ভাইয়ের বন্ধু যখন বর - পর্ব ১০ - ইয়াসমিন তানিয়া - ধারাবাহিক গল্প


তিশা ঘুমিয়ে আছে, কিছুক্ষন আগে-ই ডাক্তার কাবেরি এসে তিশা'কে চেকআপ করে গিয়েছে। ডাক্তার কাবেরি জিসানদের ফ্যামিলি ডাক্তার। তিশা'কে কিছু'টা শান্ত ও রিলেক্স করার জন্য ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছেন।ডাক্তার যাওয়ার সময় বলে গিয়েছেন, 'তিশার প্রোপার খেয়াল রাখতে। এখনো তিশা বাচ্চা। বয়সও বা কী ১৩ বা ১৪ হবে। আর এতটুকু বয়সে এমন ইন্সিডেন্ট তিশার জন্য মস্তিষ্কে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই তিশা'কে যত দ্রুত সম্ভব নরমাল করার চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে ওর ব্রেনে আঘাত আসবে। আর ও ট্রোমা থেকে ইজিলি বের হতে পারবে না। এটা ওর জন্য মারাত্মক শকডের বিষয়।'

জিসান ড্রয়িং রুমে বসে আছে। রাগে এখনো মাথার রগ গুলো ফুলে আছে। কিছুতে-ই যেন নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। ওর একটা-ই কষ্ট অর্ককে নিজ হাতে খুন করতে পারল না। তার আগে-ই রায়হান ওকে বাঁচিয়ে ফেলেছে। তাই রাগে কটমটিয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন'তো রায়হান কেও মারতে মন চাইছে। আজ ওর কারণে অর্ক বেঁচে গেছে।

তৌফিক সাহেব এতক্ষন ফোনে ব্যস্ত ছিলেন।ছেলেটা'কে নিয়ে তিনি পরেছেন মহা যন্ত্রনায়। কারো কথা শুনে না। রাগের মাথায় একটার পর একটা সিনক্রিয়েট করে আসে, আর তা সামলাতে তৌফিক সাহেবকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
আজও তার ব্যতিক্রম না। অর্ক মিনিষ্টারের ছেলে, এটা সামলাবে কিভাবে সেটা-ই এখন সব থেকে বড়ো কথা।

উনি ফোনে কথা বলে শোফায় বসে পরলেন। আর মিসেস রাবেয়া বেগম ছেলের মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করছেন। তা দেখে তৌফিক সাহেবের মন চাইছে, মা ব্যাটা দুজনকে-ই আফ্রিকা জঙলে পাঠিয়ে দিতে।তাদের দু'জনের জন্য ওটা-ই সবথেকে শ্রেষ্ঠ জায়গা।মানুষের মধ্যে থাকার যোগ্যতা-ই নেই এদের। ছেলে আকাম করবে আর মা ছেলের মাথায় পানি ঢেলে মাথা ঠান্ডা করাবে। বাহ! কী ফ্যামিলি আমার।
বুঝলাম অর্ক যা করেছে ঠিক করেনি, কিন্তু তাই বলে নিজেও কী ওর মত ক্রিমিনাল হয়ে যেতে হবে। অর্ককে অন্যভাবেও শাস্তি দেওয়া যেত। কিন্তু এখন! এখন কী হবে। মা ব্যাটার'তো কোন টেনশন নেই।
আর এদিক দিয়ে যে আমার পিছে বাঁশ পরেছে তাতে তাদের কী!

'তুমি এটা কীভাবে করতে পারলে জিসান? তৌফিক সাহেব আর সহ্য করতে না পেরে জিসান'কে জিঙেস করে-ই ফেলল।'

'তুই কাজটা একদম ভালো করিস নিই রায়হান।' বাবার কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন না করে রায়হানকে ধমকাচ্ছে জিসান।'

'আমি তোমাকে কিছু জিঙেস করছি। তুমি আমার কথার উত্তর না দিয়ে রায়হানকে কেন ধমকাচ্ছ।'

'তিশা তোর বোন হয়, আর তোর বোনের সাথে ঐ জানোয়ারটা এত নোংরা কাজ করতে চাইছে, আর তুই ওই *** কে বাঁচালি। ওয়াই....রায়হান!'

তৌফিক সাহেব ঠাস করে জিসানের গালে একটা থাপ্পর লাগিয়ে দিল। বেয়াদব ছেলে, ও তোকে বাঁচাবার জন্য এমন করেছে। আর কী করতে চাইছিস। হাত পা ভেঙে দিয়েছিস। এখনো না-কী জ্ঞান ফিরে নাই। আর জ্ঞান ফিরলেও আর কখনো চলতে পারবে কিনা সন্দেহ। আর তুই এখনো এসব বলছিস।

এত কিছু নিজে করে আবার এই ছেলেটা'কেই ধমকাচ্ছিস। আরে.. ও না থাকলে তুই আরো আগে জেলের ভাত খাইতি। বার বার সব জায়গা থেকে তোকে বাঁচিয়ে আনে বলে আজ তোর এই পরিণতি।তোকে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া-ই ভালো। তাহলে হয়তো তোর একটু শিক্ষা হতো।

জিসান মাথা নিচু করে এখনো স্থির হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে না, কোনো লাভ হয়েছে ওকে অযথা এই থাপ্পর টা মেরে। উল্টা তৌফিক সাহেবের হাত ব্যথা করছে।

'আংকেল মাথা ঠান্ডা করুন। এখন মাথা গরম করে কিছু হবে না। রায়হান অনুনয়ের সুরে বলল।'

'জিসানের কারো কথা এখন ভালো লাগছে না, সবাইকে নিজের দুশমন মনে হচ্ছে। কেউ তার অনুভূতির কদর করছে না। বরং কেবল নিজেদের টা নিয়েই ব্যস্ত এরা। অসহ্য হয়ে চলে যায় নিজের রুমে।'
 
 বাবা রায়হান ঠিক বলেছে, জিসানকে পরে দেখব।আগে এটা কীভাবে সামলাব সেটা ভাবার বিষয়। অর্কের বাবা দেশে নেই। তাই হয়তো এখনো পরিস্থিতি আমাদের হাতে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে-ই উনি দেশে ফিরছেন। এসে-ই আগে জানতে চাইবে তার ছেলের এ অবস্থার জন্য কে দায়ী? আর তখন তিনি তার সব শক্তি লাগিয়ে দিবে জিসানকে শাস্তি দিতে। তার জানার আগে-ই আমাদের কিছু করতে হবে।

তাওহীদ তুই তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা কর, তোকে যা বললাম।এই আপদটা'কে এখান থেকে বিদায় কর। তা না হলে, আমি সহ্য করতে পারবো না আমার চোখের সামনে থেকে আমার ছেলেকে হেন্ডক্যাপ পড়িয়ে পুলিশ নিয়ে যাবে। এটা আমি সহ্য করতে পারবো না রে!
তৌফিক সাহেব কেঁদে উঠলেন। যত-ই বকাবকি করুক, কিন্তু সব বাবা মা-ই নিজের সন্তানকে ভালোবাসে। কিন্ত জিসানের এই রাগটাকে খুব ভয় পায় তৌফিক সাহেব।কখন কী করে বসে ছেলেটি!

'জিসান তিশার রুমে প্রবেশ করে। তিশা গুটিশুটি মেরে বাচ্চাদের মত ঘুমিয়ে আছে। তানজিলা, নিশি আর তিশার মা মেয়ের পাশে বসে আছে। এত বড়ো একটা দূর্ঘটনার পর মেয়েকে কিছুতে-ই একা ছাড়বে না আর।'

তানজিলা জিসানকে দেখে ইশারা করে তিশার পাশে বসতে। কিন্তু জিসান মাথা নেড়ে না বলে। তিশা ঘুমিয়ে আছে, ঘুমাক! ওকে দেখলে-ই আমার অর্কের প্রতি রাগটা আরো বাড়বে। তাই জিসান নিজের রুমে চলে গেল। 


জিসান নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তিশার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা চিন্তা করছে।

আজ দুপুরের ঘটনা। জিসান,রায়হান ও ওদের কিছু ফ্রেন্ডসরা মিলে রেস্টুরেন্টে এসেছিল লাঞ্চ করতে।অনেকদিন পর একসাথে কিছু প্লান করল। ফ্রেন্ডসদের সাথে আড্ডা ভালো-ই জমেছিল।
এমন সময় জিসানের একটা কল আসে। কলটা রিসিভ করতে-ই জিসানের মুখটা রক্তবর্ণ ধারন করে। রায়হান সহ সবাই বুঝতে পারে এমন কিছু হয়েছে হয়তো যার কারণপ জিসান ভীষন রেগে গিয়েছে।

'কিন্তু তবুও জানতে হবে, তাই রায়হান জিসানের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে?'

-জিসান ফোনটা রেখে খুব শান্ত কন্ঠে বলল, তিশা কিডন্যাপ হয়েছে। এটা শোনার পর রায়হান বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ওয়াট!

'হুম বলে, জিসান আবার কাকে যেন ফোন করল।এবং একটা নাম্বার দিল। নাম্বরটার লোকেশন জানার জন্য।'

এদিক দিয়ে রায়হানের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে জিসানের এমন নিরব থাকার কারণে। জিসান কে করেছে? আর তুই কার নাম্বার দিয়েছিস? এভাবে শান্ত হয়ে কীভাবে আছিস? আমি চললাম!

'রায়হান যেতে নিলে, জিসান হাতটা ধরে ফেলে। রিলেক্স রায়হান। আগে লোকেশন টা জানতে দে।'
কে করেছে তুই জানিস?'

হুম, অর্ক করেছে। ওর গাড়িতে তিশাকে দেখেছে শাহিন।'
শাহিনও জিসান ও রায়হানের ফ্রেন্ড। লোকেশন জানার সাথে সাথে জিসানসহ বাকি সবাই রওনা দিল।

অর্কের আঘাত গুলো তিশা নিতে পারেনি। তাই তিশা আবার অজ্ঞান হয়ে যায়। অর্ক কয়েকবার পানির ছিটা দেওয়ার পরও যখন তিশার জ্ঞান ফিরে না, তখন বাধ্য হয়ে চলে যেতে নেয়। যা করবে জ্ঞান ফিরলে-ই করবে।তা না হলে তিশাকে কষ্ট দেওয়ার এত প্লান সব নষ্ট হয়ে যাবে। এসব ভেবে দরজাটা খুললে-ই, সামনে দাঁড়ান ব্যক্তিটাকে দেখে না চাইতেও অর্ক ভয় পেয়ে যায়।

'জিসানের চেহারা রাগে লাল হয়ে আছে,। ভেতরে ডুকে-ই অর্ককে একটা লাথি মারে। অর্ক ছিটকে গিয়ে পড়ে দূরে। রায়হান আর ওদের ফ্রেন্ডসরা অর্কের দুই ফ্রেন্ডসদের পিটাচ্ছে। এমন সময় জিসানের ডাকে রায়হান রুমের ভেতরে যায়।'

জিসান তিশার জ্ঞান ফিরানো'র চেষ্টা করে, তিশা জিসানের কন্ঠ শুনতে পেয়ে, অল্প চোখ খুলে জিসানকে দেখতে পায়। কিন্তু কোনও কিছু বলার আগে আবার জ্ঞান হারায়। এরপর অনেক ডাকার পরও কোনও লাভ হলো না। তাই রায়হান কে ডাক দেয় তিশাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

রায়হান তিশাকে নিয়ে জিসানদের বাসায় আসে।কারন রায়হানের বাবা মাও এখানে। খবর পেয়ে সবাই অপেক্ষা করছে। তিশাকে বাসায় রেখে রায়হান আবার জিসানের কাছে চলে যায়। জিসানের রাগের সম্পর্কে রায়হান খুব ভালো করে-ই জানে, তাই জিসানকে আটকাতে হবে।

-রায়হান গিয়ে দেখে অর্ক আর ওর ফ্রেন্ডসদের অবস্থা খুব খারাপ, কিন্তু জিসান তখনো মেরে যাচ্ছে ওদের, আরো কিছুক্ষন থাকলে হয়তো মরে যাবে। জিসানদের ফ্রেন্ডসরা জিসানকে ধরার সাহসও পাচ্ছে না।
রায়হান গিয়ে জিসানকে আটকায়। রায়হান জিসানকে বাসায় নিয়ে আসে। আর ওদের ফ্রেন্ডসদের বলে অর্ক আর ওর সাথীদের কোনও হসপিটালের সামনে ফেলে আসতে। কারণ ওদের কিছু হলে কারো জন্য-ই ভালো হবে না।


সকাল হতে-ই তিশার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে তিশা রুমটা দেখে চিনতে পারে না ও কোথায় আছে। তাই চারদিকে একবার চোখ বুলায়। রুমটা চিনতে না পারলেও আশেপাশে লোকগুলোকে তিশা খুব ভালো করে-ই চিনে।

তিশার মা তিশার পাশে ঘুমিয়ে আছ। বাবা সোফায় আর রায়হান বারান্দার ইজি চেয়ারটায় বসে ঘুমিয়ে আছে। সবাই'কে খুব ক্লান্ত লাগছে। কালকের ঘটনায় তারাও খুব টেনসড ছিল হয়তো। তাদের জন্য হলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হবে বলে তিশা ভাবে। তা না হলে আমার সাথে সাথে সবার কষ্ট বাড়বে। তিশা মনে মনে নিজেকে শক্ত করে নিল।
তিশা অনেক কিছু চিন্তা করে, মাকে ডাকদিল।
মা... মা...!

তিশার কন্ঠ শুনে তিশার মা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। তিশার মুখে হাত দিয়ে চিন্তিত সুরে বলে, 'কী হয়েছে তিশা? তুই ঠিক আছিস'তো মা? কিছু লাগবে? পানি খাবি? বোল কী লাগবে। শরীর খারাপ লাগছে না'তো! ডাক্তার ডাকব! কিছু'তো বোল মা? চুপ কেন!

'মা আমি ঠিক আছি। দেখ তুমি! আমি একদম ঠিক আছি। তুমি আগে বলো আমরা কোথায় এখন?'

আমরা জিসানদের বাসায়। কাল ডাক্তার তোকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছিল, তুই সারারাত ঘুমিয়ে ছিলি। তাই আমরাও এখানে রয়ে গেলাম। তোর বাবা আর ভাই'কে কত করে বললাম, বাসায় চলে যেতে। কিন্তু না, তোকে ছাড়া যাবে-ই না।
তিশাদের কথার শব্দে তিশার বাবা ও রায়হানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তারা সবাই মিলে কিছুক্ষন গল্প করে।রায়হান খুশি, তিশাকে স্বাভাবিক দেখে। কালকের ঘটনা তুলে তিশা'কে আর কষ্ট দিতে চায় না রায়হান। তাই সেই প্রসঙ্গে কেউ কিছু-ই জিজ্ঞেস করল না তিশা'কে।
কিছুক্ষন পর তিশা মাকে বলল, 'মা আমার না খুব ক্ষুধা পেয়েছে।'

তিশা ডাইনিং টেবিলে বসে আছে, আর সবাই তিশার দিকে তাকিয়ে আছে। তিশাকে এত'টা স্বাভাবিক দেখে সবাই খুশি, কিন্তু "তবুও কিছু কথা" রয়ে যায়।

তিশা সবার দিকে একবার তাকায়। সবাই'কে এত'টা গম্ভীর দেখে জিজ্ঞেস করে, 'কী হয়েছে? সবাই আমার দিকে এভাবে কেন তাকিয়ে আছ? যেন ভূত দেখছ। সব ঠিক আছে তো!'

'তখন-ই জিসান সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, 'সব ঠিক-ই আছে! কিছু হলে'তো এতক্ষনে মিষ্টি বিলিয়ে ফেলত। এত তাড়াতাড়ি কিছু হবার সম্ভাবনা ও নেই।'

জিসানের কথায় তাওহীদ হচকায়। জিসানের দিকে বিরক্ত চোখে তাকায়। বলে, ' কখন কী বলতে হয়, একটু ভেবে'তো বোল।'

এত ভাবাভাবি'র সময় নেই আমার কাছে, আর ও কী কোন দেশের প্রেসিডেন্ট যে, আমাকে অনেক ভেবে চিন্তে কথা বলতে হবে। আর তুই এখন চেয়ে আছিস কেন? খাবার কী মুখে তুলে দিতে হবে এখন।

তিশা ওর বাবা-মা আর ভাইয়ের দিকে তাকাল। কেউ কিছু-ই বলছে না এই হিটলারকে। সবাই শুনেও না শুনার ভ্যান করে খেয়ে যাচ্ছে। আজব ফ্যামিলি আমার। 
হয়তো সবাই জানে জিসান এমনি। তাদের সবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে এখন। তাই তিশাও আর কথা না বারিয়ে খাওয়া আরম্ভ করল।

'আর জিসান খাওয়ার ফাঁকেফাঁকে তিশা'কে দেখে যাচ্ছে। জিসান ইচ্ছা করে-ই এসব বলছে, কারন জিসান জানে তিশার আশেপাশে সবাই স্বাভাবিক থাকলে তিশাও কালকের ঘটনা তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে।'

বিকেলে তিশা নিশির সাথে বসে গল্প করছিল, আর গল্পের ফাঁকেফাঁকে নিশির কাছে কাল কী কী হয়েছে তা জানার চেষ্টা করছে। নিশিও বরবর করে সব বলে যাচ্ছে। এমন সময় নিচের ড্রয়িংরুম থেকে চিতকার চেঁচামেচির শব্দ পাওয়া গেল। তিশা ভাবছে আবার কী হলো।

ড্রয়িংরুমে জিসান বসে আছে, আর তার অপসাইডে মুখ গোমড়া করে বসে আছে তৌফিক সাহেব। তাদের মাঝখানের টি টেবিলে জিসানের প্যারিস যাবার টিকেট পড়ে আছে। বাবা ছেলের মধ্যে তুমুল ঝড় বয়ে গেল এই মাত্র। অথচ এখন তারা দুজন-ই চুপ।

সিচুয়েশন বুঝে তৌফিক সাহেব জিসানকে প্যারিসে পাঠানোর চিন্তা করছে। এতে শুধু জিসান নয়৷ রায়হান তিশা ওদের জন্যও ভালো হবে। জিসান এখানে থাকলে সিচুয়েশন আরো খারাপ হবে।না চাওয়া সত্যেও ওর সাথে রায়হান ও তিশার জীবনটাও হেল হয়ে যাবে।রায়হান'তো বড়ো, সব সামলিয়ে ফেলবে। কিন্তু তিশা ও'তো একটা বাচ্চা মেয়ে, এসব কিছু সামলানোর বয়স হয়নি ওর।
তাছাড়া তিশার থেকে আপাতত জিসানকে দূরে রাখা-ই ভালো। কারন জিসান দিনদিন তিশার প্রতি অতিমাত্রায় পজেসিভ হয়ে পড়ছে, যা ভবিষ্যৎ এ না জিসানের জন্য ভালো হবে, না তিশার জন্য।

কিন্তু জিসান'তো জিসান-ই! তার এক কথা সে যাবে না। সে কিছুতে-ই যাবে না। ঝড় আসুক, তুফান আসুক, বন্যা হোক তবুও সে বাংলাদেশ ছেড়ে এত দূর কিছুতে-ই যাবে না। জিসানের এই না যাওয়ার কারন'টা খুব ভালো করে-ই জানে সবার, তবুও জিসানকে বুঝাবার বৃথা চেষ্টা করছে।
তৌফিক সাহেব সহ্য করতে না পেরে অবশেষে জিসানকে তিশার কসম দিল, যদি ওর ভালো চাও তাহলে আজ-ই দেশ ছেড়ে চলে যাও।

বাবার মুখে এসব কথা শুনে জিসান কিছুক্ষন চেয়ে রইল। এরপর হাঁটা ধরল,উপরে। তিশা ও নিশি কিছু বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছিল।এমন সময় জিসান এসে তিশার হাতটা ধরে নিচে নিয়ে গেল সবার সামনে।
ঘটনা এত-ই দ্রুত ঘটল যে তিশা কিছু-ই ভাবতে পারছে না।

জিসান নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি চাও'তো আমি চলে যাই, ওকে চলে যাব। কিন্তু আমার একটা শর্ত মানতে হবে।

'কী? ছেলের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলল তৌফিক সাহেব।'

'আমি তিশা'কে বিয়ে করব। আজ-ই, এখন-ই। বিয়ের কথা শুনে তিশার পা দু'টো মনে হয় অবশ হয়ে গেল। কেমন অসহায় দৃষ্টি'তে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না কেন?

আমার মেয়ে'টা এখন ছোটো জিসান। এভাবে তোমার সাথে কীভাবে বিয়ে দিব। একবার ভাবো! তুমি আগে প্যারিস যাও। তুমি আসতে আসতে তিশাও কিছুটা বড়ো হয়ে যাবে তখন দেখা যাবে।

না আংকেল! আমি এত'টা রিস্ক নিতে পারব না। সবাই এখানে জানে সব কিছু, তাই আমি আসা করব আমার দিক'টাও বুঝবেন। আমি এভাবে চলে গেলে শান্তি মতো থাকতে পারব না। মরে যাব।

এদিক দিয়ে তিশা জিসানের হাত থেকে নিজের হাতটা ছুটানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জিসানের অগ্নি দৃষ্টি তিশার দিকে পড়ায় সব চেষ্টা একদম শেষ।

জিসান'কে সবাই অনেক বুঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু জিসান'তো নাছোড়বান্দা ।সে যা চায় তা হাসিল না করে এক পাও এগোবে না। জিসানের পাগলামি সম্পর্কে সবাই জানে তাই কারো কাছে আর কোনও পথ রইল না।

অবশেষে জিসান ও তিশার বিয়ে'টা হয়ে-ই গেল। সবার অনেক জোড়া জোরাজোরি'তে বিয়ে'টা করতে একপ্রকার বাধ্য হলো তিশা। জিসান যা চেয়েছে, তা তো পেল। কিন্তু সাথে তিনটা শর্ত ছিল।

'প্রথম শর্তটা তৌফিক সাহেব দিয়েছিল। জিসান পাঁচ বছর আগে দেশে ফিরতে পারবে না।'

আর বাকি দু'টো শর্ত তিশা দিয়েছিল। যখন রায়হান ওকে বিয়ের জন্য মানাতে গেল। তিশাও জানে জিসান বিয়ে না করে কিছুতে-ই যাবে না। ঘাড়ত্যাড়া মানুষ!

তাই সুযোগ পেয়ে দু'টো শর্ত ধরিয়ে দিল। তিশার দুটো শর্তের মধ্যে একটি ছিল, জিসান ও তিশার বিয়ের কথা সময় না হওয়া পর্যন্ত কেউ জাতে না জানে। কখনো সিচুয়েশন যদি এমন হয় বিয়ের কথা বলতে-ই হবে, তাহলে বলা যাবে। তাছাড়া না।

তিশার দ্বিতীয় শর্ত ছিল, তিশার পড়ালেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিশা কে কোনও সম্পর্কে আবদ্ধ করতে বাধ্য করা যাবে না।"ল

তার মানে জিসান তিশাকে পেয়েও পেল না। তিশার শর্তগুলো শুনে জিসান শুধু একটু বাঁকা হাসল। তবে জিসানের সেই মুহুর্তে সব শর্ত মেনে না নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।

জিসানের এয়ারপোর্টের যাওয়ার সময় হয়ে গেল। সবাই জিসান'কে বাড়ির বাহিরে এসে বিদায় জানাল।একজন ছাড়া। জিসান কোনও কথা না বলে উপরে চলে গেল। সবাই বুঝতে পারল জিসান কোথায় গিয়েছে?

তিশা বিছানা'য় আধোশোয়া হয়ে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে। আর চিন্তা করতে লাগল, কী থেকে কী হয়ে গেল। এত কিছু'তো স্বপ্নেও ভাবিনি ও।
যে মানুষটি'কে সারাদিন বকা ছাড়া মনে করতাম না, সে মানুষটি কীভাবে আমার সাথে জরিয়ে গেল। আমি'তো কখন এমন কিছু চাইনি তাহলে কেন এমন হলো!

এমন সময় কেউ দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। তিশার ঘোর কাটতে-ই সামনে তাকায়। জিসানকে দেখে লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

জিসান তিশার সামনে গিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে তাকিয়ে থাকে তিশার দিকে। হয়তো এত বছর না দেখার সকল তৃষ্ণা নিবারনের ব্যর্থ চেষ্টা। কারণ এরপর'তো এই মুখটি আর দেখা হবে না ওর। জিসান নিজেকে সামলে বলে,
'আমি চলে যাচ্ছি তিশা। এর পর কবে দেখা হবে জানি না। হয়তো তুই মনে মনে এখন আমাকে ঘৃনা করছিস।কিন্তু আমার মন বলছে একদিন ঠিক-ই তুই বুঝতে পারবি। আমি কেন এসব করেছি?'

'তিশা তখন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছু-ই বললো না। বা বলা চলে, বলতে পারল না।'
জিসান ওর একদম সামনে এসে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে আনে। তিশা ভয়ে চোখ বুঁজে ফেলে। এই অবুঝ মেয়েট'কে এভাবে চোখ বুঁজতে দেখে জিসান মৃদু হাসে। একটু ঝুঁকে তিশার কপালে একটা আদর দিয়ে দেয়। ভালোবাসাময় প্রথম পরশ ছিল জিসানে তরফ দেখে। এরপর তিশাকে ছেড়ে দাঁড়ায়। যাওয়ার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে শুধু বলে যায়, 'ভালো থাকিস বউ, পারলে আমার জন্য একটু তাড়াতাড়ি বড়ো হবার চেষ্টা করিস।'

'জিসান গাড়িতে উঠে চলে গেল। রায়হানও সাথে গেল ওর। তিশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জিসানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। আর জিসান গাড়ির লুকিং গ্লাস দিয়ে তিশা'কে দেখে চোখের এক কোণা দিয়ে এক ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। যা কেউ দেখার আগে-ই মুছে ফেলল।'

জিসানের যাওয়ার পর তিশা ও রায়হানকেও কিছু দিনের জন্য, অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিল তৌফিক সাহেব। অর্কের পিতা প্রানপ্রণ চেষ্টা করল জিসান'কে বাংলাদেশে এনে চরম শাস্তি দেওয়া'র। কিন্তু বাঁধ সাধল, একটা সিসিটিভি ক্যামেরা।
সেদিন তিশা'কে কিডন্যাপ করার সময় রাস্তায় থাকা সিসিটিভি ফুটেজে সব দেখা যাচ্ছে। আর এ খবর মিডিয়াতে গেলে, অর্কের পিতা জানে, নিজের মান সম্মান'তো যাবে, সাথে হয়তো পদটাও। তাই কিছু'টা শান্ত হয়ে গেল। অর্ক'কে চিকিত্সার জন্য বাহিরে নিয়ে যাওয়া হলো।

কিছু দিন পর, তিশা'কে নিশির সাথে নিশির স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। আর সেখানে-ই নিলার সাথে দেখা হয় তিশার। আর বেষ্ট ফ্রেন্ড হয়ে যায় দুজন। নতুন স্কুলে উঠে তিশা অতিতের সব কিছু পিছে ফেলতে থাকে। শুধু পারে না জিসান'কে ভুলতে। কারণ কোনও না কোনও ভাবে এসে-ই পরে তিশার সামনে। "
.
.
.
চলবে……….......................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp