অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ১৯ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-You are looking gorgeous! 

রুশান মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভিনার দিকে তাকিয়ে আছে।ভিনা আজকে ইন্ডিয়ান রেড কালারের ফ্লেক্সনের তৈরি ফুল ফ্রেমের চশমা পরে এসেছে।

-শকুনের মত তাকিয়ে থাকবি না,অন্যদিকে দেখ। 

রুশান আজকে তুই তোকারি শুনেও কিছু মনে করলো না,বরং শব্দ করে হেসে ফেললো।কারণ ভিনা কথা দিয়েছে, রুশানকে ওর বন্ধুর জায়গা দিবে।রুশান যে প্রতিদিন ভিনার বিরক্তিহীন দৃষ্টি ব্যতিত বন্ধুর মত কিছু সময় কাটাতে পারবে,এটা নিয়েই ও সন্তুষ্ট।রুশান প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো এই ভেবে যে,যাবিরের কথা তোলায় ভিনা কষ্ট পেয়েছে,এবং সে কখনোই আর রুশানের সাথে মিশবে না।তাই বাসায় গিয়েই রুশান অনবরত ফোন দিচ্ছিলো ভিনাকে। এক পর্যায়ে ভিনার ফোন বন্ধ পেয়ে ওর ভয় আরো জেঁকে বসে। অস্থির হয়ে শেষে দুইদিন পর প্রিতির বাসার নিচে আসে।ইন্টারকমে ফোন দেয় প্রিতির বাসায়।রিসিপশনে ফ্ল্যাট নাম্বার না বলতে পারায় বর্ণনা দেয় ভিনার।

-আচ্ছা!বুজছি বুজছি,ঐযে মাজনু ভাইয়ের ফ্ল্যাটে যে তার ভাগ্নির লগে থাকে যে!

-জ্বি।

-ঐযে মাইয়া একলা থাকে,একটু পাগল পাগল?

রুশান বিস্মিত হলো এমন আজব বর্ণনায়।তবুও সায় দিলো।সেই লোক ইন্টারকমে ফোন দিয়ে রুশানের কাছে দিলো।কেউ খুব শান্ত এবং ধীর গলায় বললো,রুশান বলছো?বলো ভাইয়া।

রুশান বলার ভঙ্গিতে খুবই অবাক হলো,যেন কেউ খুব চেনা কারো সাথে কথা বলছে মেয়েটা।অথচ নিচের এই লোক কীসব ফালতু কথা বললো।

-না মানে আপু,ভিনার কিছু নোটস ছিলো আমার কাছে,দিতাম ওকে।কিন্তু মনে হয় নষ্ট নাকি কি জানি,ফোন বন্ধ বলছে।

-আসলেই কি নোটস দিতে এসেছিলে?

-জ্বি আপু মানে...

-ভিনার মন ভালো নেই রুশান,ও ফোন বন্ধ রেখেছে।আপাতত তুমি ওর আরেকটা নাম্বার নাও,এটায় আগামীকাল বিকেলে ফোন দিও।ঠিকাছে?

-ঠিকাছে আপু।

ভিনার মন খারাপ শুনে রুশান মুষরে পরেছিলো,নিজেকেই নিজে চড় মারতে ইচ্ছে হচ্ছিলো,কেন বলতে গেলো যাবিরের কথা? কেন বোঝাতে গেলো যাবির থাকা বা না থাকার সাথে এই অনুভূতির কোনো সম্পর্ক নেই?কেন?কিন্তু পরেরদিন একটা ফোন কলে সবকিছু বদলে যায়।

রুশানের সাথে কথা হওয়ার পর ভিনা বাসায় এসে অনেক ভেঙে পরেছিলো,যাবিরের কথা মনে করে অসহ্য যন্ত্রণায় দুইদিন ছটফট করেছে।প্রিতি ভিনার নির্ঘুম ছটফটানি দেখে এক মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে কফি বানিয়ে বসেছিলো মুখোমুখি। 

-কী হয়েছে ভিনা?এমন করছিস কেন?

-খুব যন্ত্রণা হয় আপু,তুমি তো বুঝোই,তাইনা?

-ব্রেক আপ অনেক স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ভিনা।সময়ের সাথে মানুষ বদলাবে এটা প্রতিদিন সূর্য ওঠার মতই সত্য।কিন্তু বদলানোর ধরণ কেমন হবে,আমরা কেউই জানি না।তাই যদি কেউ বদলে যায়,এবং তোমার মনে কষ্ট দিয়েই বদলায়,এটা নিয়ে এত ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই।

-বদলানো সময়ের দাবী হতে পারে,কিন্তু কীভাবে কেউ নিজেকে বদলাবে,এটা কিন্তু পার্সোনাল চয়েজ।কষ্ট তখনি হয় যখন কেউ কাছের মানুষকে দূরে ফেলে দিয়ে এই পরিবর্তনকে মেনে নেয়।

প্রিতি চুপ করে রইলো।কাছের মানুষকে জীবিত অবস্থায় হারানোর চেয়ে বড় কষ্ট হয়না।কেউ মারা গেলে তাও শোকের মাতম করা যায়,সৃষ্টিকর্তার উপর অভিমান করা যায়।কিন্তু একি আকাশের নিচে,একি পৃথিবীতে থেকে কেউ ছিন্ন হয়ে গেলে এর মাতম করা যায় না,অভিমান করা যায় না সৃষ্টিকর্তার উপর।তখন নিজের উপর বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়।এই মেয়েটা কীভাবে সহ্য করবে এসব?বয়সই বা কত?

-কিছু বলো আপু,নীরবতা আমার খুব ভয় লাগে।

-দেখ ভিনা,কত মানুষের কত খারাপভাবে ব্রেক আপ হয় জানিস?সেক্স হয় হয়েএ্যবোরশন হয়ে,প্রতারণা করে,আরো কত কী!তবুও তো তারা বেঁচে থাকে,শুধু তাইনা,এগিয়েও যায়।

ভিনার চোখ টলমল করছে।বেশ কষ্টে কান্না চেপে ভরাট গলায় বললো-

-এগিয়ে যেতেই হয় আপু.....থেমে থাকা যায় না।

প্রিতির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো ভিনার কথার ধরন দেখে। ভিনাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে প্রিতি ভিনাকে খুব ধীরে জিজ্ঞেস করলো-

-লক্ষ্মী,যাবির কি...

-হ্যাঁ আপু,এ্যবোরশন ছাড়া বাকী সবগুলো সত্যি!

-So,you had a miscarriage?

-No...

প্রিতি বুঝে গেলো সব।এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ও কোনো স্বপ্ন দেখছে।ভিনা ডুকরে কান্না করছে।কান্নার মাঝেই ও প্রিতি কে সব খুলে বলছে।প্রিতি কোনো ইন্টারেপশন ছাড়া সব কথা শুনে গেলো।একসময় প্রিতির মনে হলো ওর পুরো পৃথিবী মিথ্যা। নিজেকে ও পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী আর অভাগী মনে করত।আজকে ভিনার সব শুনে ওর সামনে নিজেরি তৈরি কাল্পনিক কষ্টের দেয়াল ভেঙে গুড়ো হয়ে গেলো।ভিনা যে এতসবের মাঝে বেঁচে আছে,এটাই অবাক লাগছে।ভিনার সামনে নিজেকে ছোট লাগছে প্রিতির।এতটুক মেয়ে কতকিছুর মাঝে গেছে,কিন্তু ভেঙে পরেনি,থেমে থাকেনি।আর সে কিনা নিজের তৈরি দুঃখবিলাসের প্রাসাদে মিথ্যে যন্ত্রণার মধ্যে মাতম করে গেছে!ছি!

কফি ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় প্রিতি সেটা রান্নাঘরে রেখে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো।ভিনা এক নিঃশ্বাসে পানি খেয়ে একদম শান্ত হয়ে বসলো।ঠিক যেন ঝড় যাওয়ার পর মধ্যরাতের রাস্তা।

-তোর হাত দুইটা দে।

ভিনা হাত দুটো প্রিতি নিজের কোলে নিয়ে বসলো-

-তুই যে একটা রত্ন,তা কি জানিস?

ভিনা মাথা নিচু করে রইলো।

-তুই জীবনে অনেক ভালোবাসা পাবি।কিন্তু মনের জানালা খুলতে হবে,কেমন?নিজের প্রতি মার্সি দেখাতে হবে,এতটা শক্ত হলে চলবে না লক্ষ্মী আমার।

-আমার মনের ঘর বলতে কিছুই নেই আপু,জানালা খুলবো কীভাবে বলো?

-এত যুক্তি ভালো লাগে না ভিনা।মাহভিন হওয়ার সময়ে কি যুক্তি দিয়ে ভেবেছিলি?ভাবিস নি,তাহলে।

-আমি জানি না কিছু!খুব অগোছালো মনে হয় সব।

-রুশানের ব্যাপারটা কী বল তো।

ভিনা ভ্রু কুচকে একরাশ বিরক্তি এনে ফেললো মুখে।

-আমার বিরক্ত লাগে ওকে।

-কেন?ও তোর কেয়ার করে তাই?

-কে বলেছে তোমাকে?

-আমি বুঝি ভিনা।রুশান এসেছিলো আজকে।তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।তুই কথা বলিস না কেন?

ভিনা শুরু থেকে রুশানের ব্যাপারে সব বললো।

-সমস্যা কোথায়? 

-তুমি এখনো এই প্রশ্ন করছো?ও আমাকে বন্ধু ভাবে না।

-না ভাবলেও কী?এক তরফা কিছু হবে?

-আমার এক ক্লাসমেট ছিলো,আরশি নাম।ও আমাকে কী বলেছে জানো?মেয়দের জীবন প্রেম,বিয়ে,প্রতারণা,বাচ্চা এই ছকেই আটকে থাকে।আমাকে ও বলেছিলো,আমি যেন এই ছক থেকে বের হয়ে আসি।

-তুই তো উল্টা করছিস,তুই ছকের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিস।

-মানে?

-মাহভিনের চিন্তায় ডুবে যাচ্ছিস,রুশানের ব্যপারটা খুব বেশি সিরিয়াসলি নিচ্ছিস।এমন কিছুই কিন্তু না।

-মাহভিনের কথা বাদ দিতেই হবে আপু,আমি বাবাকে কথা দিয়েছি।

-আমাকেও কথা দিতে হবে।আর শোন,রুশানের সাথে এমন করলে রুশান কিন্তু আরো বেশি তোর প্রতি ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যাবে।আরো বেশি আগ্রহ দেখাবে।তখন ভার্সিটিতে পুরো ব্যাপারটা অন্যভাবে দেখবে সবাই।এর জন্য বলছি,নরমালি বিহেভ কর।ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক রাখ।ছেলে ক্লাসমেট কি বন্ধু হতে পারে না?অবশ্যই পারে।তুই ই বেশি ডিপলি ভাবছিস।

-কিন্তু....

-কোনো কিন্তু না।রুশানকে এভাবে তুই বুঝাতে পারবি না।ওর কাছে তুই এক মিস্টিরিয়াস লেইডি।এর জন্যই ও এত বেশি এ্যট্রাক্ট হচ্ছে।রহস্যের চাদর থেকে নিজেকে বের করে আন।সাবলিল হ,বন্ধু হ।এরপর ওকে বুঝা।দেখবি তখন ঠিকি বুঝবে।নিজেকে গুটিয়ে রাখলে হবে না।আর রুশান বন্ধু হিসেবে অনেক ভালো হবে,আমি কথা দিলাম।

-আপু প্লিজ....

-ভিনা আমার কথা শোন প্লিজ।পৃথিবীতে কতরকম সম্পর্ক আছে দেখ।প্রেমের চেয়েও বন্ধুত্ব সুন্দর।তাহলে ছেলেটাকে সুযোগ দিতে সমস্যা কীরে লক্ষ্মী?

ভিনা ভেবে দেখলো,প্রিতি ভুল কিছুই বলে নি।ভিনাই জটিল করে ভাবছে।ও না আগালে রুশান কীই বা করবে?সব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো,রুশানের সাথে ভালো বন্ধুত্ব রাখবে।

এরপর ভিনা ফারজানার অদ্ভুত আচরণের কথাও বললো প্রিতিকে।প্রিতি শুনে কিছুক্ষণ হাসলো।

-একদিন হুট করে যেয়ে বলবি,চলো রুশানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই,দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

পরদিন বিকালে রুশান ভিনার ছোট ফোনে দেয়ার পর ভিনা বুঝলো,প্রিতি আগে থেকেই সব ভেবে রেখেছিলো।ফোন ধরার পর রুশান স্বভাবতই অতি আগ্রহে ভিনার খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলো।ভিনাও রুশানকে অবাক করে দিয়ে খুব নরমালি কথা বললো।রুশান খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো।বিশেষ করে ভিনা যখন বললো-

-রাখি রে।কালকে দেখা হবে।কোনো দরকার থাকলে ফোন দিস।

আর পরেরদিন ভিনাকে চশমায় দেখে চোখই ফেরাতে পারছিলো না রুশান।ভিনার গাম্ভীর্য সবসময় আকর্ষণ করেছে ওকে।এই চশমা সেই গাম্ভীর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।ভিনা যদিও বারবার খুলে রাখছিলো,কিন্তু রুশান ওকে পরে থাকতে বললো।রুশান আর ভিনার হাসাহাসি দেখে ফারজানা একরকম মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো।রুশান মহাবিরক্ত হয়ে বললো-

-এই মেয়ে না অতিরিক্ত পাকনা।সত্যি করে বলো,গসিপের কথা এইটাই বলেছিলো না তোমাকে?

-হুম

-আস্ত পাকনা একটা।এত বেশি বুঝে। 

ভিনা ছোট করে হাসি দিলো।কারণ দুইদিন পরই ফারজানাকে রুশানের গলায় বাঁধবে ভিনা।
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp