অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৬১ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


মুনা অধির আগ্রহে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে,সেখানে ওর বাচ্চার অস্তিত্ব দৃশ্যমান।বেশ অনেকক্ষণ এক্সামিন করার পর ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো-

-প্রথম বাচ্চা আপনার?

-হ্যাঁ 

-আচ্ছা,তাহলে আশা থাকতেই পারে।

-মানে? ঠিক বুঝলাম না।

-আপনার বেবিটা খুব সম্ভবত মেয়ে।মন খারাপের কারণ নেই।সেকেন্ড বেবি ছেলে হতেও পারে।

যদিও মুনা আশা করেছিলো ছেলের,তবুও মেয়ে হওয়াতে একটু ও কষ্ট পায়নি।বরং ডাক্তার মেয়ে হওয়ার খবর মলিন মুখে দেয়ায় আরো বিরক্ত হলো।

-আমি মেয়েই চেয়েছিলাম।আমি অনেক খুশি!

-তাহলে তো ভালোই।অনেকে আবার প্রথম বাচ্চা ছেলে চায়।তাহলে চিন্তা থাকে না আরকি।

মুনা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট প্রাণের উপস্থিতি অনুভব করার চেষ্টা করলো।প্রথমে ছোট একটা মাংস পিন্ড ছিলো,এখন একটা পরিচয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হচ্ছে এই অস্তিত্ব। সেই সাথে গড়ে উঠছে মুনার সাথে এর সুখ দুঃখের আত্মিক সম্পর্ক। আচ্ছা এই মেয়ে কি ভিনার মত মা পাগল হবে?মাকে খুব বেশি ভালোবাসবে?

ভিনার কথা মনে উঠতেই সামান্য বিবেকবোধ জাগ্রত হলো মুনার।কিন্তু স্বার্থপরতার নিচে সেটাকে চাপা দিয়ে দিলো মুহূর্তেই।ভিনা আসলে মুনার নিজের মেয়ে যে অধিকার থেকে কিঞ্চিৎ হলেও বঞ্চিত হবে,সেটা মুনার পক্ষে মানা সম্ভব না।

মুনা হাসি হাসি মুখ নিয়ে সোহেলের কাছে গেলো।বাইরে সিটে বসে সোহেল এক দম্পতির বাচ্চা মেয়েকে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো।ছোট সেই মেয়ের মাঝে ভিনার ছোটবেলাকে খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো।

- এভাবে তাকিয়ে দেখা লাগবে না,তোমার ও মেয়ে আসছে।

-মেয়ে?

খুব বুক ভার নিয়ে সোহেল জিজ্ঞেস করলো।

-হ্যাঁ। প্রথমবার মেয়ে হওয়া সৌভাগ্য। 

সোহেল হাসলো।

-তুমি না ছেলে চেয়েছিলে?

-ওরকম শখ তো সবারই একটু থাকে প্রথম বাচ্চা নিয়ে।এখন ছেলে হোক মেয়ে হোক,সন্তান তো সন্তানই।

মুনার মুখে এ কথা শুনে সোহেল অর্থবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো।এ দৃষ্টির মানে মুনা জানে,তাই সাথে সাথে চোখ সড়িয়ে নিয়েছে।যা হওয়ার হয়েছে,সময়ের দাবি ছিলো এটা,মনে মনে নিজেকে বললো মুনা।নানা অজুহাতে নিজের অন্যায়কে ন্যায়সংগত প্রমাণ করলো বিবেকের কাছে,যেটা আসলে মরে গেছে অনেক আগেই।

বাসায় আসার পর জমিরা বিবি বিলাপ করে হুলস্থুল কান্ড বাধিয়ে ফেললো।

-জানতাম আমি,আল্লায় আমারে এই পোলা আর পোলার বউ দিয়া জীবনেও সুখ দিবো না।হুদাই এই মারানিজ্জির কথায় আমি পুরাডা মাস বাড়ি খালি রাইখ্যা এইহানে পইরা থাকলাম।

যেই শ্বাশুড়ি গতকাল ও মাথায় তুলে রেখেছিলো মুনাকে,আজকে সেই অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে।অবশ্য এর পিছে মুনার মা লতিফার ও ভূমিকা আছে।এই লক্ষণ সেই লক্ষণ,নানা কথা বলে জমিরা বিবিকে বুঝিয়েছে যে মুনার ছেলেই হবে।শুধু তাই না,ছেলের অজুহাতে বেশ কিছু নিয়েও নিয়েছেন এই কয়দিনে।জমিরা বিবির বাকি দুই ছেলের ঘরে নাতিকে ছুয়ে দেখতে পারেননি,তাই অনেক আশায় ছিলেন সোহেলের ছেলে নিয়ে নিজের শেষ বয়সের খায়েশ মেটাবেন।এখন আশা ভঙ্গের কষ্টে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছেন না।তাই সিদ্ধান্ত নিলেন,কালই চলে যাবেন গ্রামে।মুনা শাশুড়ির এমন ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলো।সেই সাথে ভীষণ কষ্ট ও পেলো।নিজের সন্তানের সাথে এমন আচরণ মেনে নেয়া কঠিন।


ধানমন্ডি লেকের এক পাশে যাবির আর ভিনা বসে আছে।যাবির অন্যমনস্ক হয়ে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে আছে।অন্য যেকোনো সময় যাবির ভিনার হাত নিজের হাতে নিয়ে বসে থাকত। কথা হোক বা না হোক।যাবিরের এই পরিবর্তন ভালোমতই ভিনা টের পাচ্ছে।কিন্তু কেন এই পরিবর্তন, এর কারণ অজানা। 
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর ভিনাই কথা শুরু করলো।

- বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?

- হুম...

-কী হয়েছে?

- মা অসুস্থ।

-আর?

-মায়ের ট্রিটমেন্টে অনেক টাকা প্রয়োজন। 

-আর?

-আমি এখনো স্টুডেন্ট। টিউশনি করে যথেষ্ট টাকা হাতে আসে না।

-আর?

-জীবন আমার জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে ভিনা।কিন্তু আমি তোমার হাত ছাড়তে চাচ্ছি না।

-চাচ্ছো না?তাহলে এমন কেন বিহেভ করছো?কিছু খুলেও বলছো না।কেন? 

-সময় দাও।আমি খুলে বলবো।

-কতদিন সময়?

-আমি জানি না। তুমিও যেমন জানো না তোমার এই বিচ্ছিন্ন জীবন কয়দিনের,আমিও জানি না। 

-আমি তোমাকে এই বিচ্ছিন্ন জীবনের সাথেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়েছি। 

-আমি জড়াতে চাচ্ছি না।

-কেউ এসেছে জীবনে?

যাবির শুধু তাকিয়ে আছে ভিনার দিকে।উত্তর না দিয়ে।এই প্রশ্ন আশা করেনি। অবশ্য ভিনাকেও দোষ দিতে পারলো না।

- খুলে বলতে পারো।আমি মেনে নিবো।কারণ এই সম্পর্কে আমি সময়,যত্ন,কিছুই দেয়নি।

-আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না ভিনা।

-ঠিক আছে।বাদ দিলাম।

-বাসায় গয়না দিতে গিয়েছিলে?

-না।যাবো।আগামী সপ্তাহে।

-এই সপ্তাহেই যাও। 

-আমি কথা দিচ্ছি আমি যাবো।কিন্তু কখন সেটা অন্তত আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে দাও।

-ঠিক আছে।

-গয়না নিয়ে হটাৎ এমন করছো কেন?ঐ বাসায় ফেরৎ দেয়ার চেয়ে ভালো তুমি নাও।এটা দিয়ে তোমার চিকিৎসা করাও।

যাবিরের আত্মসম্মানে গিয়ে কথাটা লাগলো।মানুষের থেকে আর্থিক সাহায্য নেয়া অনেকটা ভিক্ষার মত লাগে তার কাছে। ছোট থেকে বাবার ছায়া না থাকায়,সারা জীবনই এই অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসের মুখোমুখি হতে হয়েছে।যদিও বা পড়াশোনার খরচ ভালোমতোই চালানো সম্ভব,কিন্তু মায়ের চিকিৎসা চালানোর মত অবস্থা এখনো হয়নি।

-ভুল বুঝলে ভিনা।আমি তোমার ভালোর জন্যই গয়নার কথা বলেছিলাম,নিজের জন্য না।তুমি ভালোমতই জানো ঘুরিয়ে কথা বলার স্বভাব আমার নেই।

-ঠিক আছে,মেনে নিলাম।কেন তুমি তাহলে এমন করছো?এক মাসের মত তো গয়না আমার কাছেই ছিলো।

-তর্কে না যাই। আসলে তোমার পার্সোনাল ব্যাপার তুমি বুঝবে।উঠি আজকে।

এই মনোমালিন্য গত দুই বছরে কখনো হয়নি।এই যে শুরু,ভিনা উপলব্ধি করছে,ফাটল ধরছে সম্পর্কে। 
.
.
.
চলবে.................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন