ভিনা একটা শাল ভালোমত জড়িয়ে নিয়ে ব্যাগ হাতে নিলো।চুল সেই চিরায়িত আলগোছে বাঁধা।পার্থক্য হলো এখন এতে মুগ্ধ হওয়ার কেউ নেই।আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো।শুধুমাত্র চোখের জন্য কত বয়স্ক লাগছে নিজেকে।যেই চোখ স্বপ্ন দেখতে পারে না,সেই চোখ বৃদ্ধ। এই বার্ধক্য পুরো চেহারায় ছাপ ফেলে।সূর্য উঠতে এখনো আধা ঘন্টা বাকী।আবছা এই আলোতেই বের হয়ে গেলো ভিনা।ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়ে নামলো।কিছু একটা আটকে রাখতে চাইছে ওকে।নতুন জীবনের শুরু আনন্দময় হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
নতুন!কথাটাই কত রঙিন।মনে হয় কেউ এক ঝাঁক স্বপ্ন নিয়ে পা বাড়াচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে।সম্ভাবনাময় এই ভবিষ্যতের জন্য বাড়ি ছাড়া খুব সোজা।তখন সহজে পিছুটান কাজ করে না।কিন্তু জেনে শুনে সাদা কালো অনিশ্চিত একটা জীবনের পথে পা বাড়ানো সোজা না।যার নিয়তির কারণে এটা করতে হচ্ছে,সেই জানে মায়ার টান কী হয়।
এক তালায় নেমে খুব আস্তে মেইন গেট খুলে ভিনা বেরিয়ে আসলো।সিদ্দিক চাচার কথা মনে পরছে অনেক।লোকটা কোথায় গেলো কে জানে।আজকে এখানে থাকলে নিশ্চয়ই নানা প্রশ্নে আটকে ফেলত।অবশ্যই আটকাতো,কত ভালো হত তখন।আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো।কিছুদূর যেতেই হটাৎ একটা গাড়ি দেখে থমকে গেলো।কালো রঙের এই গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখে নিশ্চিত হলো,এই গাড়ি ভিনাদের।এই ভোর বেলায় তো গাড়ি এখানে থাকার কথা না।নানা প্রশ্ন মাথায় আসছে।কিছুদূর এগিয়ে গাড়ির সামনে আসতেই পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো ভিনার।ভেতরে ড্রাইভিং সিটে সোহেল বসা।মনে পরলো,অনেক আগে যখন ওদের প্রথম গাড়ি কেনা হয়েছিলো,তখন ড্রাইভার ছিলো না,সোহেলই ড্রাইভ করত।সোহেলকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ভিনার প্রচন্ড ভয় কাজ করছে।সেদিনের কথা মনে পরছে যেদিন ওকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছিলো।দ্বিতীয়বার একিভাবে অপমানিত হওয়ার মত মানসিক শক্তি আর নেই।
-বাবা....তুমি...এখানে?
সোহেল গাড়ি স্টার্ট করলো।ভিনা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে গাড়িতে উঠলো।সোহেল গাড়ি চালাচ্ছে।ভিনা হাতের আঙ্গুল নাড়াচাড়া করছে।কিছুই জানে না কী বলবে।চাচ্ছেও না এই নীরবতা ভাঙুক।কারণ যেই প্রশ্নই করা হোক না কেন,তার উত্তর দেয়া সম্ভব হবে না ভিনার পক্ষে।অনেকক্ষণ সময় যাওয়ার পর সোহেল কথা শুরু করলো।
-কেমন আছো?
ভিনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।এক এক করে সব দৃশ্য পেছনে ফেলে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে।জীবনের এই কঠিন দিনগুলোও যদি এভাবে চলে যেত।ঘোলাটে হয়ে,খুব দ্রুত গতিতে।
-ভিনা...
-আমি ভালো নেই বাবা।তোমার মেয়েকে সেদিন ঘর থেকে বের করে দিয়ে ভালো করেছিলে।ভবিষ্যতের পাপের শাস্তি আগেই দিয়ে দিয়েছিলে।আমি সেই শাস্তিরই যোগ্য।
-কয় মাস হয়েছে?
-সাড়ে চার মাস।
সোহেল একবার মেয়ের দিকে তাকালো।গাড়ির গতি বেশ ধীর করে আনলো।
-নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কখনো চিন্তা করেছো?
-করেছিলাম অনেক আগে।তখন স্বপ্ন দেখতাম আমি।এখন দেখি না।
-তুমি যে ভুল করেছো,সেটা নিয়ে আমি কিছুই বলতে চাচ্ছি না।শুধু জিজ্ঞেস করবো এই বাচ্চাকে নিয়ে কী ভেবেছো?আজকে বের হয়ে কোথায় যেতে?ঐ ছেলের কাছে?
-না,মরে যাওয়া মানুষের কাছে কেউ যায় না।ও মারা গেছে এক্সিডেন্টে।
-মারা গেছে!?
-হ্যাঁ। এইত,দুই মাস হলো।নাহলে এভাবে বের হয়ে আসা লাগত না।
-ওর পরিবারে কেউ নেই?
-যেই থাকুক।এই বাচ্চার সাথে তাদের সম্পর্ক নেই।
-তাহলে?কোথায় যাচ্ছিলে?
-আমি ঠিক করে বের হইনি।
-ভিনা।তুমি তোমার মার অনেক স্বভাব পেয়েছো।কোনো ভুল করলে, তার দ্বিগুণে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাও।আমি ভালোমত জানি,এই বাচ্চাকে তুমি পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই দেখছো।
-তোমার কথা পুরোপুরি ভুল না।মার স্বভাব আমি পেয়েছি অবশ্যই। নিজের বাচ্চাকে আমি আগলিয়ে রাখতে চাই।
-ঠিকাছে।এরপর ওকে ভালো একটা জীবন কীভাবে দিবে?জন্ম দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?ভালোবাসা প্রকাশ পায়?
-পৃথিবীতেই যদি না আসে,ভালো জীবন কীভাবে দিবো?
সোহেল ভিনার শেষ কথা শুনে আর কথা বাড়ালো না।গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে ফেললো।তখন ভোর হচ্ছে।সূর্য ধীরে ধীরে গাড় নীল আকাশকে মায়াময়ী রং দিচ্ছে।ভিনা অপলক সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
•
সবসময় কাজের লোক দরজা খুললেও আজকে রুপিন নিজে দরজা খুললো।কাক ডাকা ভোরের এই সময়ে চারদিক শুনশান।গুলশানের এই আলিশান বাড়িতে অনেকগুলো রুম আছে।এ বাড়িতে একজনকে সারাজীবন লুকিয়ে রাখলেও কেউ টের পাবে না।ভিনা গাড়িতেই ধারণা করেছিলো ওকে রুপিনের বাসায়ই নিয়ে আসা হবে।সোহেল রুপিনের কাছে রেখে খুব জলদিই চলে গেলো।এধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলা খুব কঠিন। রুপিন নিজে লাগেজগুলো নিয়ে ভিনাকে রুমে দিয়ে আসলো।সাদা রঙ করা সেই রুম বেশ বড়,সেই তুলনায় ফার্নিচার কম।একটা বিছানা,বিছানায় এক পাশে সাইড টেবিল,আরেক পাশে ইজি চেয়ার।এক পাশের পুরো দেয়াল জুড়ে কেবিনেট।পুরো ঘরেই হালকা সুঘ্রাণ।দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে কেউ থাকে না।
-আয়,বস এখানে।
ভিনা বিছানায় বসলো।প্রচন্ড গরম লাগায় শাল খুলে ফেললো।চুল উঁচু করে বেধে প্রথমে সাইড টেবিলে রাখা গ্লাসে পানি খেয়ে ফেললো এক নিঃশ্বাসে।ভিনাকে এভাবে দেখে রুপিন বিস্মিত।দীর্ঘ এই জীবনে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া হয়নি।বিয়ের পর সুখের সংসারে বছর না পেরোতেই স্বামীকে হারাতে হয়েছে।মারা যাওয়ার এতদিন পরও স্বামীর প্রতি ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমেনি।বরং একাকীত্বে সেটা আরো ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে।এত বছর একা থাকা সত্ত্বেও নতুন কাউকে জীবনের সাথে জড়ানোর কথা কখনো চিন্তাও করেননি।তাই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে,মা হওয়ার সক্ষমতা থাকলেও,আজীবন এই শূন্য গর্ভ নিয়েই তার থাকতে হয়েছে।স্বামীর জায়গা কখনো কাউকে দিতে না পারলেও,একটা বাচ্চার আকাঙ্ক্ষা সারাজীবন তার ছিলো।অথচ এই বাচ্চা মেয়েটার অসময়ে মা হওয়া তাকে গভীর ভাবনায় ফেলেছে।কী হতো,যদি এই বাচ্চা আজকে তার হত?জুয়েল যদি বেঁচে থাকত?জীবনের প্রায় অর্ধেক পথ পাড়ি দেয়ার পর ছোট এক শিশুকে নিয়ে নতুন জীবন কিন্তু খারাপ ছিলো না।
-আন্টি।আমি জানি তুমি কী বলবে।এভাবে চুপ করে থেকো না।এই সাইলেন্স আমার জন্য খুব যন্ত্রণার। যা বলার বলে ফেলো,আই রিকোয়েস্ট।
-যত্ন নিবি নিজের।যেভাবে বলবো,সেভাবেই।
রুপিনের এই আচরণে ভিনা আশ্চর্য হলো।ধরেই রেখেছিলো,তিরস্কার দিয়ে কথা শুরু হবে।হটাৎ সব অবাস্তব লাগছে কেন?উত্তর জানা নেই। রুপিন চলে যাওয়ার পর পরই ভিনা ঘুমিয়ে গেলো।ইদানিং শরীর খুব বেশিই ক্লান্ত থাকে।যতক্ষণ ঘুম থাকে,ততক্ষণই বেঁচে থাকে মনে হয়।জেগে উঠার পর যে জীবনের মুখোমুখি হয়,সেখানে আর যাই হোক,বেঁচে থাকা হয় না।জীবনের হিসাব মিলাতে গিয়ে ভিনা সবসময়ই কিছু একটা অনুপস্থিত পায়।এই হিসাব কবে মিলবে,এই প্রশ্নে কত যে নির্ঘুম রাত পার হয়েছে,সেটা একমাত্র ভিনাই জানে।
•
-ভিনা?ভেজিটেবল স্যুপ নাও।সারাদিন কিছু খাওনি।
ঘুম চোখে তোহার দিকে তাকালো ভিনা।পছন্দের মানুষের তালিকায় তোহা সবসময়ই ছিলো।অথচ আজকে তার মুখোমুখি হতে ভীষণ অস্বস্তি কাজ করছে।ভিনা শোয়া থেকে উঠে বসলো।তোহা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো-
-মানুষের ভুল হয়ই ভিনা।আমি এটা বলবো না তুমি ঠিক কাজ করেছো।ভুল টা অনেক বেশিই বড়।তবুও জীবন থেমে থাকে না।দায়িত্ব যখন নিয়েছোই,দায়িত্ব পালন করো।ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করো।
-ঠিকাছে।
-আমি এখন ম্যামের সাথে বাইরে যাচ্ছি।আজকে সন্ধ্যায় একজন গাইনোর কাছে এ্যপোয়েন্টমেন্ট রয়েছে তোমার।আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।রেডি হয়ে থেকো।
ভিনা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।তোহা চলে যাওয়ার পরে পেটে হাত দিয়ে বসে রইলো।ভাবতেও পারছে না এমন পরিস্থিতিতে ভালো ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ও সৌভাগ্য হবে ওর।আজকে ভোর পর্যন্তও জীবন ছিলো অন্যরকম।কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সবকিছু কেমন যেন বদলে গেলো।
ভাগ্য বলতে আসলেই কিছু আছে এবং কখন কোন সময় কীভাবে বদলাবে,কেউ জানে না।মানুষ কীভাবে এত সহজে ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করে?
-এক সময় তো আমিও করতাম।
আনমনে বললো ভিনা।জানালা দিয়ে এক চিলতে রোদ বিছানায় উপর পরছে,এই রোদটাকে মুঠো করে ধরতে ইচ্ছে করছে ভীষণ।
•
রুপিনের প্রয়াত হাসবেন্ড জুয়েলের হস্পিটালেই নিয়ে যাওয়া হলো ভিনাকে।তোহা রিসেপশনে গিয়ে কথা বলে লিফট দিয়ে চার তালায় চলে এলো।সেখানে করিডোর দিয়ে ভেতরের একটা রুমে নিয়ে আসলো ভিনাকে।করিডোর থেকে ভেতরের রুম পর্যন্ত বেশ সুনসান, লাইট ও কম জ্বালানো।কোনো ভীড় নেই। তার মানে খুব কনফিডেনশিয়াল ভাবে এ্যপোয়েন্টমেন্ট নেয়া হয়েছে।ভেতরের রুমে মধ্যবয়সী একজন ডাক্তার বসা।কাঁধ পর্যন্ত চুল,সুতির শাড়ি পরা,এক হাতে ঘড়ি,আরেক হাতে ব্রেসলেট।বেশ চেনা চেনা লাগছে।খুব সম্ভবত স্বাস্থ্য বিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানে উনাকে দেখা গিয়েছে।
-গুড ইভেনিং ডক্টর সোমা।
-গুড ইভেনিং,শি ইজ প্যাশেন্ট,রাইট?
-ইয়েস।
-প্লিজ বি সিটেড।
খুব স্বল্পভাষী এই ডাক্তার অপ্রয়োজনীয় কোনো প্রশ্ন করলেন না।যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই করলেন।অবিবাহিত হয়েও মা হওয়া নিয়ে তিনি কোনো আনইজি ফিল করাননি।একজন বিশ বছর বয়সী প্রেগন্যান্ট মেয়ে তার কাছে এসেছে,বিষয়টা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখলেন।হতে পারে আগে থেকে তাকে ধারণা দেয়া হয়েছে।তবুও তার আন্তরিকতায় ভিনা মুগ্ধ হলো।
তেমন কোনো কম্পলিকেশন নেই,কিন্তু বাচ্চার গ্রোথ একটু কম।ঠিকমত খাওয়া আর ভিটামিন নেয়ার কথা বললেন ডাক্তার।সাথে আল্ট্রাসনোগ্রাফি দিলেন।
•
এখন ছয়মাস চলছে প্রেগন্যান্সির। পেট বোঝা যায়। যত্নের কোনো ত্রুটি হতে দিচ্ছে না রুপিন।নিজে করতে না পারলেও তোহাকে দায়িত্ব দেয়া আছে।তোহা রুটিন মাফিক খাবার,ভিটামিন সব টাইমলি দিচ্ছে।ভিনা এখন বাচ্চার নড়াচড়া খুব ভালোমত টের পায়।পেটের দিকে তাকালে দেখাও যায় প্রায়ই।পাঁচ মাসের সময় যে আল্ট্রাসনোগ্রাফি দিয়েছিলো ডাক্তার,সেটা করেনি ভিনা।বাচ্চাটা ছেলে নাকি মেয়ে,এ বিষয়ে জানার কোনো আগ্রহ নেই।সবকিছুর ঊর্ধ্বে, এটা ওর বাচ্চা।সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আসুক,এটাই ওর চাওয়া।
এর মাঝে একদিন সোহেল এসেছিলো।যদিও ভিনার সাথে দেখা করেনি সে।নিজের রুম থেকে নিচের তলার ড্রয়িং রুমে তাকিয়ে দেখেছিলো ভিনা।এই মানুষের সাথে আর কখনো স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকবে না।আর কখনো হটাৎ করে বাবা বলে দৌড়ে যাওয়া যাবে না,বুকে মাথা রেখে কান্না করা যাবে না।বাবা নামক মানুষটা এখন এতই দূরের হয়ে গেছে যে তার সাথে দেখাও করা যায় না,দূর থেকে এক ঝলক দেখা যায়।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিনা নিজের রুমে চলে গেলো।প্রায় ঘন্টাখানেক পরে তোহা জুস দিতে আসলে ভিনা তাকে বসার জন্য বললো-
-কিছু বলবে ভিনা?
-তোহা আপু,আজকে বাবা এসেছিলো।খুব অন্যরকম লাগছিলো তাকে।আমি জানি সে এখন আমাকে দেখতেও চায় না।কিন্তু তুমি কি কিছু জানো?মানে কেন এসেছিলো?
-সবসময় চোখে দেখা ব্যাপার সত্যি হয় না ভিনা।উনি তোমার কেয়ার করে।সিচুয়েশন এখন এমন যে উনি চাইলেও তোমার কাছে আসতে পারবে না।
-আমি জানি....
-এছাড়াও মুনা কে নিয়ে সমস্যায় আছেন উনি।
-কী হয়েছে?
-মুনাকে এসাইলামে পাঠানো হবে।
-কী!
-হ্যাঁ। প্রথমে তোমার বাবা মুনার মা কে অনেক বার অনুরোধ করেছিলো তার কাছে রাখার জন্য।আফটার অল,একজন মেয়ের সবচেয়ে আপন তার মাই থাকে।কিন্তু ঐ মহিলা কেমন যেন।নিজের মেয়েকেই সে নিবে না ঘরে।
-জানতাম।উনাকে আমার ভালোমত চেনা আছে।
-আমি অবাক হই।যাই হোক,ঐ ব্যাপারে ম্যামের সাথে কথা বলতেই তোমার বাবা এসেছিলো।মুনাকে হয়ত এই সপ্তাহেই পাঠিয়ে দেয়া হবে।
ভিনা কথা বাড়ালো না।তোহা চলে যাওয়ার পর গল্পের বই নিয়ে বসলো।আজকে কত মাস হয়ে গেছে মোবাইল ব্যবহার করেনা।এমনকি কী প্যড মোবাইল ও না।সবার খোঁজ নিতে অনেক ইচ্ছে করে।ওয়াসিম,সাদ,কথা,না জানি কত ব্যস্ত সময় পার করছে।আর আরশি?কেমন আছে মেয়েটা।একবারের জন্য হলেও যদি দেখা করা যেত।
-কী রে,কী চিন্তা করছিস?
রুপিনের ডাকে ঘোর ভাঙে।রুপিন কে ইদানিং খুবই হাস্যোজ্জ্বল মনে হয়।তোহা নিজেও একদিন বলেছে রুপিনকে আগে কখনো এত উৎফুল্ল দেখেনি সে।ভিনা ভালোমত বুঝতে পারে,মন ভালোর কারণ এই বাচ্চা।এখনি ঘর ভরে গেছে বেবি প্রোডাক্টস এ।
-এই ভিনা।কী ভাবিস এত?
-কিছু না আন্টি।
-সত্যি করে বল।এই বাচ্চার জন্য চিন্তা হচ্ছে?
ভিনা চোখ নামিয়ে ফেললো।রুপিন ভিনার হাত নিজের হাতে নিলো-
-কোনো চিন্তা না।শুধু খাবি আর ঘুমাবি।তোর কোনো দায়িত্ব নেয়া লাগবে না।আমার কথামত চল,সুস্থভাবে এই বেবিটাকে আন।বাকীটা আমি দেখবো।এই বাচ্চা জন্মের পর তোর কিছু ভাবা লাগবে না।তুই নতুন জীবন শুরু করবি।
-সবকিছু এতই সহজ আন্টি?
-এখন মনে হচ্ছে না যদিও।কিন্তু সহজ হবে সামনে।আরেকটা কথা....
-বলো..
-তুই কি নতুন জীবন শুরু করতে চাস না?
-হ্যাঁ...চাই...
খুব নিচু স্বরে উত্তর দিলো ভিনা।
-তাহলে আমাকে কথা দে....এই বাচ্চা হওয়ার পর তুই ওকে দেখবি না।
ভিনার পুরো শরীরে ঠান্ডা কিছু বয়ে গেলো।কাঁপা কাঁপা গলায় বললো-
-আমি একবার কোলেও নিবো না?
-না।
ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো রুপিন।
-আন্টি,প্লিজ,এমন করো না।
-আমার এই কথা তোর শুনতে হবে। আমি চাই না এই বাচ্চার প্রতি ইমোশনাল হয়ে তুই তোর বাকী জীবন সাফার করিস।
-আন্টি....
-ব্যস।এখানেই কথা শেষ ভিনা।আমি এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাইনা।আমার কাছে আছিস,আমার কথা শুনতে হবে।
ভিনাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুপিন তখনি রুম থেকে চলে গেলো।ভিনা অসহায়ের মত পেটে হাত দিয়ে বসে আছে।বুক ফেঁটে যাচ্ছে এই ভেবে যে কয়দিন পর এই ছোট মানুষটা ওর কাছে থাকবে না।
•
মধ্যরাতে এপাশ ওপাশ করছে ভিনা।ঘুমের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কয়দিন ধরে। এই ভারী পেট নিয়ে চলা ফেরাও করা যাচ্ছে না ঠিকমত।আজকে মায়ের কথা ভীষণ মনে পরছে।এক পাশ হয়ে শুয়ে মায়ের ছবি দেখছে।এত বড় পৃথিবীতে নিজেকে অনেক একা লাগে।এই ছোট রুমেই জগৎ। সারাদিন বাচ্চার সাথে কথা বলেই সময় চলে যেত।প্রায়ই কথা বলার সময় নড়ে চড়ে উঠত। হয়তবা মায়ের কথায় সাড়া দিতে চেষ্টা করত।এই কয় মাসে একবারের জন্য হলেও যাবিরের কথা মনে করেনি ভিনা।কেনই বা মনে করবে।হটাৎ করে ভিনা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে কোমর আর তলপেটের আশেপাশে। পাশ বদলিয়ে শুয়ে পরলো।ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চিনচিনে এই ব্যথা অসহ্য তীব্র ব্যাথায় রূপ নিলো।ভিনা চিৎকার করে তোহাকে ডাকলো।ব্যথায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।রুপিন সাথে সাথে ড্রাইভারকে বলে গাড়ি বের করলো।ডাক্তার সোমাকে ফোন দিয়ে হস্পিটালে আসতে বললো।কালো কাচের ভেতর দিয়ে বোঝার উপায় নেই কী হচ্ছে ভেতরে।হস্পিটালে পৌঁছে প্রথমেই গ্যারেজে গাড়ি ঢোকানো হলো।এরপর পেছনের দরজা দিয়ে ভিনাকে ওটিতে নিয়ে আসলো।পুরো ব্যাপারটাই ঘটলো বেশ গোপনীয়তা রক্ষা করে।
প্রথমে নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা করলেও ডাক্তার সোমা রিস্ক নিলেন না।ভিনার প্রেশার হাই হয়ে গেছে। সেন্সেও নেই ঠিকমত।আধা ঘন্টার মধ্যে ওটি রেডি করে নিয়ে যাওয়া হলো ভিনাকে।সি সেকশন এ সাধারণত রোগীকে পুরোপুরি অজ্ঞান করা হয় না।কিন্তু ডাক্তার সোমা ভিনাকে এনেস্থেসিয়া দিয়ে পুরো অজ্ঞান করে নিলেন।ভোর সূর্য ওঠার সাথে এক নবজাতকের কান্নায় পুরো ওটি রুম সরব হলো।বাইরে সোহেল আর রুপিন অপেক্ষা করছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুটফুটে এক শিশুকে তাদের কোলে দেয়া হলো।
ভিনা জ্ঞান ফিরে তাকিয়ে নিজেকে হস্পিটালের বেডে আবিষ্কার করলো,পুরো একা।ধীরে ধীরে পুরো সেন্স আসলে বুঝতে পারলো,ওর বাচ্চাটা আর ওর সাথে নিয়ে।স্যালাইন হাতে,পেটে সেলাই নিয়ে ভিনা কোনোমতে উঠে বসলো।আশে পাশে কোথাও ওর বাচ্চাকে দেখলো না।ডুকরে কেঁদে তোহাকে ডাক দিতেই তোহা এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।শান্ত করার চেষ্টা করলো।
-আমার বাচ্চাকে একবারের জন্য হলেও আমাকে দেখতে দাও আপু।একবার দেখতে দাও। আমি মারা যাবো নাহলে।আমার কলিজার টুকরাকে একটাবার দেখতে দাও।আমি পায়ে পরি তোমার।
-তোমার বাচ্চা ভালো আছে ভিনা।তুমি চিন্তা করোনা।
-আপু প্লিজ....একটু বুঝো!
-আমি দুঃখিত ভিনা।
এক পর্যায়ে ভিনা কান্না থামিয়ে দিলো।জানে এখন এই কান্নার কোনোই মানে নেই।বেশ শান্ত হয়ে ভাবলো,এটাই জীবন।হাজার অপ্রাপ্তির মাঝেই,বেঁচে থাকা শিখতে হবে।কারণ অপ্রাপ্তিই জীবনকে নতুন মানে দেয়।
.
.
.
সমাপ্ত..................................................