শ্রীঘর
অন্তিম পর্ব ১০
আতিয়া আদিবা
.
.
.
আগামীকাল কোর্টে সাহিলের শেষ দিন। দিবা বারান্দায় বসে আছে। হাতে চায়ের কাপ। কিছুক্ষণ আগে দিবার মা এসে চা দিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কাপে এক চুমুকও দেওয়া হয় নি। চায়ের ওপর মোটা সড় পড়ে গেছে। দিবা একমনে তাকিয়ে আছে সড়ের দিকে। হঠাৎ কই থেকে একটা মাছি এসে চায়ের কাপের চারিদিকে চড়কির মতো ঘুরতে লাগলো। দিবা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠলো। দিবা কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে তিয়াসের গলা শুনতে পাওয়া গেলো,
" তুমি এক্ষুণি দ্যা ক্যান্সার রিডিউস হসপিটালে চলে আসো।"
" কেনো তিয়াস! তোমার কি হয়েছে?"
" দিবা তুমি আসো। আসলেই সব বুঝতে পারবে।"
একথা বলার পর ফোন কেটে দিলো তিয়াস। দিবার মনে অজানা ভয় কাজ করতে লাগলো। কি হয়েছে তিয়াসের? ক্যান্সার হসপিটালেই বা ও কি করছে! চায়ের কাপ বারান্দার মেঝেতে রেখে ঘরে চলে গেলো দিবা। আলমারি খুলেই সাহিলের দেওয়া প্রথম শাড়িটা চোখে পড়লো তার। এই শাড়িটাই আজকে সে পরবে। কেনো পরবে তার কোনো উত্তর দিবার জানা নেই। এই পরিস্থিতিতে তার কোনো উত্তর খুঁজতেও ইচ্ছা করছে না। দিবা তৈরি হয়ে নিলো।
পরেরদিন।
বেলা ১২ টা।
সাহিল এবং পিয়া দুজনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। দিবাকে কোর্টে দেখা যাচ্ছে না আজ।তিয়াস গাউন ঝাঁকি দিয়ে পিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
"তাহলে, মিস পিয়া। ভালো আছেন?"
পিয়া হেসে বললো, " জ্বি ভালো, আপনি?"
" অনেক ভালো আছি। আচ্ছা আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে।"
" কি প্রশ্ন?"
" যে ছেলেরা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে বা শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করে তাদের তো আমরা নানাভাবে চিহ্নিত করি। উত্ত্যক্তকারী, ধর্ষক।
কিন্তু যে মেয়েরা সেক্স আপিল করে তাদের কি বলা উচিত?"
পিয়া একটু রেগে গিয়ে বললো,
"এসব কেমন প্রশ্ন করছেন? আমি কিন্তু অপমানিত বোধ করছি।"
রুশাও বলে উঠলো,
" আই অবজেক্ট ইওর ওনার!"
জজ তিয়াসকে বললেন,
" আপনি কোর্টের সময় নষ্ট করছেন।"
" মোটেও না। আমি একটি সিসিটিভি ফুটেজ দেখাতে চাই, মাই লর্ড। তাহলেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
তিয়াসের এসিস্ট্যান্ট ফুটেজ অন করে দিলো। সবাই হা করে তাঁকিয়ে দেখছে। সেখানে একজন মেয়ে একজন ছেলেকে রীতিমত সেক্স আপিল করছে। ছেলেটা বারবার বাঁধা দিচ্ছে। ফুটেজ শেষ হওয়ার পর তিয়াস বললো,
"এই ফুটেজ ভার্সিটি থেকে সংগ্রহ করা। উক্ত ফুটেজে যে মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে সে আর কেউ না, মিস পিয়া সাহা।"
পুরো ঘর জুড়ে শোরগোল শুরু গেলো। জজ সবাইকে থামতে বললেন। পিয়া ব্যস্ত হয়ে বললো,
" মিথ্যা, এসব মিথ্যা।"
তিয়াস অবাক হয়ে বললেন,
" কি মিথ্যা?"
" এই ফুটেজ ইডিট করা। এটা মোটেও আমি নই।"
" এটা আপনিই। ভালো করে দেখুন।"
" আরে এটা ভার্সিটির সেই জায়গা নয় যেখানে আমি সেক্স আপিল করেছি। আপনি বললেই হলো?"
একথা বলে পিয়া মুখে হাত দিয়ে চুপ হয়ে গেলো। তিয়াস মুচকি হেসে বললো,
" তাহলে কোন জায়গায় আপনি সেক্স আপিল করেছিলেন মিস.পিয়া? "
পিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
" আমি কিছু বলি নি।"
"আপনি মাত্র বলেছেন। অনেক নাটক করে ফেলেছেন আপনি। এবার সত্যিটা বলুন।"
তিয়াস ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
" বলুন।"
পিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,
" হ্যাঁ করেছি। আমি সেক্স আপিল করেছি। আমার মধ্যে কি ছিলো না? আমি সুন্দরী ছিলাম, সাহিলকে ভালোও বাসতাম। তাহলে ও কেনো আমাকে ভালোবাসবে না? কেনো?"
রুশা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। তিয়াস পিয়ার সামনে গিয়ে বললো,
" কারন চেহারাই সবসময় সবকিছু না মিস. পিয়া। "
পিয়া এবার হেসে বললো,
"এই থেকে কি এটা প্রমাণ হয়ে যায় সাহিল নির্দোষ? প্রমাণ করতে পারবেন কাজের লোকের শরীরের প্রতি ওর কোনো মোহ নেই? ও স্পর্শ করার চেষ্টা করে নি?"
তিয়াস হাসতে হাসতে তার এসিস্ট্যান্ট লিমুরার কাছে গেলো। কানে কানে কিছু একটা বললো। লিমুরা উক্ত স্থান থেকে বেরিয়ে এলো এবং ফিরে এলো জমিলাকে সঙ্গে নিয়ে। তিয়াস এবার জমিলার সামনে গিয়ে বললো,
" আমি বিশ্বাস করি, একজন বোন কখনো ভাইয়ের ক্ষতি করতে পারে না। আপনি কোর্টকে সব খুলে বলুন।"
জমিলা কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
আমার পোলার বয়স ৪ বছর। সে জন্মানোর পর তার বাপে আরেক মাইজ্ঞার লগে ভাগছে। আমি পরের বাড়ি কাম কইরা নিজের আর পোলার পেট চালাইতাম। হঠাৎ কইরা পোলার পেট ব্যাথা শুরু হয়। কিছু খাইতে পারে না। বুক জ্বালা করে। সারাদিন রাত কান্দে। দিবা আফারে কইলে, আফায় আমারে টাকাও দেয় টেস্ট করাবার লাইগা। প্রথম অবস্থায় ডাক্তার কয় আলসার হইছে। ওষুধ পত্র লিখা দেয় কিন্তু কাম অয় না। পরের বার যখন টেস্ট করাই তখন ধরা পরে পোলার স্টমাক ক্যান্সার। আলাসার না। আমি হসপিটালের মেঝেতে বইসা বাবুরে জড়ায় ধইরা কানতাছি। তখন দেবীর রুপে এই অলক্ষ্মীর লগে দেখা।"
পিয়ার দিকে আঙ্গুল তুলে বললো জমিলা।
"হে আমারে কইলো তার একডা কাম কইরা দিলে হে আমার পোলার চিকিৎসার সব খরচ দিবো। আমি রাজি হইয়া যাই। এই মহিলা, সাহিল ভাইয়ের সংসার খাইতে চাইছে। দিবা আফারে সহ্য করতে পারে না। এর কথাতেই আমি এতকিছু কইছি। এখন আমার কোনো ভয় নাই। আমার পোলার পাশে দাঁড়ানোর মতো মেলা মানুষ আছে। শাস্তি পাইলে পামু কিন্তু মিথ্যা অপবাদ দিয়া বাঁচতে পারুম না"
সাহিলের দিকে তাঁকিয়ে হাতজোড় করে জমিলা বললো,
"ভাই আমারে মাফ কইরা দিয়েন।"
তিয়াস জজের দিকে তাঁকিয়ে বললো,
" দ্যা ডিফেন্স রেস্টস হিজ কেইস।"
জজ সবকিছু শুনে বললেন,
" এই আদালত, মিথ্যা অভিযোগের দায়ে জমিলাকে পুলিশ হিফাজতে নাওয়ার আদেশ দিচ্ছে ও মিস. পিয়া সাহাকে গ্রেফতার করার হুকুম দিচ্ছে এবং সাহিল সাহেবের নিকট মার্জনা চেয়ে তাকে সসম্মানে মুক্তি দিচ্ছে।
দ্যা কেইস ইজ ক্লোজড।"
কোর্ট থেকে বেরিয়ে তিয়াসকে জড়িয়ে ধরলো সাহিল।
" থ্যাংক ইউ তিয়াস। থ্যাংক ইউ সো মাচ।"
" ভাইয়া, ধন্যবাদ দিয়ে আমাকে ছোট করবেন না। এটা আমার প্রফেশন, আমার ডিউটি।"
" আগামীকাল দুপুরে বাসায় চলে আসবে।"
এর মধ্যে রুশা এসে দাঁড়ালো।
" সর্যি ফর ইন্টারাপ্ট। কনগ্রেচুলেশন্স মিস্টার সাহিল।"
" থ্যাংক ইউ।"
তিয়াস ইতস্তত করে বললো,
" রুশা আমার হবু স্ত্রী।"
সাহিল আকাশ থেকে পড়লো।
" মানে?"
রুশা বললো,
"আগামী মাসে আমাদের বিয়ে। সমস্যা নিয়ে কার্ড আমরা নিজেরা গিয়ে দিয়ে আসবো।"
" আপনাদের কোর্টে দেখে এরকম কিছুই মনে হয় নি!"
" প্রফেশনাল লাইফ এবং পার্সোনাল লাইফ সবসময় গুলিয়ে ফেললে কি চলে মিস্টার সাহিল?"
" তা ত অবশ্যই! আগামীকাল অবশ্যই তিয়াসের সাথে বাসায় চলে আসবেন।"
" অবশ্যই।"
" আচ্ছা তিয়াস, দিবা কেনো কোর্টে আসে নি?"
" ভাইয়া বাড়ি গেলেই বুঝতে পারবেন।"
সাহিল হাত মিলিয়ে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
রাত ১০ টা বাজে। জ্যোৎস্নার আলোয় টইটুম্বুর বারান্দা। সাহিল বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত বাসা ভর্তি মানুষ ছিলো। সাহিল ফিরে আসার আনন্দে দিবা ওয়েলকাম পার্টি এরেঞ্জ করেছিলো। রাতে জম্পেস খাওয়া দাওয়া হয়েছে। দিবা সবকিছু গুছিয়ে বেডরুমে এলো। সাহিল নেই। বারান্দার দরজা খুলতেই সাহিল দিবার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো।
" কি করছো?"
" বউকে ভালোবাসছি।"
দিবা কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলো।
"অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুমাবে চলো।"
" আজ তো আমি ঘুমাবো না।"
" তাহলে কি করবে?"
সাহিল মেঝেতে জোড় আসনে বসে দিবাকে তার কোলের ওপর বসালো।
"আজ আমরা জ্যোৎস্নাবিলাস করবো। তুমি গান গাইবে আর আমি শুনবো।"
" কি গান?"
" রবীন্দ্রসংগীত! যেটা তোমার ইচ্ছে।"
দিবা আকাশের দিকে তাঁকিয়ে গান ধরলো।
" চাঁদের হাসির বাধ ভেঙ্গেছে
উছলে পরে আলো,
ও রজনীগন্ধা তোমার
গন্ধ সুধা ঢালো...."
চারিদিকে এলোমেলো বাতাস বইছে। দিবার চুলগুলো উড়ছে। সাহিলের চোখে মুখে লাগছে। সেই চুলে রজনীগন্ধার গন্ধ!
সমাপ্তি।
--------------------------------------------------------------------------
#নতুন_গল্প
অংক কষার ফাঁকে ইচ্ছা করে স্যারের পায়ের সাথে নিজের পা ঠুকে দিলো রায়া। কান্ড ঘটিয়ে নিজেই এমন ভাবে চমকে উঠলো যেনো মনের অজান্তেই এই ঠুকার বিষয়টি ঘটে গেছে। সে ব্যস্ত হয়ে বললো,
'সর্যি স্যার। ভুলে লেগে গেছে।'
অভ্র জানে কাজটি রায়ার ইচ্ছাকৃতভাবে করা। 'ভুলে লেগে গেছে' কথাটি বাহানা ছাড়া কিছুই নয়। তবুও সে বললো,
'সমস্যা নেই। অংকটা শেষ করে ফেলো।'
রায়া মুখ গোঁজ করে অংক কষতে লাগলো।সাব্জেক্টটি সে দুচোখে সহ্য করতে পারে না। অথচ এই সাব্জেক্টটাই গলার কাটার মতো তার জীবনে বিঁধে আছে। কোনোভাবেই নামছে না।রায়া এস এস সি পরীক্ষার্থী। গত দুই বছর ধরে সে টানা এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই পাশ করতে পারছে না। বারবার এই একটা সাবজেক্টেই ফেল করে। গণিতে। মেয়েটা অংকে ভীষণ কাচা। শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তি নুরুল আলমের একমাত্র কন্যা রায়া। তাকে অংকে উতরিয়ে দেওয়ার জন্য কম চেষ্টা করা হয় নি। শহরের সবচেয়ে নাম করা অংক শিক্ষকদের তাকে পড়ানোর জন্য বাসায় নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই মেয়েটা পনেরো এর ওপর নম্বর পায় না। পশ্চিমের সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক আফজাল আলীকে শহরের সবাই অংকের বাঘ বলে ডাকে। তার তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ পাঁচ মাস পড়লো রায়া। আফজাল আলী প্রথম দিন পড়াতে এসেই রায়ার হাতে নতুন রুটিন ধরিয়ে দিলো। সেখানে লিখা_ দুপুরে খাওয়ার আগে এক ঘন্টা এবং খাওয়ার পর দুই ঘন্টা অংক করতে হবে। রাতে ঘুমানোর আগে দুপুরের অংকগুলো রিভিশন দিতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অংকের সূত্র গুলোয় চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। এত কিছু করেও বিশেষ কোনো লাভ হলো না। ফলাফল- যাহা লাউ তাহাই কদু টাইপ। টেস্টে রায়া নম্বর পেলো 'পাঁচ'। আফজাল আলী তার পরের দিনই নুরুল আলমকে গম্ভীর মুখে চিঠি লিখতে বসে গেলেন। চিঠির সারমর্ম হলো, এই মেয়েকে সে কোনোভাবেই পড়াতে পারবে না। শহরে তার অন্যরকম নাম ডাক রয়েছে। তাকে সবাই আলাদা চোখে দেখে। তার কাছে পড়েও যদি রায়া অংকে ফেল করে তাহলে উনার সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
.
.
.
সমাপ্ত.......................