অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৬৯ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


ফ্যান ফুল স্পিডে চলছে,তাও ভিনার কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম পরছে।হট ফ্লাশ,প্রেগন্যান্সির একটা অংশ ও বলা যেতে পারে।হরমোনাল চেঞ্জের কারণে এই সময়ে একজন মেয়ের শরীর নানা ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়।ভিনা এতকিছু ভাবে না।ওর মনে হয় ভেতরের তীব্র যন্ত্রণা আগুনের হলকা হয়ে বাইরে বের হচ্ছে।বরফ ঠান্ডা পানিতে ডুবে থাকলেও এই যন্ত্রণা কমবে না।ভেতর পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও তুষের আগুনের মত সারাজীবন পোড়াবে। 

শুধু আজকে না,এই যন্ত্রণা বিগত কয়দিন ধরেই হচ্ছে।পরীক্ষা শেষ হতে বাকী আর দুইদিন।হ্যাঁ, পরীক্ষা শুরু হয়ে,দেড় মাস পার হয়ে,এখন শেষ ও হয়ে যাবে।এভাবেই সময় চলে যায়,আর সময়ের সাথে নিজেদের ও চলতে হয়।এই দেড় মাসে জীবন অনেক বদলে গেছে,অনেক।জীবন ভিনার ভেতর থেকে সুখ,স্বপ্ন,হাসি,আকাঙ্ক্ষা সব শুষে নিয়েছে।এতটাই নিঃস্ব করে দিয়েছে রাতের ঘুম ও সাথে নেই।প্রতিদিন রাত একটা থেকে শুরু হয়ে ভোর পর্যন্ত ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে পাতলা একটা ওড়না শরীরে জড়িয়ে রেখে বসে থাকে।মাঝে পেটে হাত রেখে কথা বলে,বই নিয়ে পরে,কখনো শুধুই বসে থাকে। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর কী করবে,বুঝে উঠতে পারছে না।আপন মানুষ যখন মাঝ সমুদ্রে ফেলে দিয়ে যায়,তখন এভাবে বসে থাকা ছাড়া কীই বা করার আছে।এখন সামনে দুইটা পথ খোলা,নয়ত আত্মহত্যা করা,নয়ত এই বাচ্চাকে নিয়ে যুদ্ধ করা।কোন পথে যন্ত্রণা একটু কম হবে হিসাব কষে ভিনা।হিসাবে যদিওবা আত্মহত্যাই উত্তর আসে বারবার,কিন্তু এর সাথে নিভৃতে যে হত্যা হবে,এর দায়ভার কে নিবে?শুধুই ভিনা?
 
গত দেড় মাসে হওয়া প্রতিটা ঘটনা চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠে।যাবির কথা দিয়েছিলো,কিছুদিন পর যোগাযোগ করবে,ততদিন ভিনাকে বলেছিলো কথা বলার চেষ্টা না করতে।দিন পেরিয়ে সপ্তাহ হলো,যাবির যোগাযোগ করলো না।প্রতি রাতে অসংখ্য বার ভিনা ফোন দিত,মনে হত এই এখনি যাবির ভরাট গলায় হ্যালো বলে উঠবে।অপেক্ষার প্রহর বাড়তেই থাকে।এর মাঝে শুরু হয়ে যায় পরীক্ষা।পরীক্ষার দুইদিন আগে প্রবেশপত্র নিতে কলেজে যায় ভিনা।পুরোনো সবার সাথেই দেখা হয়ে যায়।ওয়াসিম,সাদ,আবির,কথা।ওদের দেখে কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পরে যায়,কী সুন্দরই না ছিলো দিনগুলো!পারিবারিক সমস্যাগুলো তখনো ছিলো,কিন্তু সেটা জীবনকে প্রভাবিত করেনি সেভাবে।নতুন কলেজ,নতুন বন্ধু,প্রথম ভালোবাসা,টিউশনি সব মিলিয়ে বেশ ভালোই ছিলো ভিনা।কলেজের মেইন গেটে দাঁড়িয়ে সেদিন ও ভিনা রাস্তার ওপাড়ে দেখছিলো,যেখানে আগে প্রায়ই যাবির দাঁড়িয়ে থাকত।

-ভিনা?(ওয়াসিম)

-ওয়াসিম?কেমন আছিস?কতদিন পর দেখলাম।(ভিনা)

-ফোন টাও বন্ধ করে রেখেছিস,কতদিন কল দিয়েছি!কোচিং গুলোতেও খুঁজছি তোকে।এভাবে হারিয়ে গেলি কেন?কী হয়েছে?(ওয়াসিম)

-কোথায় কী হয়েছে?কিছুই হয়নি।শরীর ভালো ছিলো না,আবার পড়াশোনায় ও ব্যস্ত ছিলাম।(ভিনা)

-তোকে খুব ক্লান্ত আর দুর্বল লাগছে,কিছু হয়েছে?(ওয়াসিম)

-আরে,বললাম তো কিছুই হয়নি।(ভিনা)

-কিছু মনে করিস না,কিন্তু সত্যি করে বল তো,তোর সৎ মা কি খুব বেশি সমস্যা করছে?(ওয়াসিম)

ভিনা চুপ হয়ে গেলো।চোখের কোণে পানি এসে পরেছে।এর জবাব কি দেবে খুঁজে পাচ্ছে না।মুনার প্রতি সহানুভূতি থাকলেও,মুনা যে ভিনার জীবনে কতবড় ক্ষতি করে দিয়েছে,সে নিজেও জানে না।এতকিছু এক বাক্যে বুঝিয়ে বলা অসম্ভব।

-না রে,তেমন কিছুই না।(ভিনা)

-আচ্ছা বাদ দে।তুই যখন বলতে চাচ্ছিস না,আমি জোর করবো না।কিন্তু কেউ কি আসবে?এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে?(ওয়াসিম)

-না....হয়ত কখনো আসবে না....(ভিনা)

-মানে?(ওয়াসিম)

-ওহহো!মাথা গেছে আমার। বাদ দে এসব।উপরে চল। (ভিনা)

ভিনা উপরে যেতেই কথা এসে জড়িয়ে ধরলো।আবির আর সাদ পাশে দাঁড়ালো।

-হারামি একটা!ভুলেই গেছিস আমাদের। (কথা)

-ভাই আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম ভিনার বিয়ে হয়ে গেছে।(সাদ)

-আমিও ভেবেছিলাম এটা।পরে এটাও মাথায় আসছে যে তুই বিদেশে গেলি নাকি।(আবির)

-এসব হলে তো ভালোই হত।(ভিনা)

-এসব হয় নাই!?(কথা)

-কেন হবে? কপাল থাকা লাগে এগুলার জন্য।(ভিনা)

-বোর্ড পরীক্ষা তো ফাটায় দিবি,তখন দেখবি এমনিই কপাল খুলে যাবে। (আবির)

-আচ্ছা,আরশিকে দেখছি না কেন?ও কি আজকেও আসবে না! (সাদ)

-এই কথাটাই মাথায় ঘুরছিলো এতক্ষণ,মেয়েটা কি ইন্টার পরীক্ষাও দিবে না?(কথা)

-ও কি জানে আজকে প্রবেশপত্র দিবে?এই নোটিস তো মাসখানেক আগেই দিয়েছে,যদি ভুলে যায়?(আবির)

ওয়াসিম পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছে,কিন্তু কিছু বলছে না।আরশির জন্য সবচেয়ে বেশি চিন্তা ওর হচ্ছে,ও চায় না আরশি পরীক্ষাটা মিস দেক।অন্তত পাশ করে হলেও যেন পরীক্ষা এটেন্ড করে।কারণ একবার পড়াশোনায় গ্যাপ পরে গেলে,আর তাল ফিরে পাওয়া যায় না।

ভিনা ওয়াসিমের দিকে তাকিয়ে ঠিকি বুঝতে পারছে সব।মুখে না বললেও ভালোবাসার মানুষের আকুতি লুকোনো কঠিন।আরশি নিজেও জানে না সে কত ভাগ্যবতী। এই আকুতি,এই ভালোবাসাই তো ভিনা যাবিরের কাছে চেয়েছিলো,যেটা ভাগ্য থেকে মুছে গেছে হয়ত।

-আচ্ছা,রেজিস্টার অফিসে তো সব স্টুডেন্টদের রেকর্ড থাকার কথা,ওখান থেকেও কি জানা যাবে না আরশির কিছু?(ভিনা)

-তুই এতদিন আরশির সাথে থেকেও বুঝলি না ওই মেয়ে কী,তোর কি মনে হয় আরশি সঠিক ইনফর্মেশন দিয়েছে ওখানে?(কথা)

কথা ঠিকিই বলছে।আরশির পক্ষে এটা অসম্ভব কিছু না।ভিনার মন ছুটে যাচ্ছে আরশির সাথে দেখা করার জন্য।এই একজনই আছে এখন,যাকে ভিনা সব বলতে পারবে।আরশিকে জড়িয়ে হুহু করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।পরীক্ষাটা তো অন্তত দিতে পারত।কেন এমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব?


পরীক্ষার দিন সকাল,সচরাচর প্রথম পরীক্ষা বাংলাই হয়।এবারো ব্যাতিক্রম না।আগের রাতে ঘুমায় নি ভিনা।আজকে যে ওর পরীক্ষা,যাবির এটা ভালোমত জানে,তবুও একটা বারের জন্য হলেও ফোন দেয়নি,কোনো মেসেজ ও না।কিন্তু রুপিন এসেছিলো গতরাতে।বেশ কিছু ফলমূল,হরলিক্স,আর পেন্সিল কেস নিয়ে। মুনার অবস্থা দিন দিন খারাপই হয়েছে,এখন বদ্ধ পাগল বলা চলে।ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখা হয় তাকে। সোহেল মুনাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ভিনাকে সময় দিতে পারে না।তবু,পরীক্ষার আগের রাতে এসে বেশ কিছুক্ষণ ভিনার সাথে সময় কাটিয়ে গেছে।বেশির ভাগ সময় নীরবতায়ই কেটে গেছে,সোহেল জানে না,কী বললে সে তার মেয়ের কাছে অপরাধী থাকবে না।যাওয়ার সময় শুধু বলে গেছে-

-অনেক বড় হ মা।এত বড় যে এ বাড়ির মুখাপেক্ষী যেন তোকে না থাকতে হয়।

রুপিন বেশিক্ষণ থাকেনি।পরীক্ষা দেখে সময় নষ্ট করতে চায়নি সে।কিন্তু এবার রুপিনের আচরণে বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে ভিনা।কেমন যেন আড়ষ্টতা,আগের মত আন্তরিকতা নেই।কেন নেই,সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছিলো,উত্তর পায়নি।পরে আর এসব মাথায় রাখেনি।কারণ,এমনিই প্রচন্ড মানসিক কষ্টে রয়েছে।

হলে গিয়ে বসতেই কে এসে পেছন থেকে পরীক্ষার ফাইল ফেলে দিলো।ভিনা পেছনে তাকিয়ে দেখলো আরশি দাঁড়ানো।আগের থেকে শুকিয়ে গেছে।চোখ গর্তে গেছে,চাপা ভাঙ্গা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঝড় কম যায়নি এর উপরেও।না জানি কী সহ্য করতে হচ্ছে ওকে।ভিনা কিছুই বললো না,শুধু চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো।

-কী রে ছেমড়ি।কেমন আছিস?

-ভালো নেই রে আমি।

-ভিনা?সব ঠিক আছে তো?

ভিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেগন্যান্সির কথা কীভাবে বলবে হুট করে বুঝে পাচ্ছে না।কিছু কিছু সংকটের কথা শব্দে প্রকাশ করা যায় না।এছাড়াও এতদিন পর পছন্দের একজন মানুষের সামনে এসব বলতে ইচ্ছা করছে না।

-আমাকে একটু জড়ায়ে ধরে রাখবি রে আরশি।আমি হারায় যাচ্ছি সবকিছুর মধ্যে।

আরশি শক্ত করে ভিনাকে জড়িয়ে রাখলো,অনুভব করলো,চোখের পানিতে ওড়না ভিজে যাচ্ছে।

ভিনা তখনো জানে না,পৃথিবীতে কষ্ট কতটা নির্মম হতে পারে।'একজন' মানুষকে 'একটা' পাথর হতে যে পরিমাণ কষ্ট পেতে হয়,এর চেয়েও বেশি কষ্ট ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো।

তিনটা পরীক্ষা হয়ে গেছে।পার হয়ে গেছে এগারোদিন।ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে তখন। ফোন বন্ধ না যাবিরের,একদিন রিং হয়েছে সারাদিন।আরেকদিন ছিলো ব্যস্ত,তার মানে ব্লকলিস্টে রেখেছে।এরপরে একদিন ফোন রিসিভ হলো।ফোন ধরলো খুব পরিচিত কন্ঠস্বর।

-যাবিরকে ফোন দেয়া বন্ধ করো ভিনা।উই আর এংগেজড।
.
.
.
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন