অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৫৬ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


যাবির ভিনার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।দুই বছর যার সাথে ঠিকভাবে কথা বলার ও সুযোগ পায়নি,তার সাথে যে উষ্ণতার বিনিময় হয়েছে,সেটা ভবিষ্যতে কী প্রভাব ফেলবে জানে না।ভিনা বাস্তবতার কাঠিন্যে ভেঙে গিয়েছিলো,যে আশ্রয় ও যাবিরের কাছে চেয়েছিলো,সেটা ছিলো খুবই অযৌক্তিক।গত রাতের ভিনা আর আজ সকালের ভিনা যে এক হবেনা সেটা ভালোভাবে জানে যাবির। ঘুম থেকে ওঠার পর কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে,সেটা নিয়েও শঙ্কিত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে রেডি হয়ে ফার্মেসি তে গেলো যাবির।যতটা দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরলো।ভিনা তখনো ঘুম।পাশের ঘরে যাবিরের মা ও শুয়ে আছে।আস্তে করে ফ্রিজ থেকে ডিম নিয়ে ভেজে পাউরুটি নিয়ে রুমে গেলো।

-ভিনা,একটু ঘুম থেকে উঠো।

ভিনাকে ডাক দিয়ে যাবির অপেক্ষা করতে থাকলো,এখনি মনে হয় মেয়েটা উঠে কান্না করবে,ঘৃণার দৃষ্টিতে যাবিরের দিকে তাকাবে,অভিশাপ দিবে।কীভাবে সেটা সহ্য করবে,সেটাই ভাবছে যাবির।ভিনা ঘুম থেকে উঠে যাবিরের দিকে তাকালো।যাবির নিজের একটা শার্ট ভিনার দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো।

-যাবির?

-হুম?

ভিনা চুপ করে থাকলো।পুরো চেহারায় অন্যরকম উজ্জ্বলতা,খোলা এলোমেলো চুলে মায়াবি লাগছে ওকে।মাথা নিচু করে আছে।

-চলো,নাস্তা করে নেই।

গতরাতের ঘটনা নিয়ে কেউ কোনো কথা বললো না।যাবিরকে অবাক করে দিয়ে ভিনা খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করলো। যাবির নিজের হাতে নাস্তা খাইয়ে দিলো ভিনাকে।কিন্তু পিল দিতে পারলো না,আড়ষ্টতা কাজ করলো ভীষণ। 

-বাসায় যাবে?

-না....এক রাত বাইরে থেকে আর কীভাবেই বা যাবো বলো।

-চিন্তা করবে তো বাসায়। 

-যেই অপবাদ দিয়ে বের করা হয়েছিলো,তার চেয়ে বড় অপরাধ নিয়ে বাসায় ঢুকতে পারবো না। 

যাবির নরমালি কথা বলতে পারছে না।ভীষণ অপরাধী লাগছে নিজেকে।কিছুক্ষণ দুইজন চুপ থাকার পর ভিনা উঠে ওয়াশরুমে গেলো।এই ফাঁকে ব্যাগের ভেতর যাবির পিল রেখে দিলো।ফ্রেশ হয়ে এসে ভিনা বললো

-আমি বের হই।

-কোথায় যাবে?

-জানি না।

-এমন বললে তো চলবে না।বলো কোথায় যাবে?

-আমি সত্যিই জানি না যাবির।

-হোস্টেলে উঠবে?

-বিভিন্ন ফর্মালিটিস লাগে।কে পূরণ করবে?

-খোঁজ নেই।তানভির কে বলি....

তানভির নাম শুনে ভিনার নওমির কথা মনে পরে গেলো।নওমিকে আসলেই ভিনা অনেক বিশ্বাস করত,ভালোও বাসত।বোনের চেয়ে কখনো কম মনে করেনি।ভিনা এটা অস্বীকার করে না যে নওমি এক সময় অনেক করেছে।কিন্তু সময় এমন ভাবেই সব বদলে দেয় যে,রাস্তার অচেনা মানুষের চেয়েও বেশি দূরত্ব হয়ে যায়।

-তানভিরের সাথে তো তোমার তেমন ক্লোজ ফ্রেন্ডশিপ নেই।

-কিন্তু ও অনেক হেল্পফুল।

-আমার থাকার বিষয়ে কী করতে পারবে উনি?

-মালিহা আপু পারবে।

-হুট করে অচেনা একটা মেয়েকে উনি হেল্প করবে?

-কাছের মানুষ ফেলে দিতে পারলে বাইরের মানুষ হাত বাড়িয়ে দিতেই পারে,আশা রাখতে ক্ষতি কী?

-হুমম,বের হই চলো।

খুব সাবধানে যাবির ভিনাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো।তানভিরের সাথে পুরো ব্যাপারটা শেয়ার করলো।তানভির আশ্বাস দিলো কিছু করার।দুপুরের দিকে মালিহা নিজেই ফোন দিলো যাবিরকে।জানালো ওর পরিচিত এক ফ্রেন্ডের সাথে শেয়ার করে থাকতে পারবে।সেই ফ্রেন্ড নিজের মামার ফ্ল্যাটে থাকে,মামা থাকে বাইরে। তবে খরচের ব্যাপারে কিছু বললো না।বিকালে সেই বাসায় এসে দেখা করতে বললো।দুপুরে বাইরে থেকে খেয়ে যাবির ভিনাকে নিয়ে গেলো মালিহার বান্ধবীর বাসায়।রিকশায় হুড তুলে ভিনা শহর দেখতে লাগলো।কিন্তু যাবিরের দৃষ্টি ভিনায় আবদ্ধ।ভিনা চাইলেই যাবিরকে চরিত্রহীন সুযোগ সন্ধানী বলতে পারত,কিন্তু বলেনি।যাবির জানে ভিনা এখন কিছু বলবে না।গতরাতে যাই হয়েছে,দুইজনের কেউই ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি।তবে এখন থেকে যদি যাবির সামান্যতম নিজের মাঝে পরিবর্তন আনে,ভিনা ওকে ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিতীয় বার ভাববে না।কারণ একদিনের ব্যবধানে ভিনা সম্পূর্ণ বদলে গেছে।পরিবারের সাথে বন্ধন ছুটে গেছে,যেই ভুলের ভয়ে যাবিরের সাথে ঠিকভাবে যোগাযোগ করেনি,সেই ভুল করে নিজেকে একদম পাথর বানিয়ে রেখেছে।জীবনে যা যা ভয় ছিলো,সবকিছু মাত্র একদিনের মাঝেই ফেস করে ফেলেছে ভিনা।যাবিরের মনে হচ্ছে,সম্পর্ক টা একটা অনিশ্চয়তার মাঝে পরে গেছে।


তিন রুমের বড় ফ্ল্যাট।সিকিউরিটি বেশ ভালো।যাবিরের পরিবেশ খুবই পছন্দ হলো।মালিহার সেই বান্ধবীর নাম প্রিতি। ছোটখাটো অমায়িক একজন মানুষ। কেউ দেখলে ধর‍তে পারবে না বয়স কত।সে ভিনার সাথে এমনভাবে কথা বলতে লাগলো যেন কতদিনের চেনা।

-বুঝছো,এখানে কোনো সমস্যা হবে না তোমার।সামনে তো পরীক্ষা,তুমি আরামসে পড়াশোনা করতে পারবে। 

-আপু.....মানে আমি কন্ট্রিবিউট করবো কত জানালে ভালো হত।

-শুধু খাবার খরচ দিলেই হবে।

-শিওর আপু?আপনি বলুন আমাকে,আমি ব্যবস্থা করে নিবো....

-আরে মালিহার হবু জামাইর পরিচিত তুমি,তোমার থেকে কীভাবে নেই,মালিহা মেরেই ফেলবে।

-আমি ঠিক বুঝিনি আপু।

-তানভিরের কথা বলছি,তুমি তানভিরের পরিচিত না?

-হ্যাঁ.... 

ভিনা প্রথমে কিছু মেলাতে পারছিলো না।তার মানে নওমির সাথে তানভিরের আর কোনো সম্পর্ক নেই?আর মালিহা তো তানভিরের চেয়ে বড় বয়সে,তাও কীভাবে তানভির এই সম্পর্কে আগালো?কিছুই বুঝতে পারছিলো না।পাশে যাবির সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো।সাথে মাথায় এটাও আসলো যে এই বিষয়টা ভিনা কখনো ভালোভাবে নিবে না।এর রেশ ধরেই যদি যাবিরকে ভুল বুঝে?

-যাও রেস্ট নাও।আর এইযে তুমি,যামির.. 

-যাবির আপু..

-স্যরি স্যরি,যাবির,তুমি কী হও ভিনার?

-গার্জিয়ান।

পাশ থেকে ভিনা বললো।

-সময় করে সব বলবো আপু।তবে আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবো না।

-আরে ধুর পাগল মেয়ে।মালিহা আমাকে জানিয়েছিলো তোমার ব্যাপারে।আমি বুঝি ব্যাপারটা।
এখন যাও রেস্ট নাও।

সব ঠিক ঠাক করে দিয়ে যাবির চলে গেলো।জানালো কালকে আবার আসবে।ভিনা মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে বললো।


গতরাত থেকে সোহেল ঘুমাতে পারছে না।প্রেশার হাই হয়ে আছে।মেয়েটা কোথায় আছে কেমন আছে কিছুই জানে না।কোথায় খোঁজ নিবে,সেটাও বুঝতে পারছে না।পুলিশ কম্পলেইন ও করা যাবে না,কারণ সে নিজেই মেয়েকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে,আর বড় কথা হলো এটা ছেলে ঘটিত ব্যাপার। আরেকটা বিষয় যেটা ভাবাচ্ছে সেটা হলো মুনার আচরণ।সে দিব্যি খাওয়া দাওয়া করে মায়ের সাথে গল্প করে সময় কাটাচ্ছে।সামান্য চিন্তার ছাপ নেই চোখে মুখে।যদি সত্যিই সে ভিনাকে আপন করে নিত,তাহলে একটাবার হলেও কি বলা উচিৎ ছিলো না যে 'তুমি মেয়েকে এভাবে ঘর থেকে বের করে ঠিক করোনি',অথবা ওর খোঁজ নিত না?ভিনাকে বের করে, কোনো ভুল করেনি তো?
.
.
.
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন