অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৬৫ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


‌রুপিনের কথা রেখে ভিনা নিজের বাসায় থেকে গেলো।কথামত সোহেল,মুনা কেউই সামনে আসে না ওর।কিন্তু ভিনা প্রায়ই দেখে যে সোহেল গভীর রাতে এসে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়,অথবা উঁকি দেয় কী করছে।আটদিন হয়ে গেছে এভাবেই।এই কয়দিনে কেউ-ই জিজ্ঞেস করেনি ও কোথায় ছিলো,কার সাথে ছিলো।এমনকি মোমেনা খালাও না।হয়ত অস্বস্তিতে ফেলতে চায়নি দেখেই এমন করেছে।যেদিন এসেছিলো এই বাসায়,তারপরের দিন গিয়েছিলো প্রিতির সাথে দেখা করতে আর নিজের সব জিনিস আনতে।প্রিতি ভীষণ কান্নাকাটি করেছিলো,অথচ প্রিতির সাথে শুধু রাতেই কথা হত,কিন্তু প্রতিদিন।ভিনা অনেক কষ্টে সামলিয়েছিলো প্রিতিকে।শেষে প্রিতি শুধু এতটুকুই বলেছিলো,'বেঁচে থাকতে অনেক কষ্ট হবে আমার!' ভিনা প্রতিদিন প্রিতির সাথে কথা বলে।আগের মত উচ্ছ্বলতা নেই কথার মধ্যে।ভীষণ ক্লান্ত কন্ঠ।ভিনার অবাক লাগে,সামান্য পরিচয়ে মানুষ এত ডিপেন্ডেন্ট হতে পারে?

ভিনা ভেবেছিলো বাসায় গয়না দিতে গিয়ে বাধা পরে যাওয়ার ঘটনায় যাবির রিয়্যাক্ট করবে,কষ্ট পাবে।কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।যাবির খুব ঠান্ডা গলায় বলেছিলো-

-বড়রা যা বলে মেনে নাও।

-মেনে নিবো?কী মেনে নিবো?

-তারা যখন থাকতে বলছে মেনে নাও ভিনা।এ্যটলিস্ট সেফ একটা শেল্টারে আছো।এত বড় শহরে একা মেয়ে থাকাটা রিস্কি।

-কয়মাস ই তো,এরপর...

-এরপর কী ভিনা?

-যাবির,তুমি কি এই সম্পর্ক থেকে বের হতে চাচ্ছো?

- না। শুধু সময় দাও আমাকে।আমি সমস্যায় আছি ভিনা।

-কী সমস্যা?আমাকে বলা যায় না?একবার খুলে বলতে সমস্যা কী যাবির?

-আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি ভিনা।তুমি নিজেই অনেক সমস্যায় আছো।এখন আর সমস্যায় ফেলতে চাচ্ছিনা।

-আমার দায়িত্ব কি খুব বেশি ভার হয়ে গেছে তোমার জন্য?

-আমি বলেছি কখনো?

-তাহলে তুমি কেন আগের মত নেই?

-আমাদের সম্পর্ক ও তো আগের মত নেই।

-মানে?তুমি কি সেদিনের কথা বলছো?

-কিছু না,তুমি পড়ো।বেশিদিন নেই আর। 

-কথা ঘুরিয়ো না যাবির।সত্যি বলো,তুমি কি সেই রাতের কথা মিন করছো?তোমার কি সামান্য হলেও মনে হচ্ছে যে এই ক্যারেক্টারলেস মেয়ের সাথে তুমি থাকতে পারবে না?

-শাট আপ ভিনা।আমি এখন কথা বলতে চাচ্ছি না।

-শুধু একটা কথা বলো,আমাকে ছেড়ে যাবে তুমি?

-যেতে চাই না আমি,এতটুকু মনে রেখো।

কল কেটে দেয়ার পর ও ভিনা কানে ফোন ধরে রাখে।প্রকৃতি কিসের পরীক্ষা নিচ্ছে?একজন একজন করে সবাই চলে যাচ্ছে কেন।এই ক্ষুদ্র জীবনে কাকে এতটা কষ্ট দিয়েছিলো যে জীবন সব কেড়ে নিচ্ছে?


মুনা বারান্দায় বসে আছে।চোখে রাজ্যের কালি।চুল আচড়ানো হয়নি বেশ কয়দিন ধরে। জট ধরা চুলে চিরুনি বসানোর ও ইচ্ছে নেই।গত কয়দিনে জীবন যেন একশ আশি ডিগ্রি কোণে ঘুরে গেছে।শূণ্য গর্ভ আর শূন্য বেঁচে থাকার আশা নিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে শুধু।ইনফেকশন,ভুল চিকিৎসা,হয়ত ভাগ্য ও,নানা কারণে গর্ভাশয় কেটে ফেলে দিতে হয়েছে।মা হওয়ার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিলো,সেটা যে এত নিষ্ঠুরতম শাস্তির মাধ্যমে শেষ হয়ে যাবে,ভাবেনি কখনো।আজমির খালার একটা কথাই মাথায় ঘুরছে,

'অন্তর পাক করো।'

হায়রে স্বার্থপরতা!সারাজীবন নিঃস্বার্থ থেকে এই সময়ে এসেই নিজেকে নষ্ট করা লাগলো!এক প্রেগন্যান্সি জীবনের সবদিক একসাথে দেখিয়ে দিয়েছে।অনাগত এই মেয়ে তাকে,স্নেহ,মমতা,সব দেখিয়েছে।একজন মায়ের সন্তানের প্রতি যে তীব্র ভালোবাসার সঞ্চার হয়,সেটা অনুভব করিয়েছে।এটাও শিখিয়েছে,একজন মা হয়ে মেয়ের প্রতি কেউ নেতিবাচক কিছু করলে কেমন লাগে।সেই মেয়ে চলে যাওয়ার আগে বিবেকবোধ জাগ্রত করে গেছে।পৃথিবীতে না এসেও কত বড় বড় কাজ করেছে।হয়ত সব দায়িত্ব অনাগত অবস্থায় পালন করেছে দেখে এই স্বার্থপর নোংরা পৃথিবীতে আসতে চায়নি।

হটাৎ বসা থেকে উঠে মুনা আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট নিয়ে আসলো।ছোট ছোট হাত পা দৃশ্যমান,একটু একটু করে বড় হচ্ছিলো তার মেয়ে।মুনা যেন দেখতে পায় গোলাপি ফ্রক পরা পুতুলের মত একটা বাচ্চা মেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছে। বেলি ফুলের মত মিষ্টি ঘ্রাণ বাচ্চার শরীরে।নরম হাত দিয়ে মুনার হাত ধরে আছে।ছোট ছোট শ্বেত পাথরের মত দাঁতের ভুবন ভুলানো হাসি তার মুখে।

'আমার বাচ্চাটা!'

মুনা আর্তনাদ করে উঠে।একজন সদ্য সন্তান হারা মা ই জানে এই আর্তনাদ কতটা কষ্টকর,কতটা নির্মম,কতটা সর্বহারা।সারাজীবনের সব পাপ যেন মোচন হয়ে যায় এই কান্নায়।

ভিনা ধীর পায়ে বারান্দায় মুনার পিছে দাঁড়ালো।মুনার আর্তনাদ ভীষণভাবে পীড়া দিচ্ছে।যত যাই হোক,সন্তানের মৃত্যু কোনো পাপের শাস্তি হতে পারে না,হওয়া উচিৎ না।আজকে ওর নিজের বাচ্চা মারা গেলে কী হত?ভাবতেই ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠছে।

-এখানে কী করছিস?

সোহেল ভিনাকে প্রশ্ন করলো।যদিও বেশ কিছুক্ষণ আগেই ভিনাকে দেখেছে দাঁড়িয়ে থাকতে,প্রথমে প্রশ্ন করে উঠতে পারেনি।

-উনাকে ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও।

-শাস্তি পাচ্ছে,পেতে দে।

-সন্তান তো তুমিও হারিয়েছো,তোমার কষ্ট লাগে না?

-লাগে।তবে এতটা না,যতটা তোকে ভুল বুঝে আমি পেয়েছি।

-মনে আছে?একবার আমি বাথরুমে পরে গিয়েছিলাম,আমার নাক দিয়ে রক্ত পরেছিলো?মাকে দেখেছিলে,কীরকম পাগলের মত করেছিলো?রক্ত পরা কমছিলো না দেখে কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসকষ্ট উঠে গিয়েছিলো,সেখানে উনার বাচ্চাটাই মারা গেছে।

-এটা ওর কর্মের ফল,পরীক্ষা না।তাই সহমর্মি হওয়ার মানে নেই।

-উনি তোমাকে ভালোবেসে করেছিলো,যাই করেছিলো।খারাপ আমার সাথে করেছে।আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।তাকে নিয়ে একটাই ভয় ছিলো সবসময়, এই বুঝি তোমাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিবে।তাতে সে সাক্সেস্ফুল হয়েছে কারণ তুমি হতে দিয়েছো।পাপী সে একা না।আর এই অভিমান তোমার করা মানায় না।

সোহেল মেয়ের যুক্তির কাছে পরাজিত হলো।যতটা অপরাধী সে নিজেকে ভেবেছিলো,তার চেয়ে বড় পাপ সে করে ফেলেছে।

-আমাকে ক্ষমা করা যায় না মা?

-আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।যেদিন থেকে আবার এ বাসায় থাকা শুরু করেছি,সেদিনই ক্ষমা করে দিয়েছি।কিন্তু হ্যাঁ, ভুলিনি কিছুই,ভুলবোও না।

-ফিরে আয় মা। 

-তাকে ভালো চিকিৎসা করাও।মানুষকে ভালোবাসার শাস্তি দিও না। 

এতটুকু বলে ভিনা নিজের ঘরে চলে আসলো।কেন যেন এই বাচ্চার মৃত্যু ভিনা মেনে নিতে পারছে না।যাবিরের আচরণ তো আছেই,এই অস্বাভাবিক আকাল মৃত্যুও তিলে তিলে কষ্ট দিচ্ছে।মুনার প্রতি বিদ্বেষ কাজ করে না এখন,বরং আরো কষ্ট লাগে।একটা নিষ্পাপ বাচ্চা পৃথিবী দেখার আগেই মারা যাবে,শুধুমাত্র কারো পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য,এটা মেনে নেয়া খুব কঠিন লাগছে ভিনার কাছে।মনে হচ্ছে আগে জানলে মুনাকে ক্ষমা করে দিত,কোনো হায় রাখত না মনে।চোখে পানি চলে আসছে এই ভেবে যে একজন ছোট মানুষ ঘর ভরে হাঁটত,সে আর হাঁটবে না।

চোখ মুছে বিছানায় শুয়ে পরলো ভিনা।শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।সাইড টেবিলে রাখা ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে পিঠ দিয়ে শিহরণ বয়ে গেলো।
.
.
.
চলবে..................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন