অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ১৫ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-এত ভেঙ্গে গেছে তোমার শরীর,এগুলা কিছু হলো!

ভিনা ব্যাগ গুলো আলমারিতে রেখে প্রিতিকে প্রশ্ন করলো।প্রিতি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে।চোখ গর্তে চলে গিয়ে,চেহারা শুকিয়ে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে।বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে প্রিতি।

-একাকীত্বের চেয়ে বড় অসুখ নেই ভিনা।মানুষকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দেয়।একসময় শেষ হওয়াটা দেখাও যায়।

-তোমার কোনো বান্ধবীকে এখানে আসতে বলতে?এভাবে একা কেন ছিলে?

-না আসতে বলে ভালো করেছিনা?এইযে তুই এসে পরলি আমার কাছে,নাহলে কীভাবে তোকে রাখতাম বল?

-তুমি মনে হয় জানতে আমি আসবো?

-হ্যাঁ,আমি জানতাম তুই আসবি।

-কীভাবে?

-একা থাকি তো,মাঝে মাঝে ইন্টিউশন খুব একুরেটলি কাজ করে।একা থাকলে মানুষের মধ্যে প্রায়ই সুপার ন্যাচারাল কিছু কাজ করে ,তবে এটা বেশিরভাগের কাম্য না।একাকীত্বের যে যন্ত্রণা এর কাছে এসব কিছুই না।

-একা থাকা নিজের চয়েজ। এসব বুঝলে তুমি একা কেন থাকো ?

-মানুষের ভীড়েও একা থাকা যায়,বিষয়টা কি বুঝিস?তুই চাইলেই বন্ধু বানাতে পারবি,কিন্তু সম্পর্ক না।একজন আপন আর পর মানুষের মাঝে পার্থক্য শুধু সম্পর্কের।এই সম্পর্কই আমি পাই না। 

-কে বলেছে পাও না?তোমার মত এত সুন্দর একটা মানুষের সাথে কে না মিশতে চাবে?

-মিশে অনেকে।একজন তো একদম রক্তে রক্তে মিশে গিয়েছিলো।লাভ কী?দিনশেষে দেখি সবাই খুব রিয়েলিস্টিক।আবেগ নেই কোনো।ইমোশনাল মানুষকে ওরা ইফেক্টিভ প্রোডাক্ট হিসেবে দেখে।

ভিনা প্রিতির কাছে যেয়ে বসে মাথা নিচু করে বললো-

-আমিও তো তাহলে তোমার একাকীত্ব কাটাতে পারবো না আপু।আমিও তো প্রয়োজনেই তোমার খোঁজ নিয়েছি।

-তোর জীবনে অনেক ঝড় গেছে ভিনা,আমি জানি।

ভিনা চমকালো।প্রিতি কি জানে ঝড়ের আয়তন কত বড় ছিলো?

•••••••••••••••

প্রিতির কাছে থাকার ব্যবস্থা করা ভিনার জন্য মোটেও সহজ ছিলো না।সোহেল কোনোভাবেই রাজি হয়নি প্রথমে।পরে বাধ্য হয়ে আগের সবকিছুই বলা লেগেছে ভিনার।সবকিছু শোনার পর সোহেলের কিছু প্রশ্ন ছিলো।কিন্তু যে অতীত থেকে মেয়েকে বের করে আনতে চাচ্ছেন,সে অতীতে টেনে নিয়ে যাওয়া একদমই অনুচিত মনে হলো।আরেকটা বিষয়, ভিনা এখন বড় হয়ে গেছে,ভালো খারাপ বয়সের তুলনায় বেশি বুঝে কারণ বয়স আন্দাজে পৃথিবী বেশিই দেখে ফেলেছে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও সোহেলের রাজি হতে হলো।মেয়ের সাথে এরকম চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক ও একদিন হবে,আশা ছিলো না।

কোনো এক শুক্রবারে ভিনা চলে আসে প্রিতির কাছে।সোহেল যখন রেখে চলে আসে,তখন খুব খারাপ লাগতে থাকে।নিজের মেয়ের ভালোর জন্যই যদিও,তবু একি শহরে দূরে দূরে থাকতে হচ্ছে,পুরো ব্যাপারটা কষ্টকর।আজকে ভিনার মা বেঁচে নেই,তাই মা বাবা দুইজনের দায়িত্বই সোহেল একা পালন করছে।প্রতি সপ্তাহে একবার অবশ্যই আসবে,এছাড়াও সোহেল জানে,ভিনা ভার্সিটি থেকে মাহভিনকে দেখার জন্য এমনিই আসবে।হুট করে ভিনাকে হোস্টেলের পাঠানোর সিদ্ধান্ত কতখানি ফলপ্রসূ হবে সেটা সময়ই বলে দিবে। 

কিন্তু মুনা ভিনাকে এভাবে পাঠানোর একদম বিরুদ্ধে ছিলো। বাসায় ফিরে আসার পর মুনা সোহেলকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিলো।

-সত্যি করে বলো,কেন ভিনাকে ওখানে পাঠালে?

-ভিনার পড়াশোনার জন্য।দেখো না সারাদিন মাহভিনকে নিয়ে থাকে?

-এটা কোনো কারণ হলো?

-ভার্সিটি থেকে যাতায়াতেও তো সমস্যা হয়।

-তাতে কী?গাড়ি থাকতে এসব কোনো ব্যাপার?দরকার হলে আমি ইউজ করবো না গাড়ি,সারাদিন ভিনার কাছে থাকবে।

-বিষয়টা এমন ও না।

-তাহলে সমস্যা কোথায় আমাকে বলো।তুমি কেন মেয়েটাকে এভাবে পাঠালে? 

-থাকুক,সমস্যা কী?

-সোহেল....তুমি কি এই ভেবে পাঠিয়েছো যে আমি ভিনার ক্ষতি করবো?আগের মত?

-কীসব বাজে কথা বলছো মুনা!

-প্লিজ, আমার থেকে লুকিয়ো না।আমি জানি আমি অনেক বড় অন্যায় করেছিলাম,আমাকে সহজে বিশ্বাস করা যাবে না,উচিৎ ও না।আমি কষ্ট পাবো না সত্যি বললে...

-এমন কিছুই না।দেখো,ভিনার অনেক কঠিন সময় গিয়েছিলো বছর খানেক আগে।ওর একটু স্পেস দরকার।

-আমি তো কোনো সমস্যা করিনি।আমি পুরোনো কোনো কথাও টানি নি।তাহলে?

-মাহভিন অনেক বিরক্ত করে ভিনাকে।মাহভিন বড় হোক,এরপরে নিয়ে আসবো।

-এতটুকু বাচ্চা এমন কীই বা করছে?তুমি এমন করছো কেন?

-আমি অনেক ক্লান্ত মুনা।তুমি টেবিলে খাবার দিতে বলো,আমি খেয়ে ঘুমাবো।

-আমার শেষ একটা কথা শুনে যাও।

-বলো....

-ভিনা যে পরীক্ষার আগে প্রায় তিন মাস বাসায় ছিলো না,ও কোথায় ছিলো?

-পরিচিত এক মেয়ের কাছে ছিলো।কেন?

মুনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে সোহেলকে প্রশ্ন করলো-

-আমার স্পষ্ট মনে আছে,ভিনা আমাকে নিজের হাতে মাহভিনকে কে তুলে দিয়েছিলো।মাহভিনকে কোথায় পেয়েছিলে সোহেল?

••••••••••••••

প্রায় দুই সপ্তাহ পরে ভার্সিটি তে এসে ভিনার মনে হলো নতুন কোনো জায়গায় এসে পরেছে।এই দুই সপ্তাহে কুইজ,মিডটার্ম অনেক কিছুই বাদ গেছে।নিজের মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে ফ্যাকাল্টির কাছে যেয়ে রিকোয়েস্ট করতে হবে।এই মেডিকেল রিপোর্ট বানাতে জীবন শেষ হয়ে গেছে।সত্যিকারের মেডিকেল হিস্টোরি দেয়া অসম্ভব।রাত জেগে ল্যাপটপে বসে এসব জোড়াতালির কাজ করতে ভিনার একটু ও ইচ্ছে হচ্ছিলো না,তবুও করতে হয়েছে।এমনকি ডাক্তার সোমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে এসব ব্যাপারে।যদিও ভার্সিটি থেকে এত দূর যাবে না,কিন্তু রিস্ক নেয় কে?

দুইজন ফ্যাকাল্টির সাথে কথা বলে আরেক ফ্যাকাল্টির কাছে যাওয়ার সময় রুশানের সাথে দেখা হলো।রুশান ভিনার হাতে এক কাপ কফি দিয়ে বসতে বললো। 

-একটু থামো ভাই।দুইজন ফ্যাকাল্টির কাছে ঘুরে আসছো।আরেকজন পালায় যাবে না।একটু রেস্ট নাও,হস্পিটাল থেকে আসছো বেশিদিন হয় নাই।

-তোকে কেউ টাকা দেয় আমার পিছে লেগে থাকার জন্য?ঘুরঘুর কেন করছিস আমার পিছে?

-টাকার জন্য আমি তোমার খোঁজ নিবো?এটা তুমি ভাবতে পারলা? 

-তাইতো...তুই তো বিরাট বড়লোকের ছেলে।তোর আবার টাকা লাগবে কেন?আচ্ছা...তোকে কি কেউ কন্ট্র‍্যাক্ট দিয়েছে আমাকে মারার জন্য?হু?

-কে দিবে কন্ট্র‍্যাক্ট!কী সব বলো তুমি?কে মারবে তোমাকে?

-আমার... 

-তোমার?

-মাথা...এবার বল কী হয়েছে?কী লাগবে তোর?

-কিছু না।আচ্ছা একটা কথা বলোতো।

-বল..

-ঐযে একটা মেয়ে সেদিন ছিলো না তোমার সাথে?তোমার কেমন বান্ধবী?

-ফারজানা?কেম হটাৎ এ প্রশ্ন?

-আমার এই মেয়েকে সুবিধার মনে হয় না।

-রিজন?

-সেদিন তোমার অবস্থা এত খারাপ ছিলো।ঐ মেয়ে হেল্পের জন্য আগায় আসে নাই।ইভেন তোমাকে যখন গাড়িতে উঠাচ্ছিলাম,তখনও না।একজন মহিলা গার্ডের হেল্প নিয়ে তোমাকে উঠিয়েছি,অথচ এই মেয়ে ওখানেই দাঁড়ানো ছিলো।

ভিনা চুপ করে থাকলো।সত্যি বলতে ফারজানা এই দুই সপ্তাহে একবারের জন্য ও ভিনার খোঁজ নেয়নি।অথচ রুশানের সাথে সেদিন ক্যাফেটেরিয়ায় দেখে অবেলায় ফোন দিয়ে কত জেরা করেছে!ভিনার খারাপ লেগেছে,তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে।

-এতকিছু জানি না আমি।অনেক কাজ বাকী আমার। মেক আপ টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে।আমি আসি আজকে।

-শোনো,ফ্রি আছো বিকালে?

-কেন?

-একটু হাঁটতে যেতাম আরকি।

ভিনা কোনো উত্তর না দিয়ে চলে এলো।মাথায় অনেক কিছু ঘুরছে এখন।এসব ভাবার সময় নেই।

দৌড়াদৌড়ি শেষ করে যখন ভিনা ক্লাসে আসলো,দেখলো ফারজানা বসে আছে ফার্স্ট রো এর শেষ মাথায়।ওখানে ভিনার জন্য কোনো সিট রাখা নেই।ভিনা অবশ্য আশাও করেনি,এরকমই কিছু হবে ভেবে রেখেছিলো।লেকচারার আসতে দেরি হলেও ফারজানা কোনো কথা জিজ্ঞেস করলো না।কিন্তু রিদওয়ান,সেজান এবং ক্লাসের অন্য দুইটা নেয়ে অরিন আর মিহিকা খোঁজ নিলো ঠিকি।বিশেষ করে মিহিকা যে খোঁজ নিবে ভিনা আশা করেনি কারণ সে কখনোই ভিনার সাথে আগে কথা বলেনি এবং তার ফ্রেন্ড সার্কেল পুরোই অন্যরকম।সবার সাথে কথাটথা শেষ করে ক্লাস করে ভিনা বের হলো।ফারজানার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো।এটা জানা খুবই জরুরি যে কেন এমন করছে ও।ফারজানা যখন বের হলো,ভিনা তখনই সামনে এসে দাঁড়ালো-

-কী খবর তোর?

ফারজানা কোনোরকম বাড়তি কথা না বলে উত্তর দিলো' ভালো'।

-কিছু হয়েছে?

-না

-তাহলে?এতদিন কোথায় ছিলি?

-যেখানে থাকার সেখানেই ছিলাম।

-কোনো ফোন দিলি না যে?

-তোর ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করতে চাইনি।

-ইন্টারফেয়ার?খুলে বল তো কী হয়েছে।

-কিছুই হয় নাই।

-তাহলে?এমন অদ্ভুত আচরণ করছিস কেন যে চিনিস ই না।

-আমার চেনা না চেনা দিয়ে কী হবে?তোর তো কেয়ার করার মানুষের অভাব নাই।

ভিনা ভ্রু কুচকে বোঝার চেষ্টা করলো এ কথার অর্থ কী হতে পারে।

-অভাব থাকলেও কী না থাকলেও কী?তুই তো আমার ফ্রেন্ড ছিলি নাকি?খোঁজ তো নিতেই পারতি।

-নিবো কীভাবে?রুশান যেভাবে তোকে আগলে রাখে আমি কি পারবো তোর ধার ঘেষতে?

-এমন প্যাঁচায়ে কথা বলিস কেন?ডেইলি সোপে অভিনয় শুরু করেছিস?

ফারজানার কথা না বলে চলে গেলো।ভিনার ফারজানার এমন আচরণে মেজাজ ভয়াবহ খারাপ হয়েছে।কথা খুলে তো বলবে নাকি।

ফারজানা চলে যাওয়ার পরই রুশান পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

-বলেছিলাম না,মেয়ের মধ্যে ঘাপলা আছে?

-ঘাপলা তো তোর মধ্যেও কম নাই।একজন হুদাই রাগ দেখায়,একজন হুদাই পিরিত দেখায়।

-আমি *হুদাই* এসব করিনা।

-তো কিসের জন্য করিস?

-হাঁটতে যাবা?তখন বলি?
.
.
.
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp