অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ২৫ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


পুরান ঢাকার সরু এক গলির শেষ মাথায় নওমির বাসা।এই গলিতে গাড়ি তো দূর,রিকশাও ঢুকবে না।আজকে ভিনা গাড়ি নিয়ে এসেছে বাধ্য হয়ে,কারণ যাওয়ার সময় দুইটা বিড়াল সঙ্গে করে নিয়ে যাবে প্রিতির জন্য।ড্রাইভারকে সুবিধাজনক জায়গায় পার্ক করতে বলে ভিনা দুই হাতে জিনিসপত্র বোঝাই ব্যাগ নিয়ে হাঁটা ধরলো।ড্রাইভার এগিয়ে দিতে চাইলেও মানা করে দিলো,ভিনা চায়না নওমি গাড়ি নিয়ে আসার ব্যাপারটা জানুক।ঠিকানা অনুযায়ী বাড়ি খুঁজে সামনে দাঁড়াতেই ভিনার মন ভেঙ্গে গেলো।পুরোনো চার তলা বাড়ি,যার মেইন গেট আংশিক ভাঙ্গা।নেই কোনো দাঁড়োয়ান বা সিকিউরিটি। অন্ধকার,সরু আর নোংরা সিড়ি।দুইজন মেয়েমানুষ কত অনিরাপদে থাকছে এখানে!প্রতি মুহূর্তে নওমির কষ্ট উপলব্ধি করে ভিনার বুক ভারি হয়ে আসছে।এই নওমি আগে ঢাকার অভিজাত এলাকায় পশলি ডেকোরেটেড এপার্টমেন্টে থাকতো,যেখানে ছিলো চব্বিশ ঘন্টা সিকিউরিটি।আগে নওমিদের দুইটা গাড়ি ছিলো,একটা রেড ওয়াইন,আরেকটা কালো কালারের।ভিনার মনে পরে,পরের গাড়িটা সাদা কেনার কারণে নওমি কেঁদে কেঁটে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো,তার সেই রেড ওয়াইন রঙের গাড়িই চাই।পরে তার বাবা কয় লাখ টাকা গচ্চা দিয়ে নতুন সেই গাড়ি কেনেন।নওমি সবসময় পছন্দের গাড়িই ব্যবহার করতো যখন বাইরে যেত।নওমির বাবা নিজে সফল ব্যবসায়ী, এছাড়াও দাদাবাড়ির দিক থেকেও বেশ অভিজাত এবং ধনী পরিবার ছিলো নওমির।এমনকি,ভিনাদের থেকেও অর্থনৈতিক অবস্থা সবসময় ভালো ছিলো তাদের।ভাবতেও অবাক লাগছে,যে মানুষ এত টাকা লস দিয়ে মেয়ের আবদার রাখতে ভিন্ন রঙের গাড়ি কেনেন,উনিই দিনশেষে তার স্ত্রী সন্তানকে এভাবে ছুড়ে ফেলে দিলেন কীভাবে!এমনকি ঝানু উকিল দিয়ে মোকাদ্দমায় জিতে ভরণ পোষণ ও দেয়ায় অস্বীকৃতি জানালেন।ভিনা পরে ভেবে দেখলো,নওমির বাবার কাড়ি কাড়ি টাকা ছিলো,তাই ভালোবাসার নামে টাকা খরচ কোনো ব্যাপারই ছিলো না তার জন্য।কিন্তু উনি সত্যিকার অর্থে কোনোদিন ও মেয়েকে ভালোবাসা দেননি,দিয়েছেন টাকা।কিন্তু নওমি এটাকেই বাবার ভালোবাসা মনে করে নিজেকে তার রাজকন্যা ভেবে বসেছিলো।আহা মেয়েটা!কী বাজেভাবে মন ভেঙেছে ওর!

তিনতলায় বাম দিকের ফ্ল্যাটে নক করতেই নওমি খুলে দিলো।চোখে মুখে ভীষণ লজ্জা আর ইতস্ততা।সরাসরি ভিনার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না।তাকালে হয়ত দেখতো,ভরা চোখে কান্না চেপে রেখেছে ভিনা।

-এসব আবার কী?!এত কী এনেছিস তুই?

-কিছু না।এতদিন পর আন্টির সাথে দেখা হচ্ছে,খালি হাতে আসতে ইচ্ছা হলো না।

ভিনা ভেতরে ঢুকে ড্রয়িং রুমে বসলো।সত্যি বলতে এটা ড্রয়িং রুম,বেড রুম আর ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।এখানে খাট,টেবিল,দুটা ছোট সোফা আছে।ভেতরে তাকিয়ে দেখলো একটা ছোট রুম আর রান্নাঘর আছে,রান্নাঘরের একদম সাথেই লাগোয়া বাথরুম!যারা এই বাসা বানিয়েছে,তাদের রুচি দেখে ভিনার ঘেন্না ধরে গেলো।

নওমি ভিনার হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে পাশের টেবিলে রাখলো।

-তাই বলে এতকিছু?এখানে আসতে অনেক কষ্ট হয়ে গেলো না?হেঁটে আসতে হয়েছে তো।

-তাতে কী!এটা কোনো ব্যাপার।আমার হাঁটার অভ্যাস তো অনেক আগে থেকেই আছে।

-গাড়ি নিয়ে আসিস নি?ড্রাইভারকে বলতি এগিয়ে দিতে।

-না,গাড়ি ব্যবহার করা হয় না এখন।একটা নষ্ট,আরেকটা বাবা ব্যবহার করে।

ভিনার মিথ্যা বলতে একটু ও খারাপ লাগলো না। শুধু মনে মনে দোয়া করলো,নওমি যেন সত্যি না জানে।

-আজকে আনতি অন্তত,বিড়াল নিয়ে যাবিনা?

-উবার নিয়ে নিবো নে।আর ড্রাইভারের খরচ কত জানিস?তেলের দাম ও তো বাড়ছে হুহু করে।

নওমি ভিনার পাশে বসে বসলো।

-আসলেই রে।জিনিসপত্রের এত দাম।চলাই মুশকিল হয়ে যায়।

-আন্টি কোথায়?

-আম্মু রান্নাঘরে।আসবে একটু পরই।অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি,এখন কারো সাথেই দেখা করতে চায় না।তোর সামনে আসতে চায়নি একদম।

-তোরা কেন এমন করছিস?মা মারা যাওয়ার পর আন্টি কতদিন আমাকে আগলে রেখেছিলো।তোর সাথে আমার টিফিন ও দিয়ে দিতো প্যাক করে।বাসায় ও রান্না করে পাঠিয়েছে।আবার কতদিন তোর সাথে মিলিয়ে একি জামা কিনে দিয়েছে।আমাকে তো কখনো নিজের মেয়ের বাইরে কিছু ভাবেন নি।আজকে এমন কী হলো যে আমি এত পর হয়ে গেলাম?আমাকে রীতিমতো জোর করে তোর বাসায় আসতে হলো?

-আগের মত এগুলো করতে পারবে না দেখেই লজ্জা কাজ করে।আর যে ঘটনা ঘটেছে....

-কী ঘটনা?যিনি স্নেহ করেন,উনি কি শাসন করতে পারেন না!নাকি আমার উপর তার অন্য কোনো রাগ আছে?

-উফফ ভিনা!কীসব বাজে বলিস?আম্মুর তোর উপর কেন রাগ থাকবে?

-তাহলে আন্টি এখনো কেন দেখা করলো না আমার সাথে?

-নিয়ে আসছি,দাঁড়া।

নওমি প্রায় পনের মিনিট পরে হাফসা কে নিয়ে আসলো।হাফসা পুরোনো ম্যাক্সি পরে আছে,উপরে বড় সাদা সুতি ওড়না।চুল উস্কখুস্ক,গায়ের টসটসা দুধে আলতা রঙ বদলে উজ্জ্বল শ্যামলা হয়ে গেছে।চোখের চাহনি কিছুটা বিচলিত,কিছুটা উদ্ভ্রান্ত। আগের চাহনি ছিলো কঠিন আর অভিজাতপূর্ণ।হ্যাঁ, অর্থবিত্ত চোখের চাহনিও পরিবর্তন করে দেয়। 

ভিনা হাফসা কে দেখে অপলক তাকিয়ে আছে।হাফসা কে এরূপে দেখে অভ্যস্ত নয়।উঠে দাঁড়িয়ে সোজা হাফসার কাছে গিয়ে হাত ধরে এনে নিজের পাশে বসালো। হাফসা নিষ্প্রাণ ভাবে তাকিয়ে থাকলেন।এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

-কেমন আছিস মা?কতদিন পর তোকে দেখলাম।

-আছি ভালো আন্টি।

ভিনা কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে পারলো না।কারণ সবকিছুই দৃশ্যমান।

-আমাকে মাফ করে দিস,অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম তোকে।আসলে তোকে দেখতে ইচ্ছা করলেও,সামনে আসতে ইচ্ছা করছিলো না।তাই আসিনি আমি।

-আপনাকে মাফ করার আমি কে আন্টি?আপনি কি জেনেশুনে করেছিলেন?একজন মা হিসেবে যা করার তাই করেছিলেন।

হাফসা কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেললেন।একদম অন্যমনস্ক হয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।নওমি অতল আশাহীনতা নিয়ে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।জীবনের একমাত্র ঢাল এই মানুষটার অবস্থাও শোচনীয়। কে বাঁচাবে এই কঠিন পৃথিবী থেকে ওকে?এত অসহায় অবস্থায় কেন ফেললেন সৃষ্টিকর্তা?

ভিনা জানে হাফসার এই মানসিক অবস্থা পাগলামি না,মানসিক অসুস্থতাও না।এটা হলো খুব বড় ধরনের ট্রমার প্রতিক্রিয়া।কাছের মানুষের কাছে চরমভাবে বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণা,যুবতী মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভার,ভালোবাসাহীন,আশ্রয়হীন দুঃস্বপ্নের মত জীবনের নিকৃষ্ট রূপের সম্মিলিত আঘাত সামনে বসে থাকা মানুষটা নিতে পারেনি,বস্তুত কেউই পারবে না।ভিনার অনেক মায়া হলো হাফসা কে দেখে।কোনো শত্রুর ও যেন এই দিন দেখতে না হয়।আর্থিক অস্বচ্ছলতা মেনে নেয়া গেলেও,প্রতারণা মেনে যায় না,আরো মেনে নেয়া যায় না,যদি সে হয় নিজ সন্তানের পিতা এবং স্বামী নামের মানুষ।প্রায় অনেক্ষণ সবাই চুপ থাকার পর হাফসার ঘোর ভেঙ্গে গেলো।উনি আবার স্বাভাবিক,কিন্তু ভয়াবহ বিষন্ন চাহনী নিয়ে কথা চালিয়ে গেলেন।এর মাঝে নওমি চা,টোস্ট বিস্কিট আর চানাচুর নিয়ে এলো।চানাচুর কেমন যেন মোতে গেছে।নওমি হয়ত সেটা প্রথমে খেয়াল করেনি,এবং পরে খেয়াল করার পর ভীষণ লজ্জায় পরে গেলো।ভিনা চা আর টোস্ট বিস্কিট খেলো,খুব আগ্রহ নিয়ে,এবং প্রায় সম্পূর্ণ ঘুরে হাফসার সাথে কথা বলতে লাগলো।নওমি এই ফাঁকে চানাচুর রান্নাঘরে রেখে আসলো,আসার সময়ে চোখ মুছে এলো।

ভিনা চা খেলো খুব তৃপ্তি নিয়ে।নওমি যে ধীরে ধীরে পাকা রাধুনি হয়ে যাচ্ছে,সন্দেহ নেই।যেই মেয়ের আগে বাইরের মুখোরোচক দামী খাবার ছাড়া চলতো না,সে এখন হাত পাকা করে ফেলছে রান্না করে। দিন এভাবেই বদলায়!সেই আহ্লাদি মেয়েটা এখন শক্ত হাতে নিজের মা কে সামাল দিয়ে ঘর সংসারের হাল ধরছে,খরচপাতির চাপা হিসাব করছে।

হাফসা ভিনার আনা ফলমূল আর খাবার দেখে অবাক হলেন।

-এতকিছু কেন আনলি?

-আপনার জন্য এনেছি আন্টি।এতদিন পর দেখা।আপনি আগে কখনোই আমাদের বাসায় খালি হাতে আসেননি।এবার প্রথমবার আমার সুযোগ হয়েছে,আমি কীভাবে খালি হাতে আসি?

-আগের কথা মা.....

-কিছু বদলায়নি আন্টি।না আপনার স্নেহ বদলেছে,না নওমির ভালোবাসা।তাহলে কী বদলালো?কিছুই না।সব এক আছে।

-না রে,কিছুই এক নেই।

হাফসা আবার হারিয়ে গেলেন অন্য জগতে।নওমি সোফায় হেলান দিয়ে ক্লান্তভাবে বসে আছে।এই বাসাটা অনেক বিষন্ন লাগছে।মানুষের বিষন্নতা বস্তুতেও প্রভাব ফেলে।ভিনার এ বাসার প্রতিটা জিনিস অনেক বিষন্ন লাগছে,কেমন কালচে আর মন খারাপ।সামনে রাখা প্লেট,গ্লাস,টেবিল,চেয়ার সবকিছু কেমন যেন গুমোট।

এই নিশ্চুপ পরিবেশে ভিনা নিজের ভাবনায় হারালো।হাফসা এই প্রথম ভিনাকে তুই করে বলছে।ভিনা জীবনে কাছের বিভিন্ন মানুষের থেকে 'তুই' শব্দটা শুনেছে।একটামাত্র শব্দ,অথচ এর অর্থের পরিধি কত বড়। কেউ প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে তুই বলেছে,কেউ অসম্ভব ভালোবাসা নিয়ে।তুই হলো শব্দভান্ডারের আলুর মত।সব ধরনের মানুষের সাথে,সব ধরনের সম্পর্কের সাথে,সব ধরনের অনুভূতি প্রকাশে সক্ষম।

ভিনা আবার বাস্তবে ফিরে এলো।এখনো হাফসা ধ্যানে মগ্ন,আর নওমিও জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।এই নীরবতা ভাঙা দরকার।কেন যেন ভিনা এখন আর নীরবতা সহ্য করতে পারেনা।

-বিড়াল গুলো কই রে নওমি?

-একটা ঐ ছোট ঘরে আছে,আরেকটা ছাদে।

-দুইটা নিচ্ছি কিন্তু।

-হ্যাঁ, সমস্যা নেই।মিনি আমার সাথেই থাকবে।আর বাকীগুলোকে এ্যডোপশনে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি।সমস্যা নেই। 

-আয় দেখি।খামচি দিবে না তো।

-না,আস্তে করে কোলে নিবি।আর প্রাণিরা মানুষ চিনে আমাদের চেয়ে বেশি।তোকে খামচি দিবে না,শিওর থাক।

ভিনা নওমির সাথে ভেতরের রুমে গেলো।সেখানে দেড় মাস বয়সী বিড়ালের ছোট সাদা খয়েরি বাচ্চা।নওমি চুকচুক করে ডাক দিতেই পায়ের কাছে এসে পরলো।এরপর নওমি কোলে নিয়ে মাথা হাত বুলিয়ে দিলো,এরপর ভিনাকে ইশারা করলো কোলে নেয়ার জন্য।ভিনা খুবই সাবধানে আলতো করে কোলে নিলো।নওমির মতই আঙ্গুল দিয়ে মাথায় আলতো করে আদর দিলো,এবং সত্যিই,সেই ছোট বাচ্চা কিছুই করলো না।ভিনাকে ছোট ঘরে রেখে নওমি গেলো ছাদ থেকে মাঝারি বিড়ালটা আনতে গেলো।ভিনা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই পুরো ঘরে চোখ বুলালো।এই ঘরে কোনো আয়না নেই।একটা আলমারি,ওয়ার্ডরোব, সিঙ্গেল বেড আর পড়ার টেবিল রাখা।পড়ার টেবিলের উপর বই খাতা নেই,আছে শুধু ছোট দুইটা পার্স ব্যাগ,হিসাবের টালি খাতা,মেডিসিন বক্স,ডাক্তারের ফাইল,সিরাপের বোতল,কেঁচি,একটা খাপ ছাড়া কলম,ছোট কীপ্যাড মোবাইল।আর এই ঘরে কোনো একটা ছোট জানালা আছে,কিন্তু এর সাথেই লাগোয়া অন্য বাড়ির রান্নাঘর।ধোঁয়া আর মশলার ঝাঁজ ছাড়া কিছুই আসে না।নওমি আসার আগেই ভিনা নিজের ব্যাগ থেকে টাকা ভর্তি খাম নওমির টালি খাতার মাঝখানে রেখে দিলো।খামের মাঝে চিঠি আছে যেটায় স্পষ্ট লেখা এটা কোনো অনুগ্রহ নয়,এটা বোন হিসেবে দায়িত্বের ছোট অংশ।ভিনা শব্দচয়ন ভালো জানে।নিজের অনুভূতিকে খুব সহজেই শব্দ দিয়ে প্রকাশ করে ফেলে।আর এই অনুভূতি বিশুদ্ধ হওয়ায়,নিজের লেখার উপর পূর্ণ আস্থা আছে। 

নওমি আরেকটা বিড়ালকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসলো নিচে।এটা পুরো সাদা এবং মাথার দিকে কালো।একটু সময় নিয়ে আদর করার পর এটাও ভিনার কোলে উঠলো শান্তভাবে।ভিনা আশ্বস্ত হলো,বাসায় যাওয়ার পথে কোনো সমস্যা হবে না।

-এখনই চলে যাবি?

-না,আন্টির হাতে ডিম ভুনা খেয়ে যেতে ইচ্ছা করছে।আমার এক ঘন্টার মধ্যে বের হতে হবে।যদি ফর্মালিটি করে বেশি আইটেম বানাতে যাস,আমি কিন্তু খেতে পারবো না।আমার আমার টাইম লিমিটের মধ্যে বেশি সময় থাকতে চাই তোদের সাথে।

নওমি খুশিমনে রান্নাঘরে দৌড় দিলো।যাওয়ার আগে হাফসাকে ডেকে নিয়ে গেলো।ভিনা দেখলো,হাফসাকে পাশে দাঁড় করিয়ে নওমি রান্না চড়াচ্ছে।স্বাভাবিক,হাফসার যে মানসিক অবস্থা,এই অবস্থায় রান্না করা সম্ভব নয়।কারণ উনি দিনের বেশিরভাগ সময় বর্তমানে থাকেন না।তবুও নওমি তাকে পাশে রাখলো।

ভিনার বন্ধু সংখ্যা খুবই সীমিত।এই ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই ভিনা ভীষণ চুজি।এতে খুব মশলাদার আড্ডা বা হ্যাংআউট থেকে বঞ্চিত হলেও,পেয়েছে কিছু সোনার মানুষ।নওমি আবেগে ভুল করে ফেলেছিলো ঠিকি,কিন্তু মানুষ হিসেবে তাকে চিনে নিতে ভিনা ভুল করেনি।আজকের এই নওমি,ভিনাকেই জিতিয়ে দিলো আবার।

দুপুরে হাফসা আর নওমির সাথে ভিনা খুব তৃপ্তি নিয়ে গল্প করতে করতে দুপুরের খাবার খেলো।যাওয়ার সময় নওমি একটা সুন্দর বাস্কেটে বিড়াল দুটোকে ভরে ভিনার হাতে দিলো।এত টানাটানির মধ্যেও নওমি ঠিকি বাস্কেটের ব্যবস্থা করেছে যেন ভিনার সুবিধা হয়।ভিনা চলে যাওয়ার আগে হাফসা আর নওমি দুইজনকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদলো অনেক।আজকে এরা ঢাকায় থাকলে ভিনা প্রতি সপ্তাহে আসতো এখানে।নওমি এক সপ্তাহ পর চলে যাবে ভাবতেই ভিনার ভেতরে কামড় দিলো কী যেন।কেন প্রিয় মানুষগুলোকে সবসময় দূরেই যেতে হয় সবসময়?ভিনা এই এক সপ্তাহ হাতে থাকলেও এই বাসায় আর আসবে না,কারণ যতবার আসবে,ততবার মায়া বাড়বে।আর ঐ খাম পাওয়ার পর,ভিনা ইচ্ছা করেই নওমির সামনে আর আসবে না।ভিনা চায় না ওর ভালোবাসাকে কেউ অনুগ্রহ বা দয়া মনে করুক।এটা ভালোবাসা,একদম বিশুদ্ধ ভালোবাসা।এখানে বিন্দুমাত্র কোনো ঔদ্ধত্য নেই।

•••••••••••

ভিনা বিড়াল নিয়ে বাসায় আসার পর দেখলো,প্রিতি একটা ঘর পুরো পরিষ্কার করে রেখেছে।সেই ঘরে ক্যাটফুড এবং লিটার বক্স রাখা।সেই ঘরকে ক্যাটপ্রুফ ও করা হয়েছে।

-এনেছিস তিনটাকে?দেখি বাচ্চাগুলা আমার...

ভিনা প্রিতির উৎসাহ দেখে অনেক বেশি খুশি হয়ে গেলো।একদম এটাই চেয়েছিলো সে।

-তিনটা না,দুটো।মিনি কে নওমিই রেখেছে।

-সমস্যা নেই।এতদিন বড় হয়েছে নওমির কাছে,ওর কাছেই ভালো থাকবে।

-সাবধানে নিও,প্রথমেই কোলে নিও না।প্রথমে একটু কথা বলো,মাথায় হাত বুলাও,এরপর কোলে নাও,দেখবা একটুও ঘাবড়াবে না।

প্রিতি চোখেমুখে হাসি নিয়ে বাস্কেট খুললো।

-একটা তো ফ্লাফি বল!আরেকটার চোখ কী মায়াবি!দেখ দেখ,কীভাবে তাকিয়ে আছে.....

ভিনা প্রিতির বাচ্চাসুলভ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো।প্রিতি ঘন্টাখানেক শুধু কোলে নিয়ে আদরই করলো।এরপর নতুন কেনা সুন্দর বাস্কেটে একটা দামী কম্বল কেটে সেলাই করে বিছানা বানিয়ে ফেললো।দুপুরে খেলোও না প্রিতি,এতটা বিভোর ছিলো এই জ্যান্ত পুতুলগুলো নিয়ে।প্রিতি ভিনার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞ হয়ে বললো

-অনেক ধন্যবাদ ভিনা আমার জীবনকে ধীরে ধীরে সুন্দর করার জন্য।

-আরো সুন্দর হবে আপু,এভাবেই হাসতে থাকো।

মুচকি হাসি দিয়ে প্রিতি বললো-

-শোন ভিনা,কালকে ভেটের কাছে যাবো,ভ্যাকসিন দেয়াবো দুইটাকে।ঠিকাছে?

-একদম ঠিকাছে। 

ভিনার খুব ভালো লাগছে।ভালোবাসার মানুষগুলো ভালো থাকলে প্রশান্তি লাগে।এর জন্যই মহান মানুষেরা সবাইকে ভালোবাসার কথা বলেছেন।কারণ ভালোবাসার মানুষগুলোর ভালোথাকা ও নিজেকে ভালো রাখার জ্বালানি। 

••••••••••

রুশান আবার বহাল তবিয়তে ক্লাসের বাইরে অপেক্ষা করছে ভিনার।এই কয়দিন নাকি নওমিকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।এরপর ব্যস্ত ছিলো বিড়াল নিয়ে।রুশান নওমির কাছে ভিনার ব্যাপারে সব জানার পরে শুধু আশ্চর্য হয়েছিলো ভিনার ধৈর্য্য দেখে।এত কিছু হওয়ার পর ও নওমির বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি ভিনা।শুধু তাইনা,ফারজানাও এতকিছু করার পর ভিনা ঐ মেয়েকে কিছু বলেনি।রুশান ভিনাকে ভালোবাসে,এটা যেমন সত্য,সম্মান ও করে এর চেয়ে বেশি,এটা আরো বড় সত্য।ভিনার এই ভারিক্কি, চরিত্রের অসামান্য দিকগুলো,রুশানকে মুগ্ধ করে সবচেয়ে বেশি।এর পরে আসে ভিনার মায়াবি চোখ,অর্থপূর্ণ রহস্যঘেরা চাহনি।

এই কয়দিন রুশান ইচ্ছা করেই ভিনাকে ফোন দেয়নি।কিন্তু আর কত?আজকেও যদি ভিনা রুশানের এই কয়দিন বিরক্ত না করার পুরস্কার স্বরূপ বাইরে খেতে যায় একসাথে?অন্তত এক কাপ কফি?

ভিনার সাথে বন্ধুত্ব খুব ধীরে ধীরে আগালেও,সোহেল,মুনা,চুমকি,মোমেনা এদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠছে খুব দ্রুত।বিশেষ করে সোহেলের সাথে তো খুবই ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে।প্রায়ই দিন কাজ শেষে সোহেলের সাথে গল্প করে ঘরে ফিরে রুশান।এই বয়সে যেখানে নিজের সমবয়সী মানুষদের সাথে বাইরে আড্ডা দিয়ে সবকিছু দাপিয়ে বেড়ানোর কথা,সেখানে এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই মানুষটা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে।শুধু তাইনা,জীবন নিয়ে কতকিছু যে জানা যায় তার ইয়ত্তা নেই।বিশেষ করে তার প্রয়াত স্ত্রী শিউলির ব্যাপারে যে অধীর আগ্রহে বলেন।তাদের ভার্সিটির প্রেম,উত্থান পতন,পারিবারিক ঝামেলা,ভিনার জন্ম,বড় হওয়া সবকিছু!রুশান ভালোমতো জানে,ভিনার এই সৌন্দর্য্যের সূত্র কোথায়।মায়ের শেকড় খুব ভালোমতো নিজের মাঝে গেঁথে নিয়েছে সে। 

সোহেলের সাথে গল্প করে রুশানের বাড়ি ফিরতে দেরি হয় অনেক।কিন্তু সেদিন বাপ-বেটার সম্মিলিত প্রতিবাদে হতবিহ্বল হয়ে জেবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের সামনে মৌন ব্রত পালন করার।এখন রুশানের সাথে রাগ দেখিয়ে কিছু বলেন ও না উনি।এতে অবশ্য রুশানের সুবিধাই হয়েছে,নিশ্চিন্তে রাতে ঘরে ফিরে।যেহেতু অন্যায় কিছু করছে না,তাই যত রাত হোক,ঘরে ফিরতে আর ভয় ও হয় না।ভিনার প্রভাবে জীবনের কত দিক এক্সপ্লোর করার সুযোগ হচ্ছে!

ভিনা ক্লাস থেকে বের হলো ঠিক সময়ে।তবে লেজ বানিয়ে নিয়ে আসলো ফারজানাকে।ফারজানার দিকে তাকাতেই রুশানের মেজাজ চড়ে গেলো।ভিনার অসুস্থ হয়ে যাওয়ার দিন চোখে ভেসে উঠলো,কীভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো এই নির্লজ্জ মেয়ে!

ভিনা ফারজানাকে সাথে নিয়েই রুশানের সামনে আসলো।

-কেমন আছিস?দেখ কাকে নিয়ে এসেছি।

-হুম,দেখছিই তো,ফারজানাকে।

ভিনার ফারজানার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো।রুশান এসবের কিছুই বুঝতে পারলো না।

-থাক থাক রুশান,এত এ্যটিটিউড দেখানো লাগবে না।এমনি দিন তো ফারজানার কথা কত বলিস আমাকে,এখন এরকম ভাব নিস না।

রুশান বিস্ফোরিত চোখে ভিনার দিকে তাকিয়ে আছে।ভিনা টেকনিকালি কোনো মিথ্যা কথা বলেনি,আসলেও ফারজানাকে কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার।কিন্তু সেটা কী,এটা ভিনা ভালোমতো জানে।

ভিনার পাশে ফারজানা লজ্জায় লাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রুশান এখন আন্দাজ করতে পারছে কিছু।

-শোন ফারজানা,এই ছেলে অনেক ভালো।আমরা ছোটবেলার ফ্রেন্ড,তাই আমার সাথে কথা হয় বেশি।আর তুইতো দেখেছিস ই ওকে।আজকে পরিচিত হয়ে নে।ওর নাম রুশান বিন মাহমুদ।

রুশান সৌজন্যের হাসি দিয়ে বললো-

-হ্যালো ফারজানা

ফারজানা তখনি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বললো

-ফারজানা রহমান,নাইস টু মিট ইউ।

বলা বাহুল্য,ক্লাসের সবচেয়ে বদরাগি,মুডি মেয়ে ফারজানা,যে কিনা ছেলেদের সাথে কথা বললেও মেয়েদের চুলচেরা চরিত্র বিশ্লেষণ করে,সেই ফারজানা প্রথম দেখাতেই রুশানের ফেসবুক আইডি আর নাম্বার নিয়ে নিলো।ভিনা পাশে দাঁড়িয়ে এই আদান প্রদানের ব্যাপারটা আরো সহজ করে দিলো ফারজানার জন্য।রুশান দ্বিতীয়বারের মত নিজের হৃদয় শত টুকরো হতে দেখলো।
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp