দিন চলে যায়,বেঁচে না থাকার মত সময়গুলোও পার হয়ে যায় ধীরে ধীরে।ভিনা হোস্টেলে উঠেছে ষোলো দিন হয়ে গেছে।প্রতিদিন যাবির এসেছে দেখা করতে।যদিও হোস্টেল যাবিরের বাসা থেকে বেশ দূরে।কখনো বাজার নিয়ে এসেছে,কখনো এমনিই দেখা করেছে।যাবির নিজেই নীলক্ষেত থেকে বই কিনে এনে দিয়েছে।মন খারাপ থাকুক,পরীক্ষা খারাপ হোক,কিন্তু পরীক্ষা দিতেই হবে ভিনাকে।যাবিরের নিজেরও ফাইনাল ইয়ার,পড়াশোনার প্রচন্ড চাপ।তবু,দায়িত্ব পালনে কোনো কমতি রাখছে না।ভিনা যতটা সম্ভব চাপিয়ে চলছে।এক বেলা ডিম ভেজে ভাত খেয়ে নেয়,আরেক বেলা কোনো ফল,রাতে কিছুই খায় না।হাতের টাকা যেন শেষ না হয়,সেটার আপ্রাণ চেষ্টা। যাবিরের উপর কোনো চাপ এই মুহূর্তে দিতে চাচ্ছে না ভিনা।এমনিই বই কিনে এনে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে।
সারাদিন বই নিয়েই সময় চলে যায় ভিনার।রাতে প্রিতি এসে সারাদিনের গল্প করে।প্রিতির বাবা নেই,মা অন্য জায়গায় বিয়ে করে সেটেল্ড।প্রতিমাসে ভালো এমাউন্টের টাকা *দায়িত্ব* এর নাম দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।সেই টাকায় মামার ফ্ল্যাটে থেকে বেশ ভালোই জীবন কেটে যাচ্ছে।শুধু একটাই অভাব,কথা বলার মানুষের। অনেকের ধারণা ছন্নছাড়া জীবন মানেই কষ্টের জীবন।পরিবার ছাড়া,অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ছাড়া এই জীবন সবার কাছেই করুণার এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু ভিনার বিন্দু পরিমাণ আক্ষেপ নেই।প্রতিদিনের মানসিক অশান্তির চেয়ে এই জীবন অনেক ভালো।কাছের মানুষের কাছে তীব্র কষ্ট পাওয়ার চেয়ে,দূরের কারো থেকে ভালোবাসা অনেক ভালো।হোক সেটা ক্ষণিকের,হোক সেটা লোকদেখানো,হতে পারে দিনশেষে এরা কষ্ট দিবে।তবুও,সেটা মেনে নেয়া যাবে।অন্তত আক্ষেপ থাকবে না, কারণ এরা আপন ছিলোও না।আর দুই মাস পর ভিনার পরীক্ষা,এরপর এই শহরেই থাকার ইচ্ছা নেই।কিন্তু যদি যাবির আটকে ফেলে,তাহলে হয়ত এই শহরেই নতুন ঠিকানা হবে ভিনার,যাবিরের ঘরে।আজকাল স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়,তাই এই স্বপ্নও সেভাবে দেখার সাহস পায় না।
ভিনা প্রায়ই অবাক হয়।কখনো ভাবেও নাই যে ওর মা এভাবে মারা যাবে,কখনো ভাবেনি ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করবে,কখনো ভাবেনি যে ওর বাবা ওকে ভুলে যাবে।কিন্তু এসবকিছু হয়েছে।আবার ভিনা এটাও ভাবেনি যে কেউ ওর জীবনে আসবে,অথবা এই শহরে খুব সহজেই থাকার জায়গা পেয়ে যাবে।কিন্তু এগুলোও হয়েছে।তাই আজকাল আর ভাবে না।শুধু জীবন যেভাবে চলছে,সেভাবেই চলতে দেয়।কারণ শেষ পর্যন্ত জীবনে তাই হবে,যা হওয়ার ছিলো।আক্ষেপ করে যন্ত্রণা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই।
•
মাত্র দুই সপ্তাহর ব্যবধানে সোহেলের বয়স যেন বেড়ে গেছে কয়েক বছর।চোখের নিচে কালি,চাপা ভাঙ্গা।মেয়ের জন্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে প্রতিনিয়ত। প্রায়ই মনে হয়ে শিউলি ওর পাশে বসে আছে,মুখ ফিরিয়ে,প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে।এর মাঝে মুনার আচরণ খুবই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।ভিনার চলে যাওয়ায়,কোনো অনুতাপ নেই।বরং আগের চেয়ে আরো প্রাণোচ্ছল। নিজের বাচ্চার জন্য অনলাইনে কেনাকাটায় ব্যস্ত,সারাদিন নিজের ঘরে শুয়ে বসে কাটাচ্ছে দিন।একদিন সোহেল সহ্য না করতে পেরে বলেই ফেললো....
-ভিনা কোথায় আছে? তোমার মনে পরে না ওর কথা?
-ও তো যেতেই চেয়েছিলো।ভালোই আছে হয়ত।
-ছেলে যদি খারাপ হয়?ওকে ভালো না রাখে।
-গয়না নিয়ে গেছে।বেঁচে টেচে ভালোই যাচ্ছে দিন।কয়দিন পর যদি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলে ঠিকি এসে পরবে,তোমার এসব নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না।
-এসব বলতে তোমার লজ্জা লাগে না মুনা?
-সত্যি কথা বলছি,লজ্জা কেন লাগবে?ও কি কচি খুকি যে কিছু বুঝে না?
-রুপিনের সাথে কথা হয়েছিলো?
-যে বিষয়ে নিজের বলতে লজ্জা লাগে সে বিষয়ে কীভাবে আমাকে দিয়ে বলাও?কমন সেন্স নেই তোমার?আর হ্যাঁ, তোমার সেই রুপিন বিদেশ গেছে।জীবনও হয় মানুষের।হাজবেন্ড মারা গেছে তো কী হয়েছে,লাক্সারি দিয়ে গেছে।আর কারো কপাল হয় আমার মত।সতিনের ঘরের বাচ্চা নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়।যত্তসব!
-মুখ বন্ধ রাখো মুনা,নাহলে আমার...
-নিজের মেয়ের গায়ে হাত তুলতে পেরেছো,আর আমি তো দূরেরই।তুলো হাত।
-বাচ্চাকে ঢাল বানিয়ে ভালো করছো না মুনা।ফল ভালো হবে না।এই বাচ্চা নিয়ে তুমি কখনো সুখী হতে পারবে না।
-এই বাচ্চা মানে?এটা তোমার ও বাচ্চা সোহেল!
সোহেল দরজা লাগিয়ে চলে গেলো।সব এলোমেলো আর বিষাক্ত লাগছে। কী করবে বুঝতে না পেরে শেষে ভিনার রুমে ঢুকলো সোহেল।কথায় আছে বাড়িও নাকি মারা যায়। এখানে যেন একটা ঘর মরে গেছে।ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে সোহেল কান্না করে দিলো।হাজার হোক,নিজের মেয়েকে রাগের মাথায় হলেও এভাবে রাতে বের করে দেয়া উচিৎ হয়নি।কোথায় আছে,কেমন আছে কিছুই জানে না বাবা হয়ে। এত অসহায় আর ছোট মনে হচ্ছে যে বেঁচেও থাকতে ইচ্ছে করছে না।চোখ মুছে পুরো ঘর খুঁজতে লাগলো সোহেল,যদি কোনো কিছু পায়,যেখানে ঐ ছেলের সম্পর্কে তথ্য আছে।সবশেষে একটা ডায়রি পেলো।আর টেবিলের নিচের ধুলো পড়া একটা চিরকুট।
.
.
.
চলবে.................................................