপিটালে নিয়ে যাই আমি। এদিকে আমাকে বাড়ি যাবার জন্যে আটকাতে না পেরে অর্নি এটা ওটা বলে বাবাকে আটকানোর চেষ্টা করছে সেটাও আমার চোখ এড়ায় নি। এ জন্য তোরা বেশ অনেক পরে ফিরেছিলি বাড়িতে। তুই চেযেছিলি সব কিছু শেষ হবার পর ফিরতে। কারণ তুই ভেবেই নিয়েছিলি ওরকম পরিস্থিতি দেখে নির্ঘাত আমি সেন্সলেস হয়ে পড়ব বা সামলাতে পারব না ব্যপারটা । কিন্তু না আমি সামলেছি ব্যাপারটা । আর তোরা হয়ত জানিস না এক সময় আমি প্রচুর সাইকোলজিক্যাল বই পড়তাম। কিছু সাইকোলজিক্যাল গেইম আমিও খেলতে পারি । আমি অবন্তীকে এডমিট করিয়েই সোজা মর্গে চলে যাই বললাম আমার একটা বেওয়ারিশ লাশ লাগবে। তারা দিতে নারাজ। পরে আমি আমার সাইক্র্যাটীস্ট রেহানা আপুকে বলি যেভাবে হোক আমাকে একটা পোড়া বেওয়ারিশ লাশের ব্যাবস্থা করে দিতে। উনি ডক্টর উনার কথা মর্গে হয়ত শুনবে । কারণ বেওয়ারিশ লাশ বেশির ভাগই মেডিকেল স্টুডেন্টসদের বোনস এর জন্য বিক্রি করা হয়। লাশগুলো গরম পানিতে সেদ্ধ করে হাড় কালেক্ট করা হয়। আমি বললাম আমি তো লাশের সাথে এত খারাপ কিছু করব না । কিনে নিয়ে ঠিকঠাক দাফন কাফনই করব। । অন্য একটা মর্গে পাই মাস চারেক পুরনো পোড়া বেওয়ারিশ লাশ এবং লাশ পাওয়ার পর আমি তোদের হসপিটালে আসার জন্য ফোন করি । সবাইকে জানাই ওকে হসপিটালে এনেছিলাম আমি কিন্তু হসপিটালে আনার আগেই মারা গেছে । যেহেতু হসপিটালে আনা হয়েছে সো পোস্ট মর্টেম করতেই হবে । এটাও আমার আর একটা চাল ছিল। আমি ইচ্ছে করে অবন্তীর একটা ভুয়া পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট করিয়ে নেই। ইচ্ছে করেই বলি মৃত্যুর কারণ যেন সুইসাইড আসে রিপোর্টে । কারণ আমি তখনো জানতাম না এসব আসলে কে ঘটিয়েছে । রেণু খালা তোরা বাবা সহ সবাইকেই আমার সন্দেহ হয়েছিল । আমি জানতাম পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে যদি মার্ডার আসে তো যে আসল খুনি সে কিছুতেই বিচলিত হবে না । কারণ খুন যে করতে চেয়েছিল তার অবশ্যই শুধু প্ল্যান এ থাকবে না । প্ল্যান বি ও থাকবে। অর্থ্যাৎ পুলিশ কেস করলে কি করে ধামাচাপা দিতে হবে সে অবশ্যই সে প্ল্যান করে রাখবে । কিন্তু আমি তাদের প্ল্যান বি ভেস্তে দিলাম। নিজেই প্ল্যান সি তৈরি করলাম যে ব্যাপারে তারা কোন দিন ভাবতেই পারে নি । আমি রিপোর্ট তৈরি করিয়ে নিলাম সুইসাইড এর। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এ কান্ড ঘটিয়েছে সে অবশ্যই জানে এটা সুইসাইডাল কেস না। সো ...সে অবশ্যই বিচলিত হবে। সবার সামনে ঠিকঠাক থাকলেও মনে মনে এ ব্যাপারে ঠিকই সন্দেহ হবে। আর অর্পিপু তুই ধরা দিলি! আমি পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট সবাইকে আলাদা আলাদা করে দেখিয়েছি। আর রিপোর্ট দেখে তুই সব চেয়ে বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিলি তা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম । আমি তোকেই তারপর থেকে সব চেয়ে বেশি ফলো করতাম। আহমেদ ভাইকে যখন ফোনে এসব বলছিলি আমি সব শুনে নিয়েছিলাম রে। কিন্তু আমি শুধু সময়ের অপেক্ষা করছিলাম । কারণ অবন্তী খুব অসুস্থ ছিল ওর শরীরের প্রায় ত্রিশ ভাগই পুড়ে যায় । আমার বাচ্চারাও অক্সিজেন পাচ্ছিল না ঠিক মতো । বাচ্চাদের জন্য ওর সার্জারি করতেও সাহস পাচ্ছিল না ডক্টর । আয়নায় মুখ পর্যন্ত দেখতে পারতো না। আমি ওর জন্য আলাদা বাড়ি ঠিক করলেও রেহানা আপু ওকে ওনার বাড়ি নিয়ে যায়। বাড়ির সমস্ত আয়না সরিয়ে ফেলা হয় ওর জন্য । আমি সারাদিন ওর কাছে বসে রইতাম । রাতেও চলে যেতাম বেলকনি বেয়ে। প্রায় সারাদিনরাত ও কান্নাকাটি করত আমার বুকে মাথা গুজে। এরপর আমাদের জীবনে নিলাভ্র আর নীলাদ্রিতা এলো । অবন্তীর কান্না একটু হলেও কমলো। তবুও যখনই নিজের পোড়া চেহারার কথা মনে হতো, পোড়া হাতগুলো দেখত আবার কান্নাকাটি শুরু করত। বাচ্চারা কাদলেই ভাবতো ওকে দেখে ভয় পেয়ে কাদছে। বাচ্চাদের কোলে নিতে চাইত না । আমি সামলাতাম ওদের বেশির ভাগ সময় । এরপর ওর সার্জারি হলো । পুরোটা ঠিক না হলেও আগের চেয়ে কিছুটা ঠিক হয়েছে ।''
'
'
'' অভ্র এবার আমার মনে হয় কিছু বলার আছে । আপনাদের সবারই কৌতূহল একটাই যে আমি কি করে বুঝলাম রেণু খালার ব্যাপারটা তাই না? আসলে অভ্র যেদিন আমায় সবটা খুলে বলে সেদিন আমার বেশ কিছু ব্যাপারে খটকা ছিল ওর কথার মধ্যে । আমি ওকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । কারণ ওর সেই অকারণে মিথ্যা বলার অভ্যেস । ও এত বমি করল অথচ নেশা কাটল না আবার হুট করে শুভ্রর চলে আসা শুভ্রর হ্ঠাৎ ই মিশন ক্যান্সেল হওয়া মিশন ক্যান্সেল হলো তবুও আমাকে বলল না সব কিছুই যে কাকতালীয় আমার কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না । সেদিন রাতেই আমি নিজেই ঠিক করি আমাকে কিছু খোজ খবর নিতে হবে । আমি শুভ্র'র হেডকোয়ার্টার থেকে জানতে পারি ওর কোন মিশন ছিল না । আমার সন্দেহ তখন আরো বেড়ে যায় । বার বার মনে হচ্ছিল অভ্র আবার আমাকে কোন মিথ্যে বলছে না তো । আমি ওর সাইক্র্যাটীস্ট রেহানা আপুর কাছে যাই । কারণ উনি তো ওর ডক্টর । হয়ত ডক্টর কে সব সত্যি বলেছে। কিন্তু আপুর থেকেও জানতে পারলাম ওনাকেও অভ্র এসবই বলেছে। আর আপু নিশ্চিত তার প্যাশেন্ট তাকে সত্যি বলেছে। কারন বাবাও আপুকে এসবই বলেছিল। আমার যে যে বিষয়ে সন্দেহ ছিল আমি আপুকে । উনিও বললেন তারও সন্দেহ আছে এসব ব্যাপারে। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম শুভ্রর ভেতরে খটকা আছে কিন্তু কি খটকা তা আমরা বুঝে উঠতে পারি নি। এছাড়াও আপু আমাকে আরো একটা ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিল তা হলো রেণু খালা। উনি বলেছিলেন এই মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ব্যাপারটা কেমন অন্য রকম না? আর অভ্র যে ওর মা কে মেরে ফেলে নি তা সবার প্রথম কেবলমাত্র দুজন বিশ্বাস করেছিল অভ্র নিজে আর তোমাদের রেণু খালা। এই ব্যাপারটাও একটু চিন্তা করতে পারো । এরপর রেণু খালা যখন তার বসন্তের পুষ্প ধারণের কথা বললেন আমি রেহানা আপু কে সে কথাও জানিয়েছিলাম। উনিই আমাকে বলেন হয়ত অভ্রই তোমার রেণু খালার সেই পুষ্প। অথবা অন্য কোন পুষ্পের জন্য অভ্রকে ব্যাবহার করেছে। আর এই দুটোর যে কোন কারণেই উনি তোমার শাশুড়ি মা কে মেরে ফেলেন। উনিই আমাকে পরামর্শ দেয় অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার। ঢিল গর্তে পড়লে পড়ল না পড়লে কি আর করার ক্ষমা চেয়ে নেব। কারণ বেশ অনেক যুক্তিই আমাদের ছিল রেণু খালার বিরুদ্ধে। কিন্তু আমাদের নিশানা ঠিক না হলেও ঢিল গর্তেই পড়েছিল। আমাদের অন্দাজ করা ব্যাপারে না হলেও রেণু খালা অন্য কারণে ঠিকই মাকে মেরেছিল । ''
'
অভ্র মাথা নিচু করে বলে,'' রেণু খালাকে আমি অনেক খুজেছি কিন্তু পাই নি। ''
'' রেণু খালাকে তুই কোন দিন পাবিও না অভ্র।''
'' কেন পাব না শুনি?"
'
অর্নি অভ্রর হাতে রেণু খালার চিঠি তুলে দেয়।
'' অভ্রনীল,
জানি আর কোন দিনও তুমি আমাকে আগের মতো ভালবাসতে পারবে না । আমাকে খোজার চেষ্টা কখনো করো না । পাবে না হয়ত। হয়ত শুকনো বকুলের মতোই পড়ে রইবে ফুলের রেণু। যদি মনে করো পুলিশের ভয়ে পালিয়েছি তবে সেটা তোমার ভুল।
আর শুভ্রর ব্যাপারে তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ বলো, অভিমান বলো কিছুই নেই। আমার তোমার প্রতি বিশ্বাস আছে আর থাকবে। অনাগত সন্তানকে নিয়ে সুখি হও। আফসোস ওদের মুখ দেখতে পারলাম না! ওদের অনেক আদর দেবার ছিল দিতে পারলাম না । আমি আমার শুভ্রকেও শেষ দেখাটুকু দেখতে পারলাম না।
আর হ্যা আমাকে কোন দিনও ক্ষমা করো না।''
'
অভ্র চিঠিটা পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দেয়।
অর্পি ,অর্নি ,মাহমুদকে পুলিশে দেয়া হয় । তবে আহমেদ দেশের বাহিরে থাকায় ওর ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা রয়ে গেছে ।
'
'
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে রয় ওরা দুজন। কৃষ্ণচূড়া গাছ বেয়ে উঠে গেছে নীলা অপরাজিতার লতা ।অভ্র সাদা পাঞ্জাবি পাজামা। অবন্তী লাল পাড় সাদা শাড়ি। ঠিক এমন বেশেই কৃষ্ণচূড়ার পথ ধরে হাটার কথা ছিল ওদের।
'' অভ্রনীল । ''
'' হুম''
'' একটা কথা সত্যি করে বলবেন?"
" না মিথ্যে বলব''
'' আবার?"
'' আমি তো জানি তুমি কি প্রশ্ন করবে। এতদিন ধরে এত বার এ উত্তর দিয়ে যাচ্ছি তবু তোমার বিশ্বাস হয় না?"
'' হয়। তবুও শুনতে ভালো লাগে ।''
'' বিশ্বাস করো তোমার এ চেহারায় আমার কিচ্ছু এসে যায় না। কিচ্ছু না । আমি ভালোবাসি আমার পরী বৌ। আমার বৌ আমার কাছে পরীর মতোই সুন্দর''
'' হ্যা পোড়া পরীর মতো ।''
'' পরীরা কখনো পোড়ে না। পরীরা আগুনের শিখার তৈরি।আর আমাদের ভালোবাসা পোড়া ভালোবাসা। পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হওয়া ভালোবাসা।''
'
'
অবন্তী বলতে শুরু করে,
''কৃষ্ণচূড়া,
শুধুই কি একটা ফুলের নাম?
নাকি আবেগ মিশ্রিত কোন রঙের নাম?
আমার সাদা শাড়ির ওপর রক্ত রঙা পাড়
সেই পাড়ে'তে লুকিয়ে আছে তাহার ভালোবাসা অপার।
ঐ নয়নের ছোট্ট কোণে এক দীঘি জল,
সেই জলেতেই ছিল বুঝি ভালোবাসা অতল।
কৃষ্ণচূড়ার রঙেতে আজ ছেয়েছে সারা পথ,
সেই পথেতে , সেই রঙেতে , সেই শাড়িতে ,
আনমনেতেই ভাবি,
মনে কি আজো পড়ে তোমার সেদিনের সে শপথ?"
'
অভ্র মুচকি হেসে বলে,
'' সেদিনের সে শপথ?
কৃষ্ণচূড়ায় রাঙানো সেই পথ?
ভুলতে পারি পৃথিবী , ভুলতে পারি জগত
কি করে ভুলব বলো আমার করা শপথ?
এ জগতে কে আর আছে আমার পরিপূরক?
আমরা দুজন দুজনার পরিণয়ের পরিপূরক''
'
লাল টুকটুকে পাঞ্জাবি পড়া নিলাভ্র বুক পকেটে কিছু কৃষ্ণচূড়া কুড়িয়ে নিয়ে রেখে দেয় আর লাল টুকটুকে ফ্রক পড়া নীলাদ্রিতা অপরাজিতার লতার সব চেয়ে নিচের অপরাজিতা নিজের হাতের মুঠোর নিয়ে নেয়। অবন্তীর খোপায় কৃষ্ণচূড়া গুজে দেয় অভ্রনীল । অবন্তীর এক হাত ধরে নিলাভ্র আর নীলাদ্রিতা হাত ধরে ওর বাবার। অবন্তীর অন্য হাত শক্ত করে ধরে অভ্রনীল । বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে কৃষ্ণচূড়ার লাল গালিচায় ছাওয়া পথে সুদূর সামনে এগিয়ে যায় ওরা চারজন। অভ্র আর অবন্তীর হাত আজ পূর্ণতায় পূর্ণ। দুহাতে যেন কৃষ্ণচূড়ার দুটো লাল টুকটুকে পাপড়ি। পরিণয়ের পূর্ণতা যেন কৃষ্ণচূড়া হয়ে ফোটে প্রতি বসন্তে। আর বসন্ত আসে প্রতি মূহুর্তে।
.
.
.
সমাপ্ত.........................