অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৭০ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-জেরিন?

-বাহ্!চিনতে পেরেছো।খুব ভালো লাগলো শুনে। 

ভিনা কথা বলতে পারছে না।ফোন কান থেকে সড়িয়ে একবার নাম্বার চেক করলো,নাহ,এটা যাবিরেরই নাম্বার।তার মানে....

-হ্যালোওওও!ভিনা শুনতে পারছো?

-হুম,যাবিরকে ফোন টা দাও।

-আচ্ছা?তুমি কি অশিক্ষিত নাকি যে কিছু বললে বুঝো না?উই আর এংগেজড।বেশ কয়দিন আগেই আমাদের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।

-বুঝেছি।বারবার বলা লাগবে না।যাবিরকে দাও।আমার কথা আছে ওর সাথে।

-লজ্জা করে না তোমার অন্যের ফিয়ান্সের সাথে কথা বলতে?

-না করে না।করবেও না।যাবিরকে ফোন দাও।

-দিচ্ছি না।আর তোমার সো কলড সেল্ফ রেস্পেক্ট থাকলে আর ফোন দিবা না।শেমলেস! 

জেরিন ফোন কেটে দিলো।ভিনার কাছে সবকিছু ঝাপসা মনে হচ্ছে।একজনের জীবন কীভাবে এতখানি নিয়তির পরিহাসের বস্তু হতে পারে,ভেবে অবাক হচ্ছে। জেরিনের কথা বিশ্বাস না করে উপায় নেই,যাবিরের সাম্প্রতিক আচরণ সবই প্রমাণ করে দিচ্ছে।একটুও কান্না আসছে না ভিনার। দূর্ভাগ্যের এই ষোলকলা পূর্ণ হওয়ারই যেন অপেক্ষা করছিলো।কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে,চেয়ার টেবিলে বসলো।এতদিনে এই প্রথম নিজেকে খুব নোংরা এবং সস্তা মনে হচ্ছে।নাহলে এভাবে কেউ ছুড়ে দিতে পারে?

রাত বারোটার দিকে ভিনার ফোনে আবার ফোন আসলো,যাবিরের নাম্বার থেকে।ভিনা জানে,এবার যাবির নিজেই ফোন করেছে।আগে ফোনের স্ক্রিনে এই নাম্বার ভেসে উঠলে কত ভালো লাগাই না কাজ করত,আর এখন?কাজ করছে বিভীষিকা। আগের গভীর রাতের কথাগুলো নতুন পথচলার স্বপ্ন বুনত,আজকের রাতে হয়ত যাবিরের সাথে শেষ কথা হবে,স্বপ্ন গুলো থেমে যাবে,স্মৃতিগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠবে,কারণ যখনি স্মৃতিচারণ করা হবে,তখনি তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে হবে।ভিনা লাস্ট রিং হওয়ার আগে ভিনা ফোন ধরলো।খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো-

-কেমন আছো যাবির?

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না।

-হ্যালো?

-ভিনা,কেমন আছো?

-যেভাবে থাকার কথা সেভাবেই আছি। তোমার খবর বলো,জেরিনকে নিয়ে দিনকাল কেমন যায়?

-জেরিন?!ও তোমাকে ফোন দিয়েছিলো?

-ফোন দিবে কেন?আমিই দিয়েছিলাম তোমাকে ফোন।তোমার হবু বউ ব্যাপারটা পছন্দ করলো না।

-ভিনা.....

-বলো যাবির। আমি শুনতে চাচ্ছি।

-আমাকে ক্ষমা করে দিও....

-হাত টা ছেড়েই দিচ্ছো তাহলে?

-চাইনি আমি।

-ভালোবাসায় এসব কথা মানায় না। ভালোবাসা মানেই চাওয়া।চাইনি মানে,তুমি আমাকে কখনো ভালোওবাসো নি,তাই না।

-কিছু বলার নেই আমার।

-এভাবে কেন ফেলে গেলে আমাকে?আমি তো তোমার সান্নিধ্য চাইনি প্রথমে,তাহলে আজকে কিসের শাস্তি দিলে আমাকে?নিজেকে সস্তা করার?

-সব ভুলে যাও ভিনা।সামনে এগিয়ে যাও।জীবন পরেই আছে তোমার।

-তুমি কি ভুলেই গেলে আমি প্রেগন্যান্ট?নাকি এখন বলবে এই বাচ্চাও তোমার না।

-আমাদের আরো একটু সাবধান হওয়া উচিৎ ছিলো।

-তুমি তো সাবধান হয়েই গেলে।ঠিকই আছে।তোমাকে ব্লেম দিয়ে কী হবে।দোষ আমারই।

-দোষ পরিস্থিতির।

-যারই হোক,সেটার ভাগ তোমাকে নিতে হবে না যাবির।হাত ছেড়েছো,ভালো,বলতে এখন আমি পারবো না,সময় চাইতে।এতদিনে তো বুঝে গেছো,আমি তোমার উপর কখনোই কোনো কিছু চাপাই না।এভাবে কেন আমাকে অন্ধ প্রমাণ করলে।তোমার এই বাচ্চাকে আমি এত অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাঁচিয়ে রাখছি,পৃথিবীতে আনছি।তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসতাম যাবির!একটু উপলব্ধি করো,একটু বুঝো তুমি কী করেছো!

-তোমার জীবন অনেক সুন্দর হবে। বিশ্বাস করো। অনেক....

-ভালো কাউকে পাবো,তাইতো?কিন্তু আমি তো তোমাকেই চেয়েছিলাম,শুধু তোমাকেই।

-হয়ত আমি তোমার যোগ্য না।

-যোগ্যতার কথা এখন কেন আসলো?গত আড়াই বছরে কেন আসেনি?এখন যখন আমি তোমার বাচ্চা পেটে পরিবার হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আছি,এখনি কেন মনে হলো তুমি আমার যোগ্য না?

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসলো না।বুক ফেঁটে যাচ্ছে ভিনার।বিশ্বাস ভেঙ্গে যাওয়ার কষ্ট যে এত তীব্র,না ভাঙলে জানতোই না।প্রেগন্যান্সির কথা জেনেও এত কষ্ট লাগেনি,যতটা এখন লাগছে।কান্নায় কথা বলতে পারছে না।তবুও কাঁপা গলায় কিছু কথা বললো,নাহলে কখনোই বলা হবে না এগুলো।

-তোমাকে যেন হারাতে না হয়,এর জন্যই আমি প্রথম বছর থেকে দূরত্ব রেখেছিলাম।আমার ভবিষ্যতে জায়গা দিয়েছিলাম তোমাকে আমি।একজন মেয়ে,যার পরিবার বলতে কেউ ছিলো না,তার সব ছিলে তুমি। আমার মধ্যে এমন কি ত্রুটি ছিলো যাবির?যার কারণে আমাকে ছেড়ে দিলে তুমি?এতকিছু হওয়ার পর ও তো আমি বলিনি দায়িত্ব নিতে। শুধু বলেছিলাম পাশে থাকতে,এটাই কি আমার ভুল হয়ে গেলো?

-সত্যিই এসবের উত্তর নেই ভিনা।পারলে ক্ষমা করে দিও,জানি কষ্ট হবে।কিন্তু মেনে নাও।

-মেনে নিতাম।যা বলতে মেনে নিতাম।সময় চাইলে,দিতাম।দুই বছর,চার বছর,যাই হোক।প্রতারণা কেন করলে?সান্ত্বনার জায়গাটাও তো রাখলে না,কী বলে বুঝাবো নিজেকে।কেন আমাকে নিজের কাছেই এতটা ঘৃণ্য বানিয়ে দিলে?কেন সবাই আমাকে এভাবে ছেড়ে গেলো যাবির?

-ফোন রেখে দাও ভিনা।তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর আমার নাই।আমি মেনে নিচ্ছি আমি অপরাধী। ক্ষমা চাওয়া ছাড়া,আমি কিছুই করতে পারবো না।এক না এক দিন তুমি জানতেই সব।জলদি জেনে গেছো,ভালো হয়েছে।এখনো সময় আছে,বাচ্চা এ্যবোর্ট করে ফেলো।জীবন সহজ হয়ে যাবে।দরকার হলে আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।

-ছি যাবির!ছি!আর কত রূপ দেখাবে নিজের?

-বাচ্চাটা এ্যবোর্ট করে ফেলো ভিনা।তুমি বাচ্চা এ্যবোর্ট করলে,আমি আবার ফিরে আসতে পারবো।

-চলে যাও তুমি....প্লিজ চলে যাও.....

-ভিনা.....

-ভালো থেকো যাবির।অনেক ভালো থেকো।

ভিনা কল সাথে সাথে কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলো।এই নাম্বারে কখনো কল যাবে না ভেবেই শূন্যতা জেকে বসেছে,অথচ মানুষটাই আর নেই পাশে।সিম খুলে দিয়ে ফেলে দিলো জানালার বাইরে।সেই সাথে নিজের সব ধরনের অনুভূতি গুলোও।

সম্পর্কের যাওয়ার পর প্রথম জন্মদিনে যাবির যখন ভিনাকে ভালোবাসার কথা জানায়,ভিনা জিজ্ঞেস করেছিলো,'তুমিই যদি তৃতীয় কাউকে নিয়ে আসো' 
ভিনা তখন যদি জানতো,এটাই সত্যি হবে,অনেক ভুলগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতো। সামনের দিনগুলো অনিশ্চিত জেনেও,অপেক্ষায় থাকলো ভিনা।
.
.
.
চলবে.............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন