মেঘলা এই দিনে ভার্সিটিতে ধরতে গেলে কেউই আসেনি।রাস্তাঘাটের অবস্থা শোচনীয় হওয়ায় কতগুলো ফ্যাকাল্টি ক্লাস অফ করেছে আজকে।কিন্তু ভিনার ক্লাসের স্যার কোনো মেইল দেননি।ভিনা চায়ও নি ঘরে থাকতে,মেইল আসলেও ভার্সিটি আসত।গত রাতে সোহেল এসে বলে গেছে মাহভিনের সাথে কম মিশতে।ভিনার বুক ভেঙ্গে গেছে কথাটা শুনে।এখানে সোহেলের বিন্দুমাত্র দোষ নেই যদিও।মাহভিনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেললে ভিনার জীবন যে আর আগাবে না,সেটা সোহেল ভালোমত বুঝে।সে চায় তার মেয়ে এই পিছুটান থেকে মুক্তি পাক।নিজের জীবন গুছিয়ে আবার ভালোবাসা মানুষ পাক,যার সাথে ঘর সংসার হবে একদিন।ভিনাও সোহেলের এই বিষয়টা ভালোমত জানে,তাই কোনো ক্ষোভ কাজ করে না।শুধু একটা কথাই মাথায় আসে,আজকে যাবির ওর পাশে থাকলে মাহভিনকে নিজের পরিচয়ে বড় করতে পারত।মানুষ এত নিখুঁত অভিনয় কীভাবে করে?করে লাভই বা কী হয়?দুই বছর একজনের সাথে থেকে তার প্রতি ভালোবাসা না হোক,মায়া তো জন্মানোরই কথা। ভিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার উপর পরা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গোণার চেষ্টা করছে। মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে,শরীর ও তেমন ভালো নেই।
ক্লাসে ভিনা আর রিদওয়ান ছাড়া কেউ নেই।রিদওয়ান বই এর মধ্যে ডুবে আছে।ভিনা এতে কম্ফোর্টেবল ফিল করছে,কারণ কারো সাথেই কথা বলার ইচ্ছা নেই।ঘড়ির কাটা বলছে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে,তাই ক্লাস হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ভিনা বিরতিহীনভাবে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে।হটাৎ কে যেন ওর কাঁধে হাত রাখলো,পিছে ফিরে দেখলো ফারজানা।
-তোর মুখ এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন?শরীর খারাপ?
ফারজানার এমন নমনীয় আচরণ দেখে ভিনা অবাক হলো।ধারণামতে সেদিনের পর ফারজানার আর ফিরে তাকানোরই কথা না।ভিনা বেশি ভাবলো না।নিজ থেকে ফারজানা ওর কাছে আসলে স্বাভাবিকভাবেই তা নেয়া ভালো।
-হ্যাঁ,পিরিয়ড চলছে।কিন্তু প্রচন্ড পেট ব্যথা।আগে কখনো এমন হয়নি।
আসলেও গত দুইদিন ধরে ভিনার শরীর ঠিক যাচ্ছে না। মাহভিনের টিকা দেয়ার দিন থেকেই এই অবস্থা।সেদিন খুব লম্বা সময় মাহভিন ওর কোলে ছিলো,আর ভীড় থেকে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে ওর তলপেটেও ভীষণ টান লেগেছিলো।এরপর শুরু হলো পিরিয়ডের অসহ্য ব্যাথা।আগে এরকম কখনো হয়নি।মন ভীষণ খারাপ ছিলো দেখে ব্যাথা থাকা সত্ত্বেও আমলে নেয়নি ভিনা।মেডিসিন বক্স খুঁজে একটা পেইনকিলার খেয়ে এসেছে।ব্যাথা সকালের দিকে কম থাকলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে।ভিনা জানালা থেকে চোখ সড়িয়ে মাথা নিচু করে হেড ডাউন করে রাখলো।এ অবস্থাতেই ফারজানা কথা চালিয়ে যাচ্ছে।
-সেদিন আসলে আমি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম।রুশান আর তোকে নিয়ে এভাবে কমেন্ট করা আমার উচিৎ হয়নি।
ভিনা উত্তর দিলো না,ব্যাথা বাড়ছে।ফারজানা দমে গেলো না।
-তুই এমন না আমি ভালোমত জানি।রুশানের মত এরকম ছ্যাচড়া ছেলে তোর মোটেও ভালো লাগার কথা না।কিন্তু তোর দোষ ও আছে।তুই কিছু খুলে বলিস না,নাহলে...
-ফারজানা একটু থাম।আমার ভালো লাগছে না,একটু মাথা নিচু করে থাকতে দে।
-তুই কি এখনো রাগ?
-ফারজানা প্লিজ....চুপ থাক।
ফারজানা বুঝতে পারছে না কী করবে।আসলেই কি শরীর খারাপ নাকি ভিনা রেগে আছে?তবে যাই হোক,রুশানের সাথে যে ওর সম্পর্ক নেই,এতেই ও খুশি,এরপর কে কী করলো,এত মাথা ঘামিয়ে লাভ কী।
ক্লাসের সময় শেষ।রিদওয়ান এভাবে ভিনাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো।ফারজানাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে।ফারজানা গলার স্বর নামিয়ে বললো,মেয়েলি ব্যাপার। রিদওয়ান আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ালো।মেয়েলি ব্যাপার বলাতে একটু অস্বস্তি কাজ করছে যদিও।এরপর ফারজানাকে বললো দুই নাম্বার বিল্ডিং এর দোতলায় মেডিকেল হেল্পের জন্য নিয়ে যেতে,ফারজানা মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝালো ও নিয়ে যাবে।রিদওয়ান আস্তে ধীরে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলো।
-এই ভিনা।ক্লাস কিন্তু শেষ।
ভিনা মাথা উঁচু করলো।ব্যাথায় গায়ে জ্বর এসে পরেছে,চোখ লাল হয়ে আছে।ভিনা তলপেটে হাত দিয়ে আছে।একদম ঠিকভাবে বলতে গেলে,সিজারের সেলাইয়ের জায়গায় হাত দিয়ে রেখেছে,এখানেই মূলত ব্যথা করছে।
ভিনাকে এভাবে দেখে ফারজানা বেশ ভয় পেলো।
-ভিনা?তুই হাঁটতে পারবি তো?
-পারবো।তোর হাত দে একটু।
ফারজানা ভিনাকে ধরে ক্লাস থেকে বের হলো।অবিরাম বৃষ্টির কারণে শহর থমকে গেছে যেন।লবিতে ভার্সিটির স্টাফ আর হাতে গোণা তিন চারজন ছাড়া কেউ নেই।
-একটু দাঁড়া। আমি হাঁটতে পারছিনা।
ভিনা দাঁড়িয়ে গেলো।শরীর ভেঙে আসছে অসহ্য ব্যাথায়।
••••••••••••
এই খারাপ আবহাওয়াও রুশান ভার্সিটিতে এসেছে। যদিও ওর মেইল এসেছিলো ক্লাস হবে না।কিন্তু কেন যেন মন বলছিলো ভিনা আসবে।আর ফাঁকা ভার্সিটিতে দুই কাপ গরম কফি নিয়ে ভিনার সাথে বন্ধুত্বের এই সম্পর্ককে আরো সুন্দর করার সুযোগ রুশান হাতছাড়া করতে চায়নি।লবিতে এক কোণায় ও ভিনার জন্য অপেক্ষা করছিলো।একটা নিউজপেপার নিয়ে আগাগোড়া মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলো। হটাৎ ভিনার দিকে চোখ পরলো এবং সাথে সাথেই খটকা লাগলো।আজকে এমন লাগছে কেন ভিনাকে?যদিও ওর সাথে আরেকটা মেয়ে দাঁড়ানো,কিন্তু রুশান সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না।
-ভিনা?কী হয়েছে?
ফারজানার মেরুদন্ডে শীতল প্রবাহ বয়ে গেলো।এত কাছ থেকে আগে কখনোই রুশানকে দেখা হয়নি। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে যে দেখবে,সেটাও আশা করেনি।ফারজানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো,মেয়েলি সমস্যা।
-পিরিয়ড?
রুশান কোনো সংকোচ ছাড়া প্রশ্ন করলো।
ফারজানা ভীষণ অস্বস্তিতে পরেছে,তাই মাথা নেড়ে সায় জানালো।
-কী হয়েছে ভিনা?ক্র্যাম্পস এর বেশি ব্যাথা?
ভিনার গলা শুকিয়ে আসছে,হাঁটুতে কোনো শক্তি পাচ্ছে না,একদম আকস্মিক ও মাটিতে বসে পরলো।ও বুঝতে পারছে সমস্যা শুধু পিরিয়ডের না,সমস্যা আরো বড়।
রুশান ফারজানার হাত ছাড়িয়ে নিজে ভিনাকে ধরে বসেছে।এরকম পরিস্থিতিতে ওকে দেখে রুশান ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।হার্টবিট বেড়ে যেন বুকে হাতুড়ি চালাচ্ছে।
-ভিনা?প্লিজ বলো কী হয়েছে?তোমার কী লো প্রেশারের সমস্যা আছে?
ভিনা কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না।রুশান যে নিজের বাহুডোরে ওকে ধরে রেখেছে,সে বিষয় ও খেয়াল নেই।ওর মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরছে।যেকোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে না,কারণ সেক্ষেত্রে ওকে সিজারের হিস্টোরি বলতে হবে,যেটা ভিনা কোনোভাবেই চায় না।তাই যেতে হলে ডাক্তার সোমার কাছেই যেতে হবে।ভিনা রুশানকে বললো ওর ব্যাগ দিতে,ফোন করা লাগবে।রুশান নিজের ফোনই হাতে দিলো,ভিনা সময় নষ্ট না করে সোহেলকে ফোন দিলো,কারণ চেক আপের জন্য সোহেল দুইবার নিয়ে গিয়েছিলো ডাক্তার সোমার কাছে।
দূর্ভাগ্যবশত ফোন ধরলো মুনা।ফোনে জানালো টিকার কারণে মাহভিনের শরীরে অনেক জ্বর এসেছে,তাই ডাক্তার দেখাতে সোহেল গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে,ভুলে ফোন রেখে গেছে।
ভিনা দিশেহারা হয়ে গেছে।মানুষের বিপদ যে এত পরিকল্পনামাফিক আসতে পারে,ভিনা ধারণাও করেনি।
রুশানের চোখে মুখে আতঙ্ক বাড়ছেই। ও চুপচাপ বসে আছে,মাথা কাজ করছে না।ফারজানা পাশে শূন্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ভার্সিটির দুইজন স্টাফ এসে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে।রুশান একটা অজুহাত দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দিয়েছে।ভিনা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করছে কী করা যায়,বেশি দেরি করলে ওর শরীর যে আরো খারাপ হবে,সেটা হারে হারে টের পাচ্ছে।ভিনা প্রথমে বুঝতে পারলো,ওর কাছে গাড়ি নেই,সোহেল সেই গাড়িতে মাহভিনকে নিয়ে বের হয়েছে।এরপর মনে করলো সেই হস্পিটাল,যেখানে চেক আপের জন্য ভিনা গিয়েছিলো।
ভিনা রুশানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যাগ ঘেটে ফোন বের করলো।ফোনে সোহেলের মিসকল,নিশ্চয়ই গাড়ি নেয়ার আগে জানানোর জন্য ফোন দিয়েছিলো।এরপর অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে উবার কল করলো।যেভাবেই হোক,ওর একাই যেতে হবে।রুশানকে সাথে নেয়া যাবে না।
রুশান ভিনার হাত থেকে ফোন টান দিয়ে নিয়ে নিলো।
-করছো টা কী তুমি?
-আমাকে ফোন দাও রুশান।প্লিজ।
-কোথায় যাবা তুমি?
-কাজ আছে।
-কোনো কাজ নেই।তুমি এক্ষনি আমার সাথে হস্পিটাল যাবা।
ভিনার পুরো শরীর কাটা দিয়ে উঠলো।কোনোভাবেই ওকে নিতে চাচ্ছে না ভিনা।এদিকে ব্যাথা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে।
রুশান দেরী না করে নিজের গাড়ি আনালো।ভিনা হাঁটতে না পারায় ওকে কোলে তুলে নিলো।ভিনা নিস্তেজ হয়ে গেছে ব্যাথায়,রুশান টের পাচ্ছে ভিনার শরীরে ভীষণ জ্বর।এ অবস্থায় ভিনা ভাঙ্গা গলায় আস্তে করে বললো-
-সেন্ট্রাল হস্পিটাল রুশান,আমাকে সেন্ট্রালে নিয়ে যাও।
রুশান কোনো দেরি না করে একজন মহিলা গার্ডের সাহায্য নিয়ে ভিনাকে গাড়িতে উঠালো।নিজে গাড়িতে ওঠার আগে একবার ফারজানার দিকে তাকালো,এমন ক্রিটিকাল অবস্থায় ও কেন নিজের বন্ধুর সাহায্যে সামান্য এগিয়ে আসলো না,সেটা নিয়ে বিস্ময় কাজ করছে।
.
.
.
চলবে.................................................................