-আপুইইই.....
শব্দের শেষে অতিরিক্ত 'ই' স্বরবর্ণ ব্যবহার শিখেছে মাহভিন।সবকিছুতে তার এই ভাষার দক্ষতা সে দেখাবে।
ভিনা মাহভিনকে কোলে নিয়ে বসলো।সামনে ল্যাপটপ খোলা।মাহভিন উপুড় হয়ে কীবোর্ডে হাত রেখে খেলতে চাচ্ছে।ভিনা ল্যাপটপ নিরাপদ দূরত্বে রেখে মাহভিনকে দুই হাত দিয়ে আটকে রেখেছে।
-দাউউউউ
-উহু,এটা পঁচা, নেয়া যাবে না,কাম্মড় দিবে!
-কামুউউউর,এটা ইই?
-এটা কী?এটা ব্যাথা।
মাহভিন চোখ গোল গোল করে ভিনার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাথা ব্যাপারটা কতটা ভয়ানক। আশ্বস্ত না হয়ে আবার ল্যাপটপে আক্রমণ করতে নিলে ভিনা ওকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
ভাবতেই অবাক লাগে ওর বাচ্চা বড় হচ্ছে একটু করে। কতটা অনিশ্চিত ছিলো ওর এই পৃথিবীতে আসা।এখন সে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে চঞ্চলতা দিয়ে।যাবিরের সাথে ওর বাচ্চা পেটে নিয়ে বিচ্ছেদ যতটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো,মাহভিনের একটা ভালো জীবন ততটাই অনিশ্চিত ছিলো।কিন্তু সৃষ্টিকর্তার মর্জি কেউ জানে না,তার পরিকল্পনা গুলোও না।
-দেখেছো!দুষ্টুটা এখানে!
মুনার ডাকে ঘোর ভাঙে ভিনার।মুচকি হাসি দিয়ে মাহভিন কে মুনার কোলে দেয়।
-তোমার মেয়ে তো এখনি বিজনেস করতে চায়।ল্যাপটপ দেখে লাফিয়ে পরছিলো।
-কে বলবে এটা মেয়ে বাচ্চা,ছেলের চেয়েও বেশি চঞ্চল।এক ঘন্টা ধরে সেরেলেক নিয়ে ঘুরছি,খাচ্ছেই না।
-ছোটবেলায় আমিও সেরেলেক নিয়ে তালবাহানা করতাম।
-বোনের মতই হয়েছে পিচ্চি।
মুনা হাসতে হাসতে চলে গেলো। ভিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে,কখনো ভেবেছিলো নিজের মেয়েকে বোন হিসেবে বড় করবে?জীবন এত অদ্ভুত কেন?
•
মাহভিন কে সেদিন মুনার কোলে তুলে দেয়ার পর মুনার প্রাপ্তির কান্না দেখে ভিনা উপলব্ধি করেছিলো যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে,সেটা একটুও ভুল না।মুনা যেই যত্নে ওর বাচ্চাকে বড় করবে,সেটা এই অল্প বয়সে,তাও আবার সেই বাচ্চার বাবা ছাড়া ওর পক্ষে করা অসম্ভব।আর রুপিনের কাছে হয়ত অর্থ বিত্তের অভাব হত না ঠিকি,তবে সময়ের অভাব হত অবশ্যই।
মুনা নিজের এই নাজুক অবস্থায় ও মাহভিনের যত্নে ত্রুটি করেনি।স্বাভাবিক হতে ছয় মাস সময় লেগেছে তার।ধীরে ধীরে অবশ্য উপলব্ধি করেছে,জানতেও পেরেছে এই বাচ্চা তার নিজের না।তবে এতটুকুই জেনেছে যে সোহেল এই বাচ্চা দত্তক নিয়ে এসেছে মুনার সুস্থ হওয়ার জন্য।সে এখনো জানে না নিজের সৎ মেয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান সে বুকে আগলে বড় করছে।সোহেল কিছু না বললেও ভিনা ভালোমত জানে সোহেল কখনো চাবে মুনা এটা জানুক,যদিও সোহেলের সাথে কখনো কথা হয়নি এই বিষয়ে,তবু কিছু জিনিস সময়ের সাথে বুঝে নিতে হয়।
মাহভিনের জন্মের পর ভিনা সবকিছু থেকে দূরে ছিলো অনেকদিন।ততদিনে ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে।এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি ভিনার পক্ষে।চোখের সামনে পছন্দের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয়ে পড়ার স্বপ্ন নিমিষেই ধূলিসাৎ হতে দেখে আরো ভেঙ্গে গিয়েছিলো ভেতরে।নিজেকে অসহায় এবং খুব অযোগ্য মানুষ মনে হত।এই সময়টাতে কারো সাথেই কথা বলত না ভিনা।এমনকি সপ্তাহে এক দুইবার দেখা হত মুনা অথবা সোহেলের সাথে,একি বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও।
সবকিছু এতটাই দূর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো যে আত্মহত্যার কথাও মাথায় এসেছে অনেকবার।
এমন অবস্থায় একদিন নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভোর হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগেই ঘর থেকে বের হয় ভিনা।সাথে কিছু নেই,না টাকা,না জামা কাপড়, না নির্দিষ্ট ঠিকানা।ব্যাপারটা এমন যে মন চাইলে বাড়ি ফিরবে,নাহলে হারিয়ে যাবে।মাহভিন,সোহেল আর মুনার, তিনজনের যে ছোট সংসার হয়েছে,সেখানে নিজের অবস্থান নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগছিলো।অবচেতন মনেই পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করে ভিনা কলোনির দিকে পা বাড়ায়।কতদিন পর এলো কলোনিতে!আগের দারোয়ান চাচা এখনো আছেন।উনি এ অসময়ে ভিনাকে দেখে বেশ অবাক হলেন।ঘুম চোখে যদিও বা কিছু জিজ্ঞেস করলেন না,পরিচিত দেখে ঢুকতে দিলেন।
সোডিয়ামের আবছা আলোয় কলোনির পরিচিত রাস্তাটা অনেক বেশিই অপরিচিত লাগছে।এই রাস্তা ধরেই একদিন যাবিরের সাথে প্রথম কলোনিতে এসেছিলো ভিনা।এমনই অসময়ে।ভোর দেখিয়ে যে মানুষ জীবনে আশার আলো দেখিয়েছিলো,সেই সবচেয়ে ঘন অন্ধকারে ভিনাকে ফেলে রেখে গেছে।আচ্ছা যাবির কি জানে ওর বাচ্চা হাঁটতে পারে এখন,যাকে একসময় আসতেই দিতে চায়নি সে?ধীর পায়ে যাবিরের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ভিনা।জানালায় নতুন পর্দা। হয়ত জেরিন আর যাবির মিলে নিজেদের ছোট সংসার সাজিয়েছে ওখানে,অথচ এখানে ভিনার থাকার কথা ছিলো,একবুক রঙিন স্বপ্ন নিয়ে।চোখের কোণে পানি জমে ঘোলা হয়ে গেছে দৃষ্টি। এতটাও কষ্ট মানুষ পায় জীবনে?কেন পায়?সুখের জন্য? সুখ আসলে কেমন?দুঃখ তো সুখ হারিয়ে গেলে হয়,সুখ হারিয়ে কি সুখী হওয়া যায় কখনো?
ভিনা খেয়াল করলো পূর্বদিকটায় অনেক সুন্দর মায়াবী একটা রঙ হয়েছে আকাশে।চোখ মুছে পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো।আজকে আর কেউ নেই এই ভোর দেখায়,সম্পূর্ণ একা,নিঃস্ব সে।
তবে একটা ব্যাপার উপলব্ধি করলো,একা থাকা সত্ত্বেও ভোর হয়েছে,আগের সৌন্দর্যে,আগের আশা জাগানিয়া রূপে।প্রকৃতি এটা দেখে না কে একা,কে না।প্রকৃতি সবার মাঝেই মায়া ছড়িয়ে দেয়।যদি সেদিন একা ভোর দেখার সাহস থাকত,তাহলে অসীমসম এই অন্ধকার তার জীবনে আসত না।
ভিনা বুঝতে পারলো,বেঁচে থাকার জন্য তার কারো দরকার নেই।সে নিজেই নিজের জীবনে ভোর হতে পারে। এখন এই মুহূর্তে সে নিঃস্ব,তার মানে সে নতুন করে জীবন গোছাতে পারবে। পালিয়ে যাওয়া কখনো কিছুর সমাধান হতে পারে না।আজকে নিজে মা হওয়ার পর ভিনা টের পাচ্ছে,সোহেলকে ছেড়ে চলে গেলে কী অসহ্য কষ্ট পাবে তার বাবা। চোখে না দেখেও মাহভিন থেকে দূর হওয়ার কষ্ট,ভিনা আজো ভুলেনি।যাবির তো নিজের জীবন গুছিয়েই নিয়েছে,তাহলে ভিনা কেন পারবে না?অবশ্যই পারবে,পারতে হবে।প্রতারকের পিছুটানে জীবন থামিয়ে দেয়া চরম বোকামি ছাড়া কিছুই না।একটা মাত্র জীবন ক্ষণিকের কারো জন্য থামিয়ে রেখেছিলো,এটা ভেবেই ভিনার ভেতরে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।
বাসায় যেয়ে নাস্তা করে ভিনা সোহেলের ঘরে গেলো।সোহেল মাহভিনকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে।মাহভিন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
-বাবা,আমার কিছু কথা ছিলো।
-বল
-আমি পড়াশোনা শুরু করতে চাই।
সোহেলের ক্লান্ত চোখে মুহূর্তেই আনন্দের ঝলক দেখা গেলো।মাহভিনকে পাশে শুইয়ে নিজে বসলো।
-তুই সত্যি আবার পড়াশোনা শুরু করতে চাচ্ছিস?
-হ্যাঁ বাবা
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাহভিনের দিকে তাকিয়ে,নরম শরীরে হাত বুলিয়ে ভিনা আবার বললো-
-অনেক কষ্ট দিয়ে দিয়েছি তোমাকে।অনেক বড় ভুল হয়েছে জীবনে।এখন আর এই কষ্ট আর বাড়াতে চাই না,নিজের জীবনটা স্বাভাবিক করতে চাই।
-অবশ্যই!আর একটা কথা,তোর এই ভুল তোর একার না।এখানে আরো অনেকের কর্মফল আছে।পেছনের কথা এখন না টানি।তুই যাই করিস,আমি পাশে আছি তোর।
হটাৎ করে মুনা ঘরে ঢুকলো।সোহেল আর ভিনাকে অনেকদিন পর একসাথে দেখে খুব খুশি হলো।
-এই দৃশ্য দেখার জন্য আমি অনেকদিন অপেক্ষা করেছি জানো ভিনা?আজকে আমার অনেক ভালো লাগছে!
মুনা এসেই ভিনাকে জড়িয়ে ধরলো।চোখের পানিতে ভিনার কাঁধের জামা ভিজে যাচ্ছে।
-থেমে যা...ও
-আমাকে ক্ষমা করে দিবা মা?
-দিয়েছি আমি,অনেক আগেই।
-কীভাবে বুঝবো?
-মাহভিন যদি অনেক খুশি থাকে,বুঝে নিও যে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।
এই কথার অর্থ মুনা কীভাবে নিলো জানা নেই,তবে সোহেল বুঝে নিলো।
•
বেশিদিন সময় নষ্ট না করে ভিনা ভালো একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি হয়ে গেলো।সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মন হাহাকার করলেও নতুন পরিবেশে সব মানিয়ে নিলো কম সময়ের মধ্যেই। কারো সাথে সেভাবে বন্ধুত্ব না হলেও হুট করে একদিন এক ছেলে চিৎকার করে দিলো 'ভিনা!'
চিনতে অসুবিধা হলো না ভিনার সে কে।এইযে শুরু,এক বছর ধরে এভাবেই চলছে।জানালার গ্রিল ধরে এসব ভাবতে ভাবতেই ফোন আবার বেজে উঠলো।ভিনা অনবরত রিং হওয়া মোবাইলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধোয়া ওঠা কফিতে মন দিলো।আপনমনেই বলে উঠলো 'হায়রে রুশান.....'
.
.
.
চলবে..........................................................