অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ১৬ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-আই কান্ট বিলিভ,মিস ভিনা ইনজামাম আমার সাথে ডেটে এসেছে!

-বাহ্,পুরো নাম ও জানিস।

-কেন জানবো না?আচ্ছা,তুমি আমার পুরো নাম জানো না?

-না...

-সিরিয়াসলি ভিনা?

-সিরিয়াসলি রুশান।

রুশান হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেলো।ভিনা বুঝেও হেঁটে যেতে লাগলো,বরং আরো দ্রুত।রুশান না পেরে শেষে ছোটখাটো দৌড় দিলো ভিনাকে ধরার জন্য।

-আচ্ছা,সমস্যা নেই।আমার পুরো নাম রুশান বিন মাহমুদ।

-সুন্দর নাম।তোর বাবা মি.মাহমুদ কি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক? 

-হ্যাঁ! বুঝলে কীভাবে?

-নাম আগেও শুনেছি।কোচিং এ মকবুল স্যার প্রায়ই তোর বাবার নামে প্রশংসা করে ক্লাসের অর্ধেক সময় পার করে দিত। তার কাছে তুই স্পেশাল ছিলি,খুব সম্ভবত তোর বাবার জন্যই।

-মকবুল?শালা শুয়োর ছিলো একটা।বেজন্মা!

-বেজন্মা বুঝলি কীভাবে?

-এসব মানুষের জন্ম ঠিক নাই দেখেই এই অবস্থা।

-তুই তার জন্য তার মাকে অপমান করতে পারিস না।কোনো মা-ই চায় না বড় হয়ে তার সন্তান এরকম নষ্ট হোক,মা-রা কখনো ভুল হয় না।

-স্ট্রংলি ডিজ্যাগ্রি।মা রাও মানুষ। তাদের ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক।ইউ কান্ট ইগ্নোর ইট।

-ইন্টেনশনে গুরুত্ব দে।কোনো মাকে দেখেছিস সন্তানের খারাপ চাইতে?কখনো দেখবি না।ঠিক ইন্টেনশনে করা ভুল কাজকে তুই সরাসরি ভুল বলতে পারিস না।

-নিজের ইন্টেনশনকে সবসময় ঠিক ভাবাও ভুল।ইন্টেনশনের বেসিসে তুমি কোনো অপরাধ জাস্টিফাই করতে পারো না।

-মানুষ মাত্রই ভুল তুই বলেছিস।তাহলে একটা মানুষ ভালো না খারাপ সেটা জাস্টিফাই করার উপায় কী?ইন্টেনশন...নিয়ত।

-কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?

-বল

-আমার মনে হয় তুমি তোমার মাকে খুব বেশি মিস করো,এর জন্য যেকোনো মা কে তার জায়গায় রেখে তুমি চিন্তা করো।ইটস এ কাইন্ড অফ পার্শিয়ালটি। 

-এত গভীর উপলব্ধির জন্য শুধু নিজের মাকে দেখলেই হয় না,নিজে মায়ের জায়গায় যেতে হয়....

-তাহলে তুমি যা চিন্তা করছো,সেটা অবশ্যই ভুল,তাই না?কারণ তুমি এখনো মা হও নি।

ভিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলো।রুশানকে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে মাহভিনের ব্যাপারে।জানিয়ে দিলে রোজ রোজ কার এই এই ন্যাকামি বন্ধ হয়ে যেত।কিন্তু সোহেলের কাছে দেয়া কথা ভাঙতে পারবে না।তাছাড়া সামান্য পরিচিয়ে এতবড় কথা বলাও উচিৎ না।

-ভিনা?ডিড আই হার্ট ইউ?

-না।তবে যেসব মেয়েদের ছোট ভাই বোন থাকে,তাদের মাঝে সবসময় মাদারলি ফিগার খুঁজে পাবি।ইন দ্যাট সেন্স,আমি একেবারে ভুলও না।

-ঠিক।মাহভিনকে তুমি অনেকটাই মেয়ে হিসেবে ট্রিট করো,সে হিসেবে তোমার কথার একেবারে দ্বিমত আমি করতে পারছিনা।

ভিনা লেকের পাড় দিয়ে হেঁটে সব ফুল গাছ মনোযোগ দিয়ে দেখছে।ওকে দেখে মনেই হচ্ছে না রুশানের সাথে আছে।রুশান ভিনার এই গুরুত্বহীন আচরণে কষ্ট পাচ্ছে যদিও,কিন্তু ভিনা যে ওর সাথে বেড়িয়েছে এটা ভেবেই ভালো লাগছে ভীষণ। হুট করে কিছুই হবে না,সময় দিতে হবে।সময়ের চেয়ে বড় প্রভাবক কিছুই নেই।

-তোমার ক্লাস আছে আর?

-না,আর নেই।তোর আছে?

-উহু।আচ্ছা ভিনা....

-বল

-এইযে আমি তুমি বলি,তুমি তুই বলো,এভাবে কনভারসেশন চালাতে অদ্ভুত লাগে না?

-মোটেও না।তোর লাগলে তুই কথা বলিস না।

-এটাই তো তুমি চাচ্ছো।কিন্তু এটা হবে না।

ভিনা ঘুরে রুশানের মুখোমুখি দাঁড়ালো।একটু এগিয়ে এসে রুশানের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বললো-

-আমরা এসেছি একটা কারণে।আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে তোর *হুদা পিরিতের* কারণ বলার জন্য।টপিক থেকে বহুদূরে এসে পরেছি আমরা।বল,কেন এত ঘুরঘুর করিস?

-কারণ,আমি তোমাকে পছন্দ করি।

-পছন্দ অনেক মানুষই হয় এই জীবনে।সবার পিছে এভাবে ঘুর ঘুর করিস?

-না।পছন্দের ধরণ থাকে।

-আমারটা কোন ধরনের?

-তোমারটা সর্বগ্রাসী।

ভিনা অবাক হলো।রুশানের মত ছেলের মুখে এত ভারী শব্দ বেশ বেমানান।ভিনা জানে এধরনের পছন্দকে কী বলা হয়।কিন্তু জীবনের তিক্ততায় এই রূপ বিষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।রঙিন চশমায় ঢাকা এই অনুভূতি চশমা ভাঙার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাবে।তবে চশমা ভয়াবহ দূর্ঘটনায় ভাঙলে অন্ধত্বের জীবনে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা লাগে। তখন পৃথিবীর মনোরম সৌন্দর্য চোখের সামনে থাকলেও কালোর বাইরে কোনো রং চিন্তা করা যায় না।ভিনা এই অন্ধত্বকে খুব সহজভাবেই নিয়েছে।

-আগে প্রেম করতি নাকি?

-না।

-তাহলে এত বিরহের সুর তোর মধ্যে কেন?

-আমি তো হতভাগা ভিনা।ভালোবাসা পাওয়ার আগেই হারিয়ে সর্বহারা হয়েছি।

-না জেনে শুনে মানুষকে পছন্দ করা নিতান্তই ফ্যান্টাসি রুশান।সময়ের সাথে ফ্যান্টাসির জগত বিলুপ্ত হয়ে যায়।বাস্তবতা জায়গা নেয়।

-আমার পুরো জীবনটাই ফ্যান্টাসির ছিলো। আমার জীবনের বাস্তবতা তুমি।বাস্তবতা যেমন কঠিন,তুমিও তেমন। 

-আমি বাস্তবতা হলে আজকে আমার কাছে আসার সুযোগ খুঁজতি না।বাস্তবতাকে সবাই এড়িয়ে চলে।

-আমি এড়াবো না।কেউ এড়াতে পারে না।জীবন মানেই বাস্তবতা। 

-তর্ক ভালো লাগছে না।কিছুক্ষণ পরই সূর্য ডুবে যাবে।শেষ বিকেলের এই সময়টা আমার খুব প্রিয়।

-আমি এভাবে প্রতিটা বিকেল তোমার সাথে কাটাতে চাই ভিনা।

ভিনার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরছে।চোখ মুছে রুশানের দিকে তাকালো।এই জায়গায় যাবির থাকার কথা ছিলো।

-কেউ কথা দিয়েছিলো আমাকে সূর্যোদয় দেখানোর।সে কথা রাখেনি,আমি এখন কারো সাথেই কোনো মুহূর্ত ভাগাভাগি করতে চাইনা। 

-আমি যাবির না ভিনা।

ভিনা যেন নিজের হার্টবিট মিস করলো।মেরুদন্ড দিয়ে শীতল প্রবাহ বয়ে গেলো।

-যাবির.....যাবিরের কথা তুমি জানলে কীভাবে?

-আমি জানতে চাইনি।না জানা আমার জন্য অনেক বেশি ভালো ছিলো।আমি যাবিরকে ঘৃণা করি।

-আমাকে উত্তর দাও।

-তোমার মুখে তুমি শুনতে অনেক ভালো লাগছে ভিনা।

-রুশান...আমি জিজ্ঞেস করেছি কিছু...

-মনে আছে?যাবিরের জন্য টিউশনের কথা বলেছিলে?আমি আমার কাজিন কাইফের জন্য টিউশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।যাবির খুবই ইন্ট্রোভার্ট ধরনের মানুষ ছিলো,কিন্তু কাইফের সাথে ওর সম্পর্ক খুব ভালো হয়ে গিয়েছিলো কীভাবে যেন।যাবিরের মোবাইলে কথা বলা দেখে কাইফ জিজ্ঞেস করেছিলো এ ব্যাপারে,তখন যাবির তোমার কথা বলেছিলো।

-আর কী বলেছিলো যাবির?

-এতটুকুই যে বলেছে এই বেশি।এর বাইরে কোনো কথা হয়নি।

-ও...

-জিজ্ঞেস করেছিল আমি কেন ভালো স্টুডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও প্রাইভেটে পড়ছি?আসলে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে যখন এসব জানতে পারি,আমার পড়াশোনা আর হয়নি।আমি যে কীভাবে ঐ সময় পার করেছি,আমিই জানি একমাত্র।আমি কোথাও এক্সাম ই দেইনি।

-এখন?

-এখন আমি চেষ্টা করছি আমার জীবনে একজনকে ফিরিয়ে আনতে।

-তুমি জানলে কীভাবে আমার আর যাবিরের সম্পর্ক নেই?

-কাইফ ই বলেছে।

-কাইফ এসব জেনেছে কীভাবে?যাবির কী বলেছে ওকে?

-কিছু বলেনি খুলে।শুধু এতটুকুই বলেছে তোমাদের আর সম্পর্ক নেই।

-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যাবির শুধু এতটুকু বলেছে।

-দেখো ভিনা,আমি যতটুকু জানি,ততটুকুই বললাম।

ভিনা চোখ মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।রুশান টের পাচ্ছে কত ভালোবাসা জমে আছে ভিনার বুকে,অন্য আরেকজনের জন্য।এই ভালোবাসাটুকু নিজের জন্য অর্জন করা সম্ভব হবে নাকি রুশান জানে না।কিন্তু এই মুহূর্তে ভিনাকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,আমি ছেড়ে যাবো না কখনো।

পুরো আকাশ হালকা গোলাপি আর বেগুনি আভায় নীল রঙকে বিরহী করে তুলেছে।ভিনার চিৎকার করে কেঁদে পুরো পৃথিবীকে জানাতে চায়,যাবিরকে এখনো কতখানি ভালোবাসে।মাঝপথে হাত ছেড়ে দেয়া সেই মানুষটার জন্য বুকে যেই হাহাকার,সেটা প্রায়ই জানান দেয়,যাবির ফিরে আসবে।ফিরে আসা সেই যাবিরের জন্যও ভিনা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় পুরো পৃথিবী থেকে।কিন্তু বাস্তববাদী এক অংশ ভিনাকে ধিক্কার দেয় এই দূর্বলতায়।নিজের মাঝে নিজেরি দুই সত্ত্বার অন্তর্দ্বন্দ্বের ভয়াবহ যন্ত্রণা ভিনাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।বাইরের জীবন যতখানি গোছালো আর শান্ত হয়ে গেছে,ভেতরটা ততখানিই অগোছালো আর অস্থির।

মাগরিবের আযান দেয়া মাত্রই ভিনা হাঁটা ধরে বাসার পথে।ব্যাগে থাকা মোবাইল সময় দেখার জন্য বের করে দেখে সোহেলের অনেকগুলো মিসকল।বাসায় পৌঁছেই একেবারে কলব্যাক করার সিদ্ধান্ত নেয়।

রুশানের কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই ভিনা হাঁটা ধরে বাসার পথে।

-এই মেয়ে, কোথায় যাচ্ছো?বাসায় যাবে না।

-বাসায়ই যাচ্ছি।

-তোমার বাসা এদিকে।

-এদিকে না।আমি হোস্টেলে উঠেছি।হোস্টেল বললেও ভুল হবে,আসলে এক পরিচিত আপুর বাসায় উঠেছি।উনার বাসা এদিকে।

-কী বলো?কবে এসব হলো!আমি কিছুই জানি না!

-জানার কথাও না।

-আমি এগিয়ে দেই?

-দরকার নেই।

-প্লিজ?সন্ধ্যা হয়ে গেছে।এভাবে একা যেও না।

-আমি রিকশায় যাবো।

-আমিও...অনেকদিন রিকশায় উঠি না।

ভিনা কথা না বাড়িয়ে রিকশা নিলো।হুড না তুলে রুশানের সাথে বসলো।রুশান ভিনার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।ঠোঁট চেপে কান্নার জন্য সেগুলো জবার মত লাল হয়ে আছে,যেন এখনি রক্ত বের হবে।চোখ ফুলে আছে,খুবই ধীরে,কিন্তু ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে ভিনা।বিরহিণীর রূপ যে এত মায়াবি নিজ চোখে না দেখলে রুশানের বিশ্বাস হত না।ভালোবাসার বিচ্ছেদের রূপ ও কী হৃদয়গ্রাহী!রুশান ভালোবাসার ভালোবাসায় পড়ে গেছে।

ভিনার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই,যাবিরের কথা মনে পরে যাচ্ছে।একজন মানুষ এত নিখুঁত অভিনয় কীভাবে করে?কেনই বা করে।জেরিনের মধ্যে জিদ ছিলো প্রচুর।ভিনা ছিলো বর্ষার ভরা পুকুরের মত।অবশেষে জিদই জিতে গেলো সেই উপচে পরা এক পুকুর ভালোবাসার কাছে?

বাসায় পৌঁছে ভিনা নেমে দিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ জানালো বিনা বাক্য ব্যয়ে।কিন্তু রুশান এভাবে যেতে দিলো না।

-ভিনা শোনো...সবকিছু ভুলে গিয়ে নতুন শুরু করো?

-তুমি সব জেনেও কেন আমার সাথে থাকছো?

-কারণ আমি যাবির না।আমি রুশান।রুশান অনেক আগে থেকে....

-থেমে যাও।একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে তুমি সব জানো,নাহলে আমিই জানাতাম সময় বুঝে।আমি একাই ভালো আছি।কাউকে আমার প্রয়োজন নেই।

-একবার নিজের জীবনকে সুযোগ দাও ভিনা।

-না।ব্যাস।এখন চলে যাও।ভবিষ্যতে এসব কথা আমার সামনে আর বলবা না।নাহলে তোমার মুখ দেখাও আমি বন্ধ করে দিবো।

রুশান মাথা নিচু করে সব শুনে গেলো।সম্মতি দিলো না,বিরোধিতাও করলো না।ভিনা চলে যাওয়ার পর সুক্ষ্ম একটা কারণে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো।এটা সত্যি যে কাইফকে যাবির বলেছিলো এই সম্পর্ক ভাঙার কথা।কিন্তু কীভাবে বলেছিলো,এটা ভিনাকে জানায়নি রুশান।একে মিথ্যা কথা বলা যায় না,একে বলে লুকানো।ভিনা যদি জানে যাবির সেদিন কান্না করে,হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে কাইফকে বলেছিলো এ কথাটা,তাহলে কী হবে?
.
.
.
চলবে................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp