'তোমার বাবা আর আমি বাইরে যাচ্ছি।তোমাকে নেয়ার ইচ্ছে ছিলো,কিন্তু তোমার বাবা বললো ওখানে গেলে তুমি আরো আনকম্ফরটেবল ফিল করবে।রাতেই এসে পরবো আমরা।মোমেনাকে বলে যাচ্ছি,তুমি খেয়ে নিও।'
চিরকুট পড়ার পর সোহেল সেদিনের কথা মনে করার চেষ্টা করলো।না....সোহেল তো নিতেই চেয়েছিলো,মুনাই মানা করেছে।অথচ চিরকুটে বিপরীত ঘটনা লেখা।এটা পড়ার পর ভিনার কেমন লেগেছে?নিজের বাবাই ওকে এড়িয়ে চলছে।তার মানে মুনা সুক্ষ্মভাবে ভিনাকে বুঝিয়েছে যে এই সংসারে ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
এরপর সোহেল ডায়রি নিয়ে বসলো।এই ডায়রি সে ভিনাকে দিয়েছিলো ছয় বছর আগে।প্রতি পাতায় মায়ের শূণ্যতা তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে।নিজের মেয়ের এমন সময়ে পাশে থাকার পরিবর্তে সে দ্বিতীয় বিয়ে করে এনেছে।বাবা হয়ে এতদিনেও বুঝেনি যে তার মেয়ে কত চাপা স্বভাবের।ছোট এই মেয়েটা কত একাকীত্ব নিয়ে বেঁচে ছিলো!আর সে বরাবর ভুল বুঝে এসেছে ভিনাকে।ডায়রির শেষের কয়েক পাতা খালি।সেই খালি পাতার মাঝখানে এক পাতায় লেখা-
'আমি ভয় পাই।আমি ভয় পাই কীভাবে আমার বাবা তার প্রেয়সী,তার স্ত্রী,তার সন্তানের মা কে ভুলে গেছে।এরকম নিষ্ঠুরতা আমার সাথে হলে কীভাবে সহ্য করবো?আমি দুঃখিত যাবির,তুমি চাইলেও আমি তোমার হাত ধরতে পারছিনা।আমি পৃথিবীতে মায়ের পরে বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসতাম,সেইই আমাকে ভুলে গেছে,আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস কীভাবে করবো বলো।আমি জানি প্রতিটা সময়ে তুমি ছায়া হয়ে আমার পাশে ছিলে,তোমাকে হাজার বার দূরে ঠেলে দেয়া সত্ত্বেও।আজকে আমার সাজানো পরিবার,গোছানো জীবন থাকলে অবশ্যই তুমি তোমার প্রাপ্য ভালোবাসা আমার কাছে পেতে।যেখানে আমি নিজেই ভালোবাসার কাঙাল,সেখানে তোমাকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব না।যেখানে জীবনে বেঁচে থাকাই আমার জন্য কঠিন,সেখানে কারো হাত ধরা আমার পক্ষে সম্ভব না।আমি একা থাকতে চাই।কারো হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা হওয়ার সাহস আমার নেই। আমি ভীতু।আমি অনেক বেশিই ভীতু।'
-তার মানে ও নিজে থেকেই দূরে ঠেলে দিয়েছিলো ওর ভালোবাসাকে!এত একাকীত্বের জীবন ও একা কাটাতে চেয়েছিলো ভয়ের কারণে।আর আমি?মুনা তাহলে মিস গাউড করছিলো আমাকে?আমার মেয়ে আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলো,ও মনে হয় জানাতে চাচ্ছিলো কিছু!আমি ওকে সুযোগ দেইনি।
সোহেল মাটিতে বসে পরলো। অন্তত এতটুকু বিশ্বাস রাখা উচিৎ ছিলো ভিনা পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে না।ওকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
-কোথায় গেলো আমার মেয়েটা!কী করলাম আমি!
চিৎকার করে কাঁদছে সোহেল।মুনা তড়িঘড়ি করে রুমে আসলো।
-কী হয়েছে?কী হলো!
-তুমি এত নিচ!ছি!থুতু মারতে মন চাচ্ছে তোমার মুখে।বেশ্যা একটা তুমি!
মুনা আকাশ থেকে পরলো। সোহেলের মুখে আজেবাজে কথা শুনে রাগে ফেটে যাচ্ছে মুনা।
-মুখ সামলে কথা বলো...যাচ্ছেতাই বলছো কেন তুমি?পাগল হয়ে গেছো?
-এটা কী?
চিরকুট দেখিয়ে মুনাকে জিজ্ঞেস করলো সোহেল।মুনার চেহারায় ভাবান্তর দেখা গেলো না।
-তুমিই তো চেয়েছিলে আমি যেন ভিনার সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করি।
-তো?এখানে আমাকে কেন কালপ্রিট বানানো হয়েছে?
-তোমাকে খারাপ না বানালে আমি ভালো হবো কীভাবে?
-মুনা,তোমার বাচ্চার কসম,সত্যি করে বলো,ভিনার কি আসলেও কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো?ও কি সত্যিই গয়না নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো?সত্যি কথা বলবে,নাহলে তোমার বাচ্চার ক্ষতি হবে,বলে দিলাম।
-সোহেল!এগুলা বলতে তোমার মুখে বাধলো না?এটা কি তোমার বাচ্চা না?ভিনার সাথে অন্যায় তোমার চোখে পরছে,এই বাচ্চার সাথে যে তুমি অন্যায় করছো,সেটা চোখে পরে না?
-না পরে না।কারণ আমি তো বাচ্চা চাইনি।আমার একটাই মেয়ে ছিলো,আমি সেই মেয়েকে নিয়েই থাকতে চেয়েছিলাম।তুমি প্রতারক!
-ঠিক আছে।ভালো হয়েছে আমি প্রতারক।
-তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো দাওনি।
-আমি দিতে বাধ্য না।যা হয়েছে ভিনার সাথে,এটা ওর প্রাপ্য ছিলো।
সোহেল মুনাকে চড় মেরে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।মুনা নিজের মা আর শ্বাশুড়ির সামনে কেঁদে অস্থির হয়ে গেলো।জমিরা বিবি যেয়ে ছেলেকে চড় মারলেন।
-এত্ত বড় সাহস তোর!পোয়াতি বউ এর গায়ে হাত তুলোস তুই!এক মাইয়ার লেইগা এত দরদ,আর ওর প্যাটের বাচ্চা পোলা হইলে কি করবি তুই?
-তুমি জানো না মুনা কি করেছে,তুমি একটা ইবলিশ ঘরে ঢুকিয়েছো মা।আমার অসহায় মেয়েটা!
-থাম তুই!সব জানি আমি।সব তোর লেইগাই হইসে।আইজকা মাইয়ারে অন্য খানে বিয়া দিলে,অথবা হোস্ট্যালে দিয়া দিলে এসব করন লাগত না।তোর বউ এর গয়নাটি ও বাইচা যাইত।খানকি তে গয়নাটি নিয়া গ্যাসে।
সোহেল হতভম্ব হয়ে মায়ের কথা শুনলো।একা মুনা দায়ী হলে আজকে মুনাকে ঘরে রাখত না।এখানে নিজের মায়ের নির্লিপ্ততা দেখে,সোহেলের বিস্ময়ের সীমা থাকলো না।
-আম্মা?কী বলছো এসব?ভিনা আমার মেয়ে।আমাদের রক্ত!
-মানি না আমি।তর ঐ বিয়া মানিনা,বউ ও মানিনা।তোর মাইয়ারেও না।তুই এইহানেই সংসার করবি।আল্লাহ এ ওরে বরকত দিসে দেইখ্যাই এই বাচ্চা দিসে ওরে।আর তর বউ তো এক মাইয়া পয়দা কইরাই মইরা গেসে।
সোহেল বুঝলো কথা বলে লাভ নেই।নারীর সব রূপ এই এক জীবনেই দেখা হয়ে গেছে।শিউলির মধ্য দিয়ে ভালোবাসা,ধৈর্য্য,স্যাক্রিফাইস,সরলতা,পবিত্রতা সব দেখেছে।মুনা আর তার মার এর আচরণ দিয়ে কুটিলতা,কলুষতা, সব দেখেছে।
আমার মেয়েটা....সোহেল আর্তনাদ করে উঠলো।
.
.
.
চলবে.............................................