সকালের এক চিলতে রোদ চোখে এসে পরছে।পাশ ফিরে ঘুমপর্ব বৃদ্ধি করার আগেই ফোন বেজে উঠলো।
-এলার্মের যন্ত্রণা!
আধখোলা চোখে ফোন হাতে নিয়েই দেখলো,এলার্ম না,কল এসেছে।যে মানুষের কাছ থেকে এসেছে,তার সাথে সম্ভাব্য দূরত্ব বজায় রাখতেই পছন্দ।
-নাস্তা দেয়া হইসে আপা,মুনা খালা আপনারে ডাকতে কইসে।
-আসছি।
বিছানা থেকে নেমেই জানালা থেকে পর্দা সড়িয়ে দিলো ভিনা।হটাৎ করেই রোদের আলো সড়াসড়ি চোখে এসে পড়লো,ভিনা এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেললেও,পরমুহূর্তেই চোখে মেলে তাকালো।বাইরের উজ্জ্বল দিনটাকে মন ভরে দেখে নিচ্ছে।হাত দিয়ে অতি কষ্টে ঘাড় পর্যন্ত আসা চুলগুলো আরো এলোমেলো করে দিলো।
লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ঘরে ছড়িয়ে থাকা কার্টনের বক্সগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে ভিনা।মাস চারেক হয়ে গেছে,না বক্সগুলোর জায়গা পরিবর্তন হয়েছে,না এর ভেতরে থাকা জিনিসগুলোর।অথচ এর মধ্যে এমন অনেক জিনিসই আছে,যেগুলো বুকে আগলে রাখত আগে।
সময় বদলায়।সময়কে দেখা না গেলেও সময়ের পরিবর্তন দৃশ্যমান সবসময়।পরিবর্তনের মাধ্যমেই সময়ের অস্তিত্ব বোঝা যায়।পরিবর্তন ই সময়ের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা।
পা দিয়ে ঠেলে কার্টগুলোকে বিছানার নিচে ঢুকালো ভিনা।কতবার করে বলেছিলো বক্স খাট বানিয়ে দিতে,কী মনে করে সোহেল পুরোনো ডিজাইনে খাট বানিয়েছে,নিচে রয়েছে ফাঁকা জায়গা।রাতে ঘুমাতে গেলে প্রায়ই মনে হয় কেউ একজন নিচে নির্ঘুম রাত পার করছে,মাঝে সাঝে উপরে উঠে আসছে,কী যন্ত্রণা!
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে নতুন কেনা ফ্রেমের চশমা নাকে বসালো।নতুন নতুন চশমা নেয়াতে নাকের জায়গাটা কেমন যেন শির শির করে।পাওয়ার খুব বেশি না হলেও না চশমা না পরে থাকলে মাথা ব্যথা শুরু হয়,আবারো কী যন্ত্রণা! তবু প্রতিদিনই ভিনা কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়,আগের যন্ত্রণা আর এখনকার দিনের যন্ত্রণা গুলো মিলিয়ে দেখে।নাহ!আগের তুলনায় এখনকার গুলো কিছুই না।বরং এগুলো যন্ত্রণাও ঠিক বলা যায় না।এগুলো হলো বিরক্তি।যন্ত্রণার সংজ্ঞা অন্যরকম।ছোট ছোট বিষয়কে যন্ত্রণার নাম দেয়া বোকামি।প্রতিদিনই এই বোকামি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে ভিনা,পারছেও কিছুটা। তবুও জীবনের প্রতি কোথায় যেন অভিমানের হালকা রেশ রয়ে গেছে।
-কী রে খাবি না?খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।
শাড়ির আচল কোমড়ে গুজে দরজা খুলে মুনা দাঁড়িয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো,কানের পাশে ঘাম চিকচিক করছে।বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ দৌড়াদৌড়ি যাচ্ছে।
-আসছি আমি,মাত্র উঠেছি। তুমি খেয়েছো?
-আর পারলাম কই!
ভিনা মুচকি হাসি দিয়ে পাতলা ওরনা খুঁজতে লাগলো।
-দুই মিনিটে আসছি,তুমি খাওয়া শুরু করো।
-ঠিকাছে,আগে শোন।কাদের কিন্তু প্রোডাক্টগুলো দিয়ে গেছে,কাস্টমসে যেগুলো আটকা ছিলো।
-কখন দিলো?
-একদম সকালে এসে দিয়ে গেছে।
-ঠিকাছে।আমি বসবো সেগুলো নিয়ে।আগে প্রি অর্ডারের গুলো ক্লিয়ার করবো,বাকীগুলো সেলের জন্য রাখবো।
-করিস সময় করে,ভার্সিটি নাই আজকে?
-নাহ,মাত্রই না সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলো।
-ওহ তাইতো!খেয়াল ই নেই।তুই কিন্তু তাড়াতাড়ি নিচে আয়।
দরজা লাগিয়ে মুনা চলে গেলো।নতুন যে বিজনেস শুরু করেছে সেটা নিয়ে মুনা আর ওর ভালোই ব্যস্ততায় কাটছে সময়।দম ফেলার সময়ই পায় না ইদানিং।ফোন আবার বাজছে,ভিনা ফোন সাইলেন্ট করে নিচে চলে এলো নাস্তার জন্য।এখন সকাল পৌনে এগারোটা বাজে,আগে সকাল আটটার মধ্যে নাস্তার অভ্যাস ছিলো,এখন প্রায়ই বারোটার আগে নাস্তা খাওয়া হয় না।
•
নতুন বাসায় সব রুম গোছানো হয়ে গেছে।মোমেনা খালা আর চুমকি মিলে কয়েকদিনের মধ্যেই কাজটা করে ফেলেছে।তবে ভিনার কথামত কেউই ওর রুমে হাত দেয়নি,যার কারণে এখনো অগোছালো হয়ে আছে ঘর।ভিনার এই অগোছালোর মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে।সব গোছানো থাকলে খুব খালি লাগে,মনে হয় সব শেষ করার কিছুই নেই।মাঝে মাঝে ছড়িয়ে থাকা কার্টনের দিকে তাকিয়ে ভাবে,ভয়াবহ বিষন্ন কোনো দুপুর বা ভর সন্ধ্যায় এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকা যাবে।
বার বছর যে বাসায় কাটিয়ে এসেছে,কিছু দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলো ভিনা।ভিনার মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে ভাড়া বাসায় উঠে সোহেল।গত দেড় বছরে জীবনে পরিবর্তন এসেছে চোখে পরার মত।পুরোনো বাড়ি,পুরোনো সম্পর্ক সবকিছু পেছনে ফেলে আসতে হয়েছে এই নতুন জীবন শুরুর জন্য।তাই সবকিছুতে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
টেবিলের উপরে রাখা কাঠের খোদাই করা বক্স হাতে নিয়ে এরপর আলতো করে হাত বুলালো।বেশ কয় বছর আগে কোনো এক জন্মদিনে এই কারুকার্যে ভরা কাঠের বাক্স রুপিন দিয়েছিলো।সময়ের স্রোতে বাক্সটা রয়ে গেলেও,হারিয়ে গেছে সম্পর্ক। যেই মানুষটা জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে ভিনার সাথে ছিলো,তার সাথেই সম্পর্ক আর রাখতে পারেনি ভিনা।চরম স্বার্থপরতার পরিচয় দিয়ে সরে এসেছিলো পর্বতসম অপরাধবোধ নিয়ে।নতুন জীবন যে এমন হবে,কখনো কল্পনাও করেনি।যাদের সাথে জীবন সাজিয়েছিলো কল্পনা,বা পরিকল্পনায়,বাস্তবে তাদেরই অস্তিত্ব নেই এখন।কেউ হাত স্বেচ্ছায় ছেড়েছে স্বার্থপরতা দেখিয়ে,কারো হাত অনিচ্ছায় ছাড়তে হয়েছে স্বার্থপরতা দেখিয়ে।
বাক্সটা কার্টনে ঢুকিয়ে ল্যাপটপে মনোযোগ দেয় ভিনা।রাজ্যের মেসেজ পরে আছে ইনবক্সে। Petrichor নামের আইডিতে আর ঢোকা হয় না।নতুন নামে নতুন আইডি খোলা হয়েছে।সেখানে ভার্সিটির বন্ধু,বিজনেসের সাথে সম্পর্কিত মানুষরা এ্যড আছে।সংখ্যাটা নেহায়েতই কম না।অসংখ্য মেসেজের ভীড়ে আছে দু-চারটা ভালোবাসার প্রস্তাবও,সেগুলো ফেলে দেয়া চকলেটের খোসার মতই অপ্রয়োজনীয়।
সব ক্লায়েন্টদের মেসেজে রিপ্লাই দিয়ে ভিনা ডায়রিতে সব ইনফরমেশন তুলে রাখলো।প্রতিদিনই একটা বড় সময় যায় ডায়রিতে লিখে রাখতে।আগের ডায়রিতে আবেগের নানা কথা লেখা থাকলেও,এখন শুধুই হিসাবের জন্য এর ব্যবহার হয়।ব্যবসার স্বপ্নটা ছিলো মুনার,কিন্তু সেটাকে দাঁড় করাতে পুরো সময় আর পরিশ্রম দিচ্ছে ভিনা।একদমই যে দয়াপরবশত হয়ে কাজটা করছে এমন না।খানিকটা আবেগের জায়গাও রয়েছে এখানে,সেটা হলো 'Mahveen's' নামটা।
.
.
.
চলবে.........................................................