অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৬৭ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


‌ভিনা আন্দাজ করেছিলো কী হতে পারে,তাই যতটা শকড হওয়ার কথা ছিলো,হয়নি।প্রেগন্যান্সি কিটের দুই লাল দাগ স্পষ্ট জানান দিচ্ছে বাস্তবতার কথা।অদ্ভুত হলেও অসচেতন মনে ভিনা চাচ্ছিলো রেজাল্ট পজিটিভ আসুক,শুধুমাত্র দেখার জন্য,এরপর যাবির কী করে।অন্য দশটা ছেলের মত ওকে ছেড়ে যায়,নাকি সেই ছেলেগুলোর চেয়ে ভিন্ন হয়ে শক্ত করে হাত ধরে।কিট ফেলে দিয়ে,ভিনা হট শাওয়ার নেয়।এরপর ধীরে সুস্থে ফোন নিয়ে যাবিরের নাম্বার ডায়াল করে।প্রেগন্যান্সি টেস্টের সময় ভয় লাগেনি।কারণ যা ঘটেছে,সেটার কন্সিকোয়েন্স থাকবেই। কিন্তু এখন প্রচন্ড ভয় লাগছে,কারণ যাবির যদি ওর হাত ছেড়ে দেয়,তাহলে জীবনের প্রতি যে অভিমান জন্মাবে,সেটা নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না।

-হ্যালো..

-হ্যাঁ, হ্যালো....রেজাল্ট কী ভিনা?

-পজিটিভ।এই এম এক্সপেক্টিং।

-হাহ্!শিওর তুমি?

-হ্যাঁ, দুইটা লাল দাগ এসেছে,দ্যাট মিনস পজিটিভ।

-কিটের উপরই একদম ভরসা করা উচিৎ হবে না।তুমি কালকে বের হবে কিছু একটা বলে।আমরা হস্পিটালে যাবো।ঠিকাছে?

-সেখানেও যদি পজিটিভ আসে?

-যদি না আসে?

-আসবে যাবির।আমার শরীর,আমার বাচ্চা,আমি বুঝি।

-তবুও তুমি কালকে বের হবে। আমরা যাবো হস্পিটালে। 

-উত্তর দিলে না এখনো,পজিটিভ আসলে কী করবে।

-জানি না।আগে আসো তুমি।

-আমি কিন্তু এ্যবোরশন করাবো না যাবির।

-তাহলে?

-আমাকে বিয়ে করবে তুমি।কথা দিচ্ছি,আলাদা বোঝা হবো না আমি যতদিন না নিজের পায়ে দাঁড়াবে। 

-এসব কথার সময় এখন না ভিনা।কালকে আসো আগে।রাখি আমি।

ভিনা ফোন রেখে উপরের দিকে তাকালো।নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে।কেউ যেন ধারালো কিছু দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলছে সব।কয়দিন পর এইচএসসি পরীক্ষা,এরি মাঝে আসলো আনওয়ান্টেড প্রেগন্যান্সির খবর।ভিনা জানে না সামনের দিনগুলো কেমন হবে।কয়দিন আগেও ভবিষ্যৎ বলতে চোখের সামনে কিছু দৃশ্য ভেসে উঠত,এখন ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই দেখছে না।সব অনিশ্চিত।খুব আবেগ নিয়ে বলেছিলো এই বাচ্চা ও এবোর্ট করবে না,কিন্তু এই বাচ্চা জন্মানোর পর কী হবে?


-বাবা আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।

-কোথায়?

-কিছু নোটস আনতে। সামনে পরীক্ষা।

-তাড়াতাড়ি এসে পরিস মা।ফিরে আসিস। 

ভিনা শেষের কথাটা শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সোহেলের দিকে।সোহেল সেদিকে খেয়াল না করে মুনার জন্য ঔষধ আর পানি আনতে গেলো।সোহেল ছাড়া কারো কাছেই মুনা কিছু খায় না।ভিনা যদি সেদিন উপলব্ধি না করাতো,সোহেল এভাবেই ফেলে রাখত মুনাকে।মেয়েটা যে কবে এত বড় হয়ে গেলো!

ভিনা মলিন সুতির একটা সালোয়ার কামিজ পরে বের হয়েছে।চোখে মুখে ক্লান্তি।কলোনির সেই পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ভিনা।এই পুকুর পাড়েই কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।এখান থেকে কত গল্প,কত পথচলার শুরু হয়েছিলো।সময়ের ব্যবধানে সবকিছু যেন ধোয়াশা হয়ে গেছে।কিছুই করার নেই দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া।

-ভিনা...

যাবিরের ডাকে পেছনে ঘুরে তাকালো ভিনা।হাঁপিয়ে গেছে কোনো কারণে।

-কী ব্যাপার,এমন লাগছে কেন?

-কিছু না।চলো তুমি।

‌যাবির সময় না নষ্ট করে রিকশা ঠিক করলো।দামাদামি না করেই উঠে গেলো।যাবিরের এই অস্থিরতা ভিনার ভালো লাগছে না।আবার আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে যেখানে হাতের উপর হাত রেখে ঘন্টা পার হয়ে যেত।

এবারো রিকশায় ওঠার পর কোনো বাক্য বিনিময় হলো না দুইজনের মাঝে।কিন্তু এই নীরবতা ভীষণ ভারি,ভীষণ একাকীত্বে ঠাসা।ভিনা অপলক দৃষ্টিতে যাবিরের দিকে তাকিয়ে আছে।কয়েকদিনে আগেও মনে হত পুরো পৃথিবীই হলো এই মানুষটা,আর এখন একে পৃথিবীর বাইরে,অন্য জগতের কেউ মনে হয়।সাধারণ কোনো অপরিচিত মানুষকেও এতটা অপরিচিত লাগে না,যতটা চেনা মানুষ অচেনা হয়ে গেলে লাগে।কারণ তখন মনে নানা প্রশ্ন থাকে,যেগুলোর উত্তর প্রায়শই পাওয়া যায় না।এই নিরত্তর প্রশ্নগুলো খুব কাছের মানুষকে ঠেলে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়,যেই দূরত্ব কখনোই আর পূরণ হয় না।ভিনা জানে,এই হাত একবার ছুটে গেলে,আর কখনো এক হবে না,কখনো না।


রিসিপশনে টেস্টের পেমেন্ট করতে গেলে রিসিপশনিস্ট জিজ্ঞেস করে

-পেশেন্টের নাম

-ভিনা ইনজামাম।

-মিসেস ভিনা ইনজামাম,রাইট?

-হুমমম....

যাবির কথাটা বলেই ভিনার দিকে তাকালো।সেই চোখের আকুলতা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে,কত ভালোবাসা আর স্বপ্ন জমা রয়েছে সেই চোখে।
সেগুলো আয়ত্তে না নিয়ে বেশ নিরুত্তাপ গলায় বললো,চলো।

ভিনা টেস্ট করে বাসায় এসে পরলো।রিপোর্ট সন্ধ্যায়ই এসে পরবে।ভিনা ভালোমত জানে রিপোর্টে কী আসবে।তবু অপেক্ষায় আছে।

সন্ধ্যার পরপরই যাবিরের ফোন আসলো-

-হ্যালো?

-রিপোর্ট এবারো পজিটিভ এসেছে।

-এখন?
.
.
.
চলবে.................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন