অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ০৪ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


সেদিন ভিনাকে চিৎকার করে ডাকা ছেলেটাকে ভিনা প্রথমে চিনতে পারেনি।রুশান,তিন বছর আগে কোচিং করত একসাথে।সেসময়ে যদি কেউ ভিনার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে থাকে,তাহলে রুশানের নাম সেখানে থাকবে।ঢোক গিলে মলিন হাসি দিয়ে ভিনা এগিয়ে আসলো।রুশান প্রায় দৌড়ে ভিনার সামনে এসে দাঁড়ালো।

-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি এখানে ভিনা!

রুশান চোখে খুশির ঝলক দেখে ভিনা বিস্মিত হলো। এতদিন পর,প্রায় অচেনা একজন মানুষকে দেখে কেউ এতটা খুশি হতে পারে?তিন বছর আগে রুশানকে দেখতে নিতান্তই বাচ্চা ছেলে লাগত,এখন মুখ ভর্তি দাঁড়ি,হালকা কোকড়া চুল আর চওড়া কাঁধে ওকে আসলেই অনেক বড় মনে হচ্ছে।কিন্তু গায়ে গতরে বড় হলেও ইম্যাচিউরিটি যে রয়ে গেছে সে ব্যাপারে ভিনা নিশ্চিত হয়ে গেছে প্রথম দেখাতেই। নাহলে এভাবে কেউ চিৎকার করে বাচ্চাদের মত দৌড়ে আসতে পারে?

-ভিনা!তুমি পুরো চেঞ্জ হয়ে গেছো।

-তুমিও তো চেঞ্জ হয়ে গেছো রুশান।আমি প্রথমে চিনতেই পারিনি।

-চিনতে পারোনি?

বেশ মন খারাপ নিয়ে রুশান প্রশ্নটা করলো।

-না মানে,কত বড় লাগছে তোমাকে।চেঞ্জ এসেছে কত।আর আমাদের তো মাঝখানে দেখাও হয়নি কয় বছর।

-ঠিক।কিন্তু আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি প্রথমেই।ভুলিনি তোমাকে।

ভিনা কথাটা কীভাবে নিবে বুঝতে পারলো না।রুশানকে দেখে ভিনা মোটেও খুশি হয়নি,কারণ ওরা একসাথে যে কোচিং এ পড়ত,সেখানে যাবির পড়াত।
তাছাড়া মকবুল স্যারের ঘটনার জন্য ইতস্ততা তো আছেই।সব মিলিয়ে প্রথম দেখা ভিনার জন্য মোটেও কম্ফরটেবল ছিলো না।

-খুব খুশি হলাম,তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো।

-এভাবে হারিয়ে গেলে কেন?সোশ্যাল মিডিয়াতেও নাই।

-এমনি।আমি একটু ইন্ট্রোভার্ট ই।

-সেটা দেখলেই বোঝা যায়।

ভিনা প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো কথা শুনে।ইচ্ছা করছে এই ছেলের দুই গালে চড় মেরে এখনি সম্ভাব্য যে বন্ধুত্ব উঁকি দিচ্ছে সেটাকে শেষ করে দিতে।

-আজকে আসি আমি। ক্লাস আছে আমার।

-কোন ডিপার্টমেন্ট? 

-ইকোনমিকস

-খুবই ভালো।আমি বায়োটেক। 

ভিনা যথাসম্ভব নিজেকে ঠান্ডা রেখে দ্রুত এই কনভারসেশন শেষ করতে চাচ্ছে।

-ঠিক আছে রুশান,আমি আসি এখন।

-দাঁড়াও,ফোন নাম্বার টা দিয়ে যাও ভিনা।

ভিনা এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো থাপ্পড় টা গালে পরেই গেলো মনে হয়।সংবরণ করে আবার কথা শুরু করলো-

-নতুন সিম,নাম্বার মুখস্ত নেই।

-তোমার ফোন থেকে আমার নাম্বারে ফোন দাও।

-টাকাও নেই।

-কী ডেঞ্জারাস!টাকা ছাড়া ফোন ইউজ করো কেন? জিরো ব্যালেন্স নিয়ে চলাটা কত রিস্কি জানো?

-এরপর থেকে রাখবো মনে করে।

-অবশ্যই! আর শোনো ফেসবুক আইডিটা দিয়ে যাও অন্তত,এখন বলো না ফেসবুক ও ইউজ করো না।

-মানে....আসলে....

-কী?আচ্ছা দিও না।আমি জানি তুমি নাম্বার টাও ইচ্ছা করে দাওনি।

ভিনা ভালো মুশকিলে পরলো।এ কেমন অভিমানী ছেলেরে বাবা!পরে ভেবে দেখলো রুশান আগেও কখনো বিরক্ত করেনি,ওর একটাই সমস্যা,ভিনাকে দেখে অতি উৎসাহী হয়ে যাওয়া।এটাকে কতখানি অপরাধের প্যারামিটারে ফেলা যেতে পারে,সে ব্যাপারে সন্দিহান ভিনা।তাই বেশি না ভেবে নিজের আইডি দিলো।রুশান সানন্দে আইডি নিয়ে বিদায় জানালো।

-কালকে দেখা হবে!আমি আসি আজকে।

-ঠিক আছে।ভালো থেকো।

ভিনা সেদিনের মত হাফ ছেড়ে বাঁচলো।ভাবলো পরেরদিন আর খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা রাখবে না।লাইব্রেরির একদম কোণায় যেয়ে ঘাপটি মেরে থাকবে।এরপর ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রুশানের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট।পাঁচ মিনিট ও হয়নি আইডি দিয়েছে।ভিনা তখনি এক্সেপ্ট করলো না,বাসায় গিয়ে গভীর রাতে এক্সেপ্ট করলো রিকোয়েস্ট,সেই সাথে রেস্ট্রিকশনেও দিয়ে রাখলো।কিন্তু রুশানের আইডি স্টক করে দেখলো।প্রোফাইল ভর্তি বিভিন্ন মডেলের গাড়ির সাথে নিজের ছবি।আরো আছে বাইরে ভ্যাকেশানে যাওয়ার ছবি।স্ট্যাটাস নেই বললেই চলে,যাই আছে,সেগুলো খুব হালকা মানের। যেমন সিঙ্গেল লাইফ ইজ বেস্ট,লেট নাইট আউটিং এর মজাই আলাদা,ঘুরো ফিরো খাও ইত্যাদি। ভিনার পুরোই বিপরীত স্বভাবের রুশান।চেনা মানুষ পাওয়া গেলেও তার সাথে বন্ধুত্বের কোনো সুযোগ নেই ভিনা ভালোমত বুঝে গেলো।একদিনে এতসব বুঝে মাথায় প্যাঁচ লেগে গেছে।


ভার্সিটিতে উঠার পাঁচ মাসের মাথায় সোহেল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বাসা বদলে ফেলার।এ বাসা জুড়ে অনেক অভিজ্ঞতার স্মৃতি বোনা থাকলেও ভিনা একবারের জন্য ও আপত্তি করলো না।কারণ শেষের কয় মাসের তিক্ত অভিজ্ঞতার একধরনের গুমোট ভাব রয়ে গেছে।আগের জীবনের কিছুই অবশিষ্ট নেই।তার মা মারা গেলো,সাথে নিয়ে গেলো তাদের জীবনের সব সরল সমীকরণ গুলো।এরপর একের পর এক জটিলতা এসে জীবনের মোড় এমনভাবে ঘুরালো,যেটা কল্পনাও করেনি ভিনা।এখন চাইলেও পুরোনো জীবন ফিরে পাওয়া সম্ভব না,কিন্তু নতুন জীবন শুরু করা সম্ভব।ভিনা দ্বিতীয়টাকেই বেছে নিয়েছে।নতুন বাসায় ওঠার পর মুনার সাথে একদিন বসেছিলো ব্যবসা শুরু নিয়ে কথা বলতে,যখন বললো প্রতিষ্ঠানের নাম 'Mahveen's' হবে,তখন চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো মুনার।।মুনা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি যে তার জীবনের সব অপূর্ণতা এক এক করে বাস্তব হবে,আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে,সেটা ভিনার বাস্তবতায় রূপ দেয়া।ডিজাইনার কাপড় আর কসমেটিকস নিয়ে আপাতত ব্যবসা আগাচ্ছে,সামনে প্রোডাক্ট রেঞ্জ আরো বাড়ানোর ইচ্ছা আছে।বাইরে থেকে প্রোডাক্ট এনে যাবতীয় হিসাব রাখার কাজে সিদ্দিক চাচার ছেলে কাদের কে রাখা হয়েছে।সিদ্দিক চাচা স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী, ছেলেকে কাজের সুযোগ দেয়ায়,উনি যেন বৃদ্ধ বয়সের অসুস্থ শরীর নিয়ে খানিকটা আশার আলো পেয়েছেন।কাদের নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা দেখাশোনা করছে।

জীবন এত গোছানো কীভাবে হলো হটাৎ? ঝড় শেষে এত শান্ত কেন সবকিছু?ভয় হয়,ভিনার প্রচুর ভয় হয়।
.
.
.
চলবে...........................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন