শ্রীঘর - পর্ব ০৪ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

শ্রীঘর 
পর্ব ০৪ 
আতিয়া আদিবা 
.
.
.
দিবা বারান্দায় বসে ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। কন্টাক্টস লিস্টে গিয়ে পুরোনো একটি নাম্বার খুঁজে বের করেছে সে। কিন্তু নাম্বরটিতে কল করবে কিনা বুঝতে পারছে না। মানুষটা কি চিনবে তাকে? সাহায্য করবে দিবার এই দুঃসময়ে? মোবাইলের ডান দিকের ছোট্ট বাটনটি চেপে স্ক্রীনলক করে ফেললো সে। বারান্দার দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে দিবার। চোখের পাতাদুটো মেলাতেই জমে থাকা পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কালঘুমের মতো এলো দিবার। আধো ঘুম আধো জাগনার মধ্যেই সে ভয়ংকর একটি স্বপ্ন দেখলো। পুলিশ সাহিলকে জেরা করছে। রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাকে। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করা হচ্ছে। চেয়ারের সাথে সাহিলের হাত পা বাঁধা। পায়ের পাতায় মোটা বেত দিয়ে সজোরে আঘাত করে চলেছে একজন পুলিশ কর্মকর্তা। আরেকজন অফিসার একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছে।
সাহিল হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, 
"পানি খাবো! আমাকে প্লিজ একটু পানি দিন।"
সাহিলকে পানি খেতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফুটন্ত গরম পানি! সাহিলের মুখে পানি ছোঁয়াতেই চিৎকার করে উঠলো! যেনো তার গলা পুড়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে দিবাও চিৎকার করে জাগনা পেয়ে গেলো। নিশ্বাস নিতে পারছে না সে। দম আটকে আসছে তার। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামও জমেছে।  
দিবার মা মেয়ের গলার আওয়াজ শুনে হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় ছুটে এলো। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" কি হয়েছে দিবা? এভাবে চিৎকার করলি কেনো?"
দিবা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
" একটু চোখ দুটো লেগে এসেছিলো। আর তখনি বাজে একটা স্বপ্ন দেখলাম।"
" কি স্বপ্ন দেখেছিস?"
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে দিবা বললো,
" সাহিলকে ওরা খুব মারছে। খুব মারছে! ও পানি খেতে চাইলো আর ওর মুখে ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দেওয়া হলো!"
এটুকু বলে দিবা মরীয়া হয়ে উঠলো। পাগলের মতো বলতে লাগলো,
" মা, সাহিলকে ওরা কষ্ট দিচ্ছে না তো! ওকে মারছে না তো ওরা? বলো মা! বলো? ও.. ও ঠিক আছে তো?"
দিবার মা মেয়েকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বললো,
" তুই কেনো এত চিন্তা করছিস? তোর বাবা, শশুড় শাশুড়ি সবাই তো গিয়েছে থানায়। দেখবি কোনো না কোনো ব্যবস্থা ঠিক হবে। আর জমিলাকেও আমরা সিঁধে করে ছাড়বো।"
" আমি অনেক খারাপ মা। অনেক খারাপ! নাহলে অন্যের কথায় নিজের স্বামীর চরিত্রে এভাবে আঙ্গুল তুলি? অবিশ্বাস করি?"
" এতে তোর কোনো দোষ নেই রে, মা। মানুষ সবকিছুর ভাগ দিতে পারে। কিন্তু নিজের স্বামীর ভাগ কি কাউকে দেওয়া যায়? এরকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা সহজ না।"
" তবুও! আমি যা করেছি ভুল করেছি। ভুল শুধরে নাওয়ার সময়টুকু আমাকে উপরওয়ালা দিলো না!"
" তুই যদি এমন ভেঙ্গে পড়িস এই লড়াইটা লড়বি কিকরে? আমি, তোর বাবা, বেয়াই-বেয়াইন সবাই তোর সাথে আছি! সেই সকাল থেকে এখন পর্যন্ত গলাটাও ভিজাস নি। একটা ডিম ভেজে দেই মা? ভাত দিয়ে খা?"
" না, মা। তুমি জানো? সাহিল গতরাত থেকে না খাওয়া। এক টুকরো রুটি পর্যন্ত ও মুখে তুলতে পারে নি। তার আগেই ওকে ওরা নিয়ে গেলো! আমার গলা দিয়ে দানা নামবে বলো?"
দিবার মা নিচু গলায় বললো,
" কিন্তু এই অবস্থায় না খেলে কি করে হবে বল? তোর সাথে যে এখন আরেকটা জীবন জড়িয়ে আছে! আমি খাবার নিয়ে আসছি। যে আসছে তার কথা চিন্তা করে হলেও খেতে হবে।"
দিবা কোনো উত্তর দিলো না। দিবার মা ঘরে চলে গেলেন। দিবা ফোনের লক খুলে তার বাবার নাম্বার ডায়াল করলো। 
" হ্যালো, বাবা। কি অবস্থা এখন?"
" আগামী দুদিন তো কোর্ট বন্ধ। আজকে জামিনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। ভালো একজন উকিল লাগবে।"
"আজকে ওকে ঘরে ফিরিয়ে আনা কোনোভাবেই কি সম্ভব না?"
" না রে মা। তবুও চেষ্টা করছি। তুই চিন্তা করিস না।"
" বাবা, সাহিল গতকাল থেকে না খাওয়া। ওকে একটু খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে পারো?"
" সে কিরে! আমি এখনি ব্যবস্থা করছি। তুই কান্নাকাটি করিস না দিবা। আমরা আছি তো। কিচ্ছু হবে না।"
" ওকে মারধোর করছে না তো?"
" না না! মারধোর কেনো করবে? বোকা মেয়ে। তবে ইস্যুটা খুবই সেন্সেটিভ। আমাদের একজন ভালো উকিল লাগবে। কাকে যে বলবো বুঝতে পারছি না।"
" তোমার কাউকে বলতে হবেনা। উকিলের ব্যবস্থা আমি করছি। তুমি সাবধানে এসো, কেমন? রাখছি।"
" ঠিকাছে রে।"

দিবা ফোন কেটে দিলো। পুনরায় কন্টাক্ট লিস্ট থেকে সেই চিরপরিচিত নাম্বারটি বের করলো। নতুন নতুন সব মানুষদের নাম্বারের ভীরে এই নাম্বারটি একদম ফিঁকে হয়ে গিয়েছে। সাহস করে ডায়াল করলো দিবা। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো।
সুন্দর ভরাট কন্ঠ শোনা গেলো,
" আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?"
দিবা নরম গলায় সালামের উত্তর দিলো।
"তিয়াস?"
" জ্বি। আপনি কে?"
" দিবা।"
" কোন দিবা?"
" ডিপার্টমেন্ট অফ সি এস সি, ১২ তম ব্যাচ।ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি। চিনেছো?"
ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণ পিন পতন নীরবতা। 
" ভালো আছো?"
দিবা উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।
" তোমার সাথে দেখা করা যাবে?"
" এনিটাইম!"
" কোথায়?"
" আমার চেম্বারে চলে এসো।"
" এড্রেসটা?"

ফোন রাখার পর দিবা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রইলো। নীলের মাঝে হন্যে হয়ে ভেসে বেড়ানো মেঘগুলোর মতো অসহায় লাগছে নিজেকে তার। জীবনে, কিছু কিছু সময় এমন আসে অনেক ভীড়ের মাঝেও নিজেকে একা মনে হয়। খুব একা মনে হয়।
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন