অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ১৩ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


রিসিপশানের সামনে রুশানকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে সোহেল অবাক হয়নি।সে প্রথমেই রুশানের অনিচ্ছাকৃত হ্যাঁ বলার ধরণ দেখেই বুঝতে পেরেছিলো রুশান যাবে না।বাইরে গিয়ে দুই প্যাকেট খাবার কিনে এনে রুশানকে ডাক দিতেই রুশান লাফিয়ে উঠলো এবং বেশ লজ্জা পেলো।

-আসলে আঙ্কেল,বাবা গাড়ি পাঠাতে দেরি করছে আরকি।গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে।

-বুঝতে পেরেছি।আসো ক্যাফেটেরিয়ায়,কিছু খেয়ে নেই।

-আপনি এত কষ্ট করে খাবার আনতে গেলেন কেন আঙ্কেল?আমাকে বললেই হতো,অ থবা কিছু অর্ডার করে নিতেন...

-আনকম্ফোরটেবল ফিল করো না।আসো এখন।

রুশানকে নিয়ে সোহেল ক্যাফেটেরিয়ায় চলে এলো।ক্যাফেটেরিয়ায় মোটামুটি মানুষজন আছে।এই সময়টায় স্যুপ আর কফি ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।দুইটা প্লেট নিয়ে সোহেল বসলো রুশানের সাথে।দুইজনেরই ভীষণ ক্ষিদা লেগেছে।রুশান চোখের নিমিষেই খাওয়া শেষ করে ফেললো।সোহেল খাবার শেষ করে দুটো কফি নিয়ে আরাম করে বসেছে।ভিনাকে ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়েছে,আজকে রাত আর উঠার সম্ভাবনা নেই।

-তুমি নিশ্চয়ই কিছু খাওনি আগে?

-তাড়াহুড়ায় খেয়াল ছিলো না।

-ভিনাকে কবে থেকে চিনো?

-প্রায় চার বছর।

-চার বছর!

-চিনি বলতে....একসাথে কোচিং এ পড়তাম।তখন তেমন কথা হতো না।ভিনা সবসময়ই চুপচাপ।এইত কয়মাস হলো,ভার্সিটিতে উঠে কথা হয় আরকি।

-আচ্ছা....তারপর,ফিউচার নিয়ে প্ল্যান কী?

-এখনো ঠিক করিনি।তবে সফল হবোই যাই-ই করি না কেন।

-এত কনফিডেন্স?

-হ্যাঁ, কারণ আমি একবার ট্র‍্যাক পেলে অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারি।এখন শুধু গোল সেট করা বাকি,গোল এচিভ করা ব্যাপার হবে না।

-তোমার বাবার রিয়েল এস্টেটের যে বিজনেস আছে,সেটায় ঢোকার কোনো ইচ্ছা আছে?

-নাহ!সেটা আমার বাবার,আমি কেন ঢুকবো?এত কষ্ট করে পড়াশোনা করাচ্ছে তার ব্যবসার জন্য নাকি?উনি নিজে যত ট্যাক্টফুলি ব্যবসা দেখতে পারছে,আমি পারবো না।তবে আমি উনাকে ফলো করি,আমার বাবা বেশ ঠান্ডা মাথার মানুষ। 

-ইঞ্জিনিয়ারিং করে তো এই সেক্টরেই ঢুকবে, নাকি অন্য পরিকল্পনা আছে?

-সময়ই বলে দিবে।এখন একটা সাব্জেক্ট পড়ছি কারণ পড়াশোনা করতে হবে,চুপচাপ বসে থাকলে কিছুই হবে না।আর এক বছর পর যেটা মনে হবে করা উচিৎ সেটাই করবো।ব্যবসা হলে ব্যবসা করবো,বিসিএস দরকার হলে সেটার জন্য পড়বো।ডিসিশান সারাজীবনের,তাই হুট করেই নিচ্ছি না।

-ওয়াইজ ডিসিশান।ধরো ক্যারিয়ার এর জন্য ট্র‍্যাক পেলে,এরপর কী করবে?

-বিয়ে করবো।বিয়ে আমার তাড়াতাড়িই করার ইচ্ছা।কারণ ক্যারিয়ার করার প্রচুর সময় থাকে,বিয়ে করার সময় বেশি থাকে না।বিয়ে দেরিতে করা মহা ভুল।

-কীভাবে?এস্ট্যাব্লিশ না হলে সংসার কীভাবে করবে?

-ধরেন আপনি আপনার মেয়ের বিয়ে দিলেন,আপনি কি এরপর ভুলে যাবেন যে আপনার মেয়ে ছিলো?মোটেও না।বরং আপনি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে দামী দামী গিফট দিবেন,মেয়ের ইন ল আর হাজবেন্ডের পেছনে প্রচুর খরচ করবেন,ঠিক নাকি বলেন?

-এটা তো কার্টেসি।

-মেয়ের শ্বশুর শ্বাশুড়ি,যাদের অলরেডি বাড়ি গাড়ি আছে,মেয়ের বুড়া হাজবেন্ড,যে কিনা লাখ টাকা বেতনের চাকরি করে,তাদের পেছনে খরচ না করে আপনি নিজের মেয়ের পিছেই না হয় খরচ করলেন।আপনার মেয়ে ইয়াং জামাই ও পেলো,নিজের জন্যও সময় পেলো,তার স্ট্যাবলিশ হওয়ার জার্নিতে সঙ্গও পেলো।একদিন এই জামাই বড় চাকরি করবে,আপনার মেয়ের পাশে দাঁড়াবে।লাভ হবে,আপনার মেয়ে সাংসারিক জীবনে সুন্দর কিছু সময় বেশি পেলো।বিয়ের পরই নাহয় প্রেম করলো।খুব কি ভুল কিছু?

সোহেল মুগ্ধ হয়ে রুশানের কথাগুলো শুনলো।বয়স কম হলেও রুশান মোটেও ভুল কিছু বলেনি।

-মোটেও ভুল না।তোমার মা বাবা কি আগে বিয়ে দিবে তোমাকে?

রুশান হেসে দিলো।

-আমার মা কিছুটা ভেটো দিলেও আমার বাবা একশ বার দিবে।

-কেন?

-কারণ আমার বাবা বেশি বয়সে বিয়ে করে ব্যস্ত সময়ই কাটিয়েছেন বাড়ির বাইরে।এর জন্য আমার মার কাছে উনি অনেক বড় অপরাধী।উনি নিজের ছেলেকে জেনেশুনে এই ভুলের দিকে ঠেলে দিবেন না ফর শিওর।

সোহেল হো হো করে হেসে উঠলো।নিজের পুরোনো দিনের কথা মনে পরে যাচ্ছে।ভিনা হওয়ার পর সোহেল ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো ব্যবসা দাঁড়া করানোর জন্য,সেসময় শিউলিকে আগের মত সময় দিতে পারত না।শিউলির এ নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহেল অনুভব করে তার সময়ের জন্য বহুদিন কেউ অভিমান করে বাসায় অপেক্ষা করেনা।পৃথিবীতে কম সময়ের জন্য অভিমানী হওয়া মানুষ জীবনে একজনই থাকে।তাকে অসময়ে হারিয়ে ফেলা মানে,অসময়ে জীবন থেমে যাওয়ার মত।

-এক্সকিউজ মি আঙ্কেল,ফোন আসছে আমার।আমি একটু আসছি।

সোহেল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো বাইরে যাওয়ার জন্য।রুশান দ্রুত গতিতে বাইরে আসলো।

-হ্যালো মা...

-কোথায় তুমি?রাত সাড়ে বারোটা বাজছে তুমি বাসায় আসোনি।ফোন বন্ধ রেখেছিলে কেন?কী শুরু করেছো এসব?

-কাম ডাউন কাম ডাউন।আমার একটা ফ্রেন্ড হটাৎ এক্সিডেন্ট করেছে।ব্লাড লাগবে ওর।আমি ব্লাড দিয়েই আসছি।ওর আর আমার ব্লাড গ্রুপ সেম।

-কী!তুমি ব্লাড দিবে?কে করতে বলেছে এসব?

-একজন অসুস্থ হয়েছে আমি ব্লাড দিবো না?

-অন্য মানুষ মরে গেছে?ওর ফ্যামিলি মেম্বার রা নাই?বাই দা ওয়ে,ফ্রেন্ড টা কি ছেলে না মেয়ে?

রুশান ঢোক গিললো।কিছুক্ষণ ভেবে বললো

-ছেলে ফ্রেন্ড। 

-কোন হস্পিটালে আছো?এক্ষনি আসবো আমি।বলো তুমি কোন হস্পিটালে আছো।

রুশান কথা বললো না আর।ফোন কেটে দিয়ে ড্রাইভারকে ফোন দিলো।

-সালাম ভাই

-ছোট ভাই কই আপনি?ম্যাম আমারে পাগল বানাইয়ে ফেলতাসে।

-আমি জানি।উনাকে বলো তুমি ভার্সিটির সামনে পার্ক করে রেখেছো গাড়ি।মা কে বলোনি তো কোন হস্পিটাল? 

-না।আপনি মানা করসেন,আমি কই নাই।কইসি আপনি গাড়ি নেনই নাই।

-খুব ভালো করসো!পরেরবার তোমার বউয়ের জন্য শাড়ি কিনে দিবো সুন্দর।এখন একটা কাজ করো।মা তোমাকে ফোন দিতেই থাকবে।তাকে বলবা তুমি জানো না আমি কোথায়।ঠিকাছে?

-ঠিকাসে।

মিসেস জেবা পুরো বাসা মাথায় তুলে রেখেছেন।রুশানের বাবা ফারুক বেশ নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে টিভি দেখছেন,যেন একুশ বছরের একটা ছেলের গভীর রাতে বাইরে থাকা কোনো ব্যাপারই না।জেবার নিজের হাজবেন্ডের দিকে তাকিয়ে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে।তার ছেলে এতখানি অবাধ্য হবে কখনো ভাবেননি।উনি এ বিষয়ের শেষ দেখে থাকবেন।
.
.
.
চলবে...................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp