-একটু শক্ত থাকতে হবে আপনাকে। জানি খুব কষ্ট হবে। তবুও মেনে নিতে হবে ভাগ্যকে।
-কী বলছেন এসব!হয়েছে কী!আমার বাচ্চার কিছু হয়েছে?
-শান্ত হন। কিছু হয়নি।আপনার রেস্ট নিতে হবে একটু।
ডাক্তার কথা না বাড়িয়ে নার্সকে ইশারা করলো।নার্স এনেস্থেসিয়া রেডি করে মুনার পাশে এসে দাঁড়ালো।
-হচ্ছে টা কী!!কী হয়েছে আমার?আমার তো ডেলিভারির সময় হয় নাই।আমাকে কেন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে আসা হলো!
-শান্ত থাকুন।
-চুপ থাক তুই!
মুনা পাশে থাকা নার্সের দিকে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
ডাক্তার আবার ইশারায় কী যেন বললো।নার্স শুধু মাথা নাড়ালো।ডাক্তার এবার নিজে আসলো মুনার সাথে কথা বলতে।
-আমি আপনাকে আর শান্ত হতে বলবো না।আপনাকে পনের মিনিট সময় দিবো।সত্যি হলো,আপনার বাচ্চাটা মারা গেছে।বেশিক্ষণ আপনাকে এভাবে রেখে দিলে ইনফেকশন হয়ে যাবে ভেতরে।এমনিও ইনফেকশন ছিলো বলে আমরা ধারণা করছি।অনুরোধ থাকবে,কষ্টকর হলেও,আমাদের কো অপারেট করুন।
মুনা বিশ্বাস করতে পারছে না কিছু।মনে হচ্ছে এখনি ঘুম ভেঙে যাবে।দেখা যাবে ও বিছানায় শুয়ে আছে।দুঃস্বপ্নটা দেখে ঘুম ভাঙার পর পানি খাবে। পেটে হাত বুলাবে।মেয়ের সাথে কথা বলবে।কিন্তু এসব হচ্ছে না।মুনা চিৎকার করে বলছে -
-ঘুম ভাঙ্গে না কেন,আমার ঘুম ভাঙ্গে না কেন।কেউ আসো।ঘুম ভাঙ্গায় দাও।সোহেল!আমাকে উঠাও।
দশ মিনিট এভাবে ছটফট করার পর মুনা হটাৎ একদম শান্ত হয়ে গেলো।বুঝতে পারলো,এই দুঃস্বপ্নের যন্ত্রণা আজীবনের৷তাই,পেটে হাত রেখে নিজের মেয়েকে স্পর্শ করার বৃথা চেষ্টা চালালো।আর মাত্র পাঁচ মিনিটের মত আছে। এরপর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে আত্মার বাঁধন।সঙ্গে নিয়ে যাবে জীবনের সব রঙ,আনন্দ,হাসি।মুনা নিজের পেট শক্ত করে ধরে রেখেছে। আর তিনমাস,এরপরই ছুঁতে পারত নিজের মেয়েকে।দেখতে পারত,হয়তবা মিলাতো কার মত হয়েছে দেখতে।কিছুক্ষণ পরই ডাক্তার আসলো।অস্ফুট স্বরে মুনা বললো -
-আরেকটু থাকা যায় না?
•
ভিনার শরীর তেমন ভালো না।ইদানিং ভীষণ ক্লান্ত লাগে কাজ করতে। কয়দিন আগেও রাত জেগে পড়ত,এখন এগারোটার মধ্যেই ঘুম পেয়ে যায় ।গত কয় মাসে ওজন কমেছে অনেকখানি।টাকা বাঁচানোর জন্য খাওয়া দাওয়ায় অনেক অনিয়ম করেছে।
-কী রে ভিনা,কী হয়েছে?
প্রিতির ডাকে ঝিমুনি কাটলো ভিনার।
-কিছু না আপু।
-কয়দিন ধরে দেখছি তুই কেমন যেন হয়ে গেছিস?কী হয়েছে?
-কিছু না আপু।পরীক্ষা তো,টেনশন লাগে।
-ফিনানশিয়াল কোনো সমস্যা?থাকলে বল।
-না আপু। কোনো সমস্যা নেই।
-বাসা থেকে কেউ টাকা পাঠায়?
-না....
-যাবির দেয়?
-আমার টিউশনির টাকা ছিলো কিছু। ঐটা দিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
-আর কোনো সমস্যা?
-না তো
-যাবিরের সাথে কিছু হয়েছে?
- আসলে....তেমন কিছু না।
-থাকলে ঠিক করে ফেল।আর যদি মনে হয় চলে যেতে চায়,চলে যেতে দে।
শেষের কথাটা খুব ভারি।ভিনা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।কিন্তু মেনে নেয়া কঠিন।বাস্তবতা মানুষের সময় স্বপ্নগুলোকে এমনভাবে নষ্ট করে দেয় যে,দ্বিতীয় বার স্বপ্ন দেখার সাহস আর থাকেনা।একজনের বাস্তবতা,অন্যজনের কাছে বিলাসিতা। বিলাসিতাই তো। আজকে মুনার সবকিছু থাকতেও একটু বেশির আশায় ভিনার জীবন কে বাস্তবতায় ঘেরা অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দিয়েছে।আজকে সকালেও যাবিরের সাথে কথা বলেছে ভিনা।যা বুঝলো গয়না বাসায় দিয়ে না আসা পর্যন্ত যাবিরের সাথে ভালোমত কথা বলা যাবে না।ভিনা ভেবে দেখলো যাবির খারাপ কিছু বলছে না।দামী গয়না ফিরিয়ে দেয়াই ভালো।আর যেটার অপবাদ দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে,সেটা নিজের কাছে লাভ কী,বরং ফিরিয়ে দিলে কিছুটা তারা বুঝবে তারা ভুল ছিলো।ক্যালেন্ডার দেখে ভিনা হিসাব করলো,আর ষোল দিন পরেই ওর বোর্ড পরীক্ষা শুরু।এর মাঝেই দিয়ে আসতে হবে গয়নাগুলো।ডায়রি ও নিয়ে আসবে,আর মায়ের একটা ফ্রেম বাধাঁনো ছবি,যেটা বিছানার সাইড টেবিলে আছে।ব্যক্তিনির্ভর জীবন থেকে ধীরে ধীরে বস্তু নির্ভর জীবন হয়ে যাচ্ছে ভিনার।
•
দুইদিন পর,পরীক্ষার ঠিক দুই সপ্তাহ আগে ভিনা আবার নিজের চিরচেনা ঠিকানার দরজার সামনে দাঁড়ানো।কলিং বেল বাজানোর আগে দুইবার ভেবে নিলো সোহেল থাকবে নাকি থাকবে না।হিসাব করে দেখলো না থাকারই কথা। এরপর অস্বস্তি নিয়ে কলিংবেল বাজালো,কারণ আজকে এই দরজা খুলবে।দরজা খোলার পর রীতিমতো চমকে গেলো,কারণ মোমেনা খালা দাঁড়ানো।
-খালা আপনি!
মোমেনা খুশিতে চিৎকার করতে নিলে ভিনা তাকে থামিয়ে দেয়।আস্তে করে বললো
-বাসায় কে কে আছে?
-মুনা আর তোমার বাপে।
-আর কেউ নাই?
-না....আসলে হইসে কী....
-আচ্ছা থাক থাক।বেশি সময় নেই,আমি আসি।
-মানেডা কী?
-এই গয়না গুলো দিয়ে দাও বাবাকে।আমি আসি।
-কোথায় যাইবা আবার?
-যেখানে থাকি,সেখানেই।
পরক্ষণেই মনে পরলো ডায়রি আর ছবির কথা।ভিনা মোমেনার হাত ধরে বললো-
-খালা বেশি কথার সময় নেই,আমি উপরে যাবো,দুই মিনিটের মাঝে এসে পরবো।তুমি কোনো শব্দ করবা না।বাবাকেও জানাবা না।দোহাই লাগে।
কথাগুলো বলেই ভিনা এক দৌড়ে উপরে চলে গেলো।মাস্টার বেড পার হয়ে ওর রুমে যেতে হয়।যাওয়ার সময় ভিনা দেখলো মুনা পাশ ফিরে শুয়ে আছে।শোয়ার ধরন অন্যরকম। সবকিছুতে এত পরিবর্তন কেন?কী হলো হটাৎ! এসব ভেবেই নিজের রুমের দিকে গেলো।দেখলো দরজা বন্ধ।
-চাবি!
কিছুটা চিৎকার করেই উঠলো ভিনা।পেছনে ঘুরতেই দেখলো ছলছল চোখ নিয়ে সোহেল দাঁড়িয়ে আছে।
.
.
.
চলবে............................................