আজকে মাহভিনের টিকা দিতে যেতে হবে।টিকা দেয়ার দিনগুলো ভিনার মেজাজ খারাপের দিন।ইঞ্জেকশন জিনিসটাকে আগে কিছু মনে না হলেও এখন আস্ত একটা ছ্যাঙ্গার মত মনে হয়।সেই কুৎসিত কাটাওয়ালা জিনিস মাহভিনের পুরো এক দিনের কান্নার কারণ হয়।কোনোবার টিকা দিতে না গেলেও এবার ভিনা গেলো।প্রতিবার নিজের মেয়েকে একা ব্যাথার দিকে ঠেলে ফেলা যায় না।
গাড়িতে সামনের সিটে সোহেল বসলো।মুনা,মাহভিন আর ভিনা পেছনের সিটে।মাহভিন গাড়িতে কারো কোলে বসতে চায় না।সে নিজে আলাদা জায়গা নিয়ে বড়দের মত বসবে।ভিনা দুই হাত দিয়ে মাহভিনকে ধরে রাখলো।মুনা প্রাণ খোলা হাসির সাথে মাহভিনের নানা ঘটনা বর্ণনা করে দেখাচ্ছে।মাহভিন সবকিছু না বুঝলেও প্রতিটা কথায় সাড়া দিচ্ছে।রাস্তা ফাঁকা থাকায় খুব জলদিই টিকা কেন্দ্রে পৌঁছে গেলো তারা।গাড়ি থেকে নেমে সাইনবোর্ড দেখতেই মাহভিনের চোখে মুখে আতঙ্ক দেখা গেলো। মুনা কোলে নিতে গেলে হাত সড়িয়ে দিয়ে ও ভিনার কোলে আসলো।
-আমমি যবো না।খামসি দিবে।
ভিনার চোখে পানি চলে আসছে।প্রতিবার মুনা আর সোহেলের সাথে এসে ওর সুইয়ের খোঁচা খেতে হয়,তাই এবার ভিনার কোলে উঠেছে মাহভিন।ওর ধারণা ভিনার কাছে থাকলে ও আর ব্যাথা পাবে না।ভিনা কোনোভাবে চাচ্ছে না ওর বাচ্চার ভুল ধারণা ভাঙুক।নিজেকে নিরপরাধ হিসেবে ধরে রাখার জন্য ভিনা মুনাকে ইশারা দিলো কোলে নেয়ার।নিজের কোলে মাহভিনকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না।মুনা আবার কোলে নিতে গেলে মাহভিন ভিনাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।ভিনা ইশারা দিয়ে মুনাকে থামিয়ে দিলো।
-আমার কোলে থাকবে?
-হা,আমায় কোলা রাকো।
-তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো,তুমি যদি এখন ডক্টরের কাছে যাও।
-উহু,এমমিই নিয়া যাও গুরতে।
নিজের মেয়ের যুক্তিতে অপদস্থ হতে ভিনার ভালোই লাগছে।কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ভিনা ভেতরে গেলো।মাহভিন কোলের মধ্যে ছটফট করছে,কোনোভাবেই সে ভেতরে যাবে না।
-দেখো কী করে,আমার কোলে দাও তো ওকে।
-না মা,থাকুক আমার কাছে।দেখি কী করা যায়।
মাহভিন কান্না জুড়ে দিয়েছে।ভিনা ওকে পুরো হস্পিটাল ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে।আদর করছে,খেলছে।মাহভিনের সিরিয়াল আসতেই ভিনার আত্মা শুকিয়ে গেলো।নিজে জীবনে অনেক ইঞ্জেকশন দিয়েছে,সেলাই যখন করেছিলো,তখন ও এত নার্ভাস হয়নি।মা হওয়া যে কী যন্ত্রণার!না এখন টিকা না দিয়ে যেতে পারবে,না মাহভিনের কান্না দেখতে পারবে।
মুনা ভিনার কাছে এসে মাহভিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো-
-তোমার কোলেই যখন আছে,তুমিই ওকে ভেতরে নিয়ে যাও।আমি পাশে থাকবো।
ভিনা ভেতরে ঢুকে দেখলো,একজন মহিলা ডাক্তার আরেকজন নার্স আছে।নার্সটা মাহভিন কে দেখেই ভ্রু কুচকে ফেললো।
-বাচ্চা সুই দেইখে কান্দে নাকি?
-হ্যাঁ, একটু ভয় পায়।
-হায়রে জ্বালা!দ্যান,আমার কোলে দ্যান।
ভিনার নার্সের আচরণ দেখে মোটেও ভালো লাগলো না।এই নার্সের কোলে মাহভিনকে দিতেও ইচ্ছে হলো না।
-থাক,আমার কোলে থাকুক।নাহলে কান্না করবে।
নার্স মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বললো-
-ঢং কত মাইনষের।
ভিনা শুনেও কিছু বললো না।রাগে আগুন হয়ে যাচ্ছে পুরো শরীর,কিন্তু এই পরিস্থিতেই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করলো।
বিপত্তি বাঁধলো ডাক্তার যখন কাচের শিশি থেকে সিরিঞ্জ রিফিল করা শুরু করলো। মাহভিন বুঝে গেলো যে এখন ওকে ব্যাথা দেয়া হবে।এবার ও কোল থেকে শরীর বাঁকিয়ে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছে।মুনা নানা কথা বলে থামানোর চেষ্টা করে গেলো,লাভ হলো না।ডাক্তার সিরিঞ্জ হাতে বসেই আছে অবস্থা বেগতিক দেখে।নার্স ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে ভিনার হাত সড়িয়ে বাচ্চা কোলে নিতে গেলো-
-এমন করলে সারাদিন লাইগা যাবে।আরো বাচ্চা আসে বাইরে।
-ও এখনি থেমে যাবে,একটু দাঁড়ান।
ভিনা নার্সকে অপেক্ষা করতে বললো।কিন্তু কোনো লাভ হলো না,মাহভিন পাগলের মত কান্না করছে।
ডাক্তার ভিনাকে বসতে বললো,বাচ্চাকে শক্ত করে ধরে।ভিনা দুই হাত দিয়ে মাহভিনের আলতো করে ধরলো।কিন্তু তখনি হুট করে নার্স এসে এক হাত দিয়ে মাহভিনের মাথা চেপে একদিকে সড়িয়ে নিলো,আরেক হাত দিয়ে মাহভিনের হাত চেপে ধরলো।ডাক্তার দেরি না করে টিকা দিয়ে দিলো।পুরো ঘটনা ঘটলো খুব দ্রুত গতিতে।নার্স মুখ বেকিয়ে বললো,
-তুলা চাইপা যান গা।
ভিনা খেয়াল করে দেখলো হাত চেপে ধরায় মাহভিনের ছোট তুলতুলে হাতে আঙুলের ছাপ পরে লাল হয়ে আছে।ভিনা ভাবতেও পারেনি কোনো বাচ্চাকে এভাবে টিকা দেয়া যেতে পারে!ভিনা মাহভিনকে মুনার কোলে দিয়ে নার্সের গালে সপাট করে চড় মেরে বসলো।
-তোর কত্ত বড় সাহস!তুই আমার বাচ্চার গায়ে হাত দিসিস!তোকে আমি জেলে নিবো হারামির বাচ্চা!
সেই নার্স চিৎকার করে অন্য নার্সদের জড়ো করে ফেললো।সব নার্সরা অকথ্য ভাষায় ভিনাকে গালাগালি করা শুরু করলো।ভিনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-
-এই রুমে সিসি টিভি আছে।আমি লিগ্যাল এ্যকশন নিতে পারবো।আমি আপনাদের সবার বিরুদ্ধে এ্যকশন নিবো।জানেন না আমি কী করতে পারি।
এই কথা বলা মাত্রই নার্সদের বেশিরভাগ চুপসে গেলো।সিরিয়ালে বসা অন্য মা বাবা রা এবার কথা বলা শুরু করেছে।তাদের ও একি অভিযোগ,অনেক নার্সরাই নির্দয় আচরণ করে।নানা বাক বিতন্ডা শেষে সেই অভিযুক্ত নার্স ক্ষমা চাইলো।ভিনা আর দেরী না করে সবাইকে নিয়ে চলে গেলো।পুরো রাস্তায় মাহভিন কে আর কোল থেকে নামালো না।কিছুক্ষণ পরপরই ব্যাথা পাওয়া হাতে আলতো করে বুলিয়ে দিচ্ছে।মুনা পুরো ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে গেছে।সে ভাবতেও পারনি ভিনা মাহভিনের বিষয়ে এতখানি সেন্সেটিভ হবে।তার থেকে বড় হলো,'আমার বাচ্চা' কথাটা।মুনা আর বেশি ভাবলো না।যদি মাহভিনকে আদর করেই থাকে ভিনা,ক্ষতি কী?বরং আরো ভালো এটা।তবুও,কেমন যেন লাগছে মুনার।
বাসায় পৌঁছে মাহভিন ঘুমিয়ে গেলো।মুনা রান্না করতে চলে গেলো।তখন সোহেল ভিনার রুমে আসলো।
-আজকে এটা কী করলে ভিনা?
ভিনা মাথা নিচু করে রাখলো।
-তোমাকে না বলেছিলাম,মাহভিন তোমার মেয়ে এটা ভুলে যেতে?বলেছি না ওর সব দায়িত্ব আমার আর মুনার।
-জ্বি বাবা।
-তাহলে তুমি আজকে কেন এমন করলে?
-স্যরি বাবা।
-তুমি যদি এমন করতে থাকো,তাহলে ক্ষতি মাহভিনেরই হবে।মুনা ওকে নিজের সন্তান হিসেবে যতখানি স্নেহ দিচ্ছে,এটা থেকে বাচ্চাটা বঞ্চিত হবে।
-কী করবো বাবা।ঐ বজ্জাত নার্স....
-থামো।মাহভিন তোমার সৎ বোন,বুঝলে?এটা মেনে নিয়ে যদি না থাকতে পারো,আমি তোমাকে আলাদা করতে বাধ্য হবো ভিনা।
ভিনা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।চোখ থেকে অনবরত পানি পরছে।যাবিরের কথা ভীষণ মনে পরছে।অন্যকিছু না,শুধু যাবিরকেই মনে পরছে।
••••••••••••
জেরিন অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।ওর জীবন একদম গোছানো ছিলো।ও নিজেই,সজ্ঞানে,ওর জীবন এলোমেলো করেছে।কোনো প্রয়োজন ছিলো না যাবিরকে নিজের সাথে জড়ানোর।কী হত যদি দুই বছর আগে জিদ না করত,কী হত যদি নিজের মায়ের কান্নার মূল্য দিত?সেদিন ও কারো মূল্য দেয়নি,তাই আজকেও ওকে কেউ মূল্য দিবে না।যে মা ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দিত ভার্সিটিতে ওঠার পর ও,সেই মা আজ আর ওর দিকে তাকায় না,না খেয়ে থাকলেও।
-আপা,ওরে রাখেন।
বাসার নতুন কাজের মেয়ে ওর কোলে বাচ্চা দিয়ে গেলো।এতক্ষণ জেরিন নিজেই রেখেছিলো।পরে ভালো না লাগায় ঐ মেয়েটাকে দিয়েছে রাখার জন্য।
বাচ্চাটার মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে জেরিনের ইচ্ছে হলো ঠিক এই নিষ্পাপ সময়ে ফিরে যেতে।
.
.
.
চলবে..................................................................