অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ২১ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


রুশান অনেকগুলো কার্টনের সামনে বসে একটা ডায়রিতে প্রোডাক্টের ডিটেইলস তুলে রাখছিলো।হিসাব নিকাশ শেষ করে যেসব কাস্টমার প্রোডাক্ট হোল্ড করে রেখেছিলো,তাদের ফোন দিয়ে খুব মিষ্টি করে কথা বলে ডিউ পে করার জন্য কনভিন্স করছে।

চুমকি কিছুক্ষণ পরপরই জুস,চানাচুর,বিস্কিট,পানি এসব নিয়ে রুশানের কাছে দিয়ে আসে।কখনো ভাবেনি কাদেরের পরিবর্তে এত সুন্দর আর শিক্ষিত একজন আসবে,বিষয়টায় খুব বিস্মিত চুমকি।এর আগে যখন রুশান এসেছিলো,তখন সেভাবে খেয়াল করে নি,এখন দেখে ভাবছে,কাদের অন্তত কয়েক মাস পরে আসুক।

-তোর আওয়াকাতের বাইরে।

মোমেনার বাজখাই গলায় চুমকির ঘোর ভাঙলো।ইদানিং হিন্দি সিরিয়াল দেখে মোমেনা প্রায়ই কথার মধ্যে আজব ধরনের শব্দ ব্যবহার করে। সেদিন আবার চুমকিকে ধমকানোর সময় 'ইউ শাউট মাউথ' বলে চেচিয়ে উঠেছে।

-কী কন?বুজিনা তো।

-কী মনে করোস আমি বুজিনা?আমার তোর চে বড় মাইয়া আসে,নাতিন ও আসে।এই বয়োসে কী হয়,সবই বুজি।

-কী বুজসেন?

-তুই ঐ রুমে বার বার যাস ক্যান?

-খাওন দিতে যাই।আপনি তো জানেন না,উনার গাড়ি আসে।বড়লোকের পোলা,কামলা খাটতেসে কী জন্যি খোদা মালুম।একটা দাইত্য আসে না আমাগো?

-ওরে খোদা!এ দেহি দরদ এক্কেরে বাইয়া বাইয়া পরতাসে!বড়লোকের পোলা তয় কী এইসব বিস্কিট মিস্কিট খাইবো?তরে পাকনামি কর‍তে কে কইসে?মুনা জানলে তরে ছেইচ্যা হেলাবে নে।আর তোর *চাল* লাগে আমি বুজিনা।

-আমি আপনার চাল দিয়া কী করলাম?খালা দেহেন ভালোমত কথা কন।

-তুই শাট আপ কর।তোর ঐ টোস্ট খাইবো উই?টোস্ট,চানাচুর এডি আমগো লেইগা।মুনা আলাদা কইরা দামি কেক আর ফলের জুশ আনাইসে।আর এই টি পেকের চা কোন হিম্মতে দেস?ভাইজান বাইরের কফি লইয়া আইসে,ওডি দিতে কইসে।

চুমকি চুপসে গেলো।সে আবার দেয়া খাবার ফেরৎ আনতে গেলে মোমেনা হাত টান দিয়ে ধরে বললো-

-ইতনা দরদ ভালো না।

গত মাসে নতুন টিভি কেনা হয়েছে এ বাসায়,আগে শুধু মুনা আর সোহেলের ঘরেই টিভি ছিলো,এখন ড্রয়িং রুমে বেয়াল্লিশ ইঞ্চির টিভি লাগানো হয়েছে।টিভি দেখার অজুহাতে মোমেনার কাজে দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে মুনা।আগে মোমেনা নিজের বয়স, শরীর স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সারাক্ষণ চুমকির সাথে খিটমিট কর‍তো,এর আরেকটা কারণ মুনাকে জানান দেয়া যে সে এত কাজ করতে পারবে না।এমনকি কাজ ছেড়ে দেয়ার ও ইঙ্গিত দিয়েছিলো মোমেনা। কিন্তু গত মাসে টিভি লাগানোর পর দৃশ্যপট পাল্টায়।মোমেনা জলদি করে কাজ শেষে টিভির সামনে বসে,একেবারে রাতে যেয়ে উঠে।মুনা কিছু বলেনা,কারণ ওদের ও তো বিনোদনের দরকার আছে।মোমেনা অনেক কম বয়স থেকেই বাসা বাড়ির কাজ করে।এর মাঝে আবার স্বামী সন্তান নিয়ে সংসারের দায়িত্ব! তাকে বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় আবার তার স্বামী অন্য বিয়েও করে চলে গেছে অন্য জায়গায়।দুই ছেলে মেয়ে সারাজীবন কষ্টই করে গেছে মোমেনা,নিজের জন্য সময় বের করতে পারেনি।এখন মেয়ের বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে গেছে,ছেলে মাদ্রাসায়, নিজেরো বয়স হয়েছে।তাই ছুটা বুয়ার কাজ বাদ দিয়ে বান্দা কাজ নিয়ে নিয়েছে এ বাসায়।এখানে তার আনন্দের একমাত্র উৎস সেই টিভি।

মোমেনার টিভির প্রতি ঝোঁক থাকলেও চুমকির নেই।বরং চুমকি একটু অন্যরকম।শুরুর দিকে মুনার মা লতিফার কথায় ভুল করলেও,এখন সেগুলো নিয়ে খুব অনুশোচনায় ভোগে। গ্রামের হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসলেও,চুমকি স্বপ্ন দেখে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।নিজের মা আর অন্য দশজনের মত অভিশপ্ত জীবন ও চায় না।ভিনার মত শিক্ষিত হতে চায়।চুমকির পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে ভিনা ওকে বেশ কয়েকটা বই কিনে দিয়ে গেছে।যতদিন এ বাসায় ছিলো সন্ধ্যার পর ভিনা পড়তে বসাতো চুমকিকে।মাথা ভালো থাকায় অল্প কয়দিনেই অনেক পড়া এগিয়েছিলো।এখন ভিনা না থাকায় বেশ ঝামেলায় পরে গেছে।মুনা প্রায়ই দেখিয়ে দিলেও,মাহভিনের কারণে সময় করে উঠতে পারে না।

গত সপ্তাহে রুশান যখন এ বাসায় এসেছিলো,কাদেরের কাজগুলো দেখার জন্য,তখন ভিনা রুশানকে বলেছিলো,সময় পেলে চুমকিকে যেন পড়া দেখিয়ে দেয়।রুশান ভিনার কথা রেখেছে,চুমকিকে পড়াশোনায় শুধু সাহায্য করে নাই,টিউশনি করেছে রীতিমতো। কাজ শেষে দেড় দুই ঘন্টা পড়িয়েছে।রুশানের এই গুণ সবার চোখে পরে,সেটা হলো কোনো দায়িত্ব দেয়া হলে সেটা পার্ফেক্টলি পালন করে,কোনো খুঁত রাখেনা।সপ্তাহ খানেকেই চুমকি এখন বানান করে কবিতা পড়তে পারে।

চুমকি জানে ওর জীবনের পরিধি কতটুকু।তাই রুশানের প্রতি ভালো লাগা যে অবাস্তব, তা জানে।কিন্তু রুশানকে শ্রদ্ধা করে অনেক।একজন মানুষ নিঃস্বার্থ ভাবে ওকে সাহায্য করছে।এছাড়াও,মানুষ হিসেবে খুবই ভালো,যখন পড়ায়,মাথা নিচু করে নিরাপদ দূরত্ব রেখে ড্রয়িং রুমেই পড়ায়।তাকে ডাকে আপু বলে।শিক্ষার্থী ছাড়া চুমকির যে অন্য কোনো পরিচয় আছে,সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।এমন একজনের জন্য শ্রদ্ধা তো আসবেই।তবে নিঃস্বার্থ ব্যাপারটা নিয়ে চুমকি একটু দ্বিধায় আছে,কেন যেন মনে হয় রুশান এমনি এমনি এত কষ্ট করছে না।কী কারণ,সেটা জানার চেষ্টা করবে অবশ্যই। 

গত সপ্তাহে লাইব্রেরিতে ভিনার সাথে কথা হওয়ার পরই রুশান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো,যেভাবেই হোক,ভিনার সাহায্য করা লাগবে।সুযোগের সদ্ব্যবহার কর‍তে সময় নষ্ট করেনি একটুও।

-ইউ ক্যান হেল্প?রুশান,হ্যাভ ইউ লস্ট ইওর মাইন্ড?

-প্লিজ ভিনা।আমি কাদের ভাইয়ের জায়গায় কাজ করতে চাই।

-আমি তো করতে দিবো না।

-কেন?কী সমস্যা?দেখো,আমাকে একদিন সময় দিলেই আমি কাজের ব্যাপারটা পুরো বুঝে যাবো।আমাকে ভরসা করতে পারো,তোমার জিনিস আমি মারবো না।

-শাট আপ রুশান!আমি কখন বললাম তোকে এসব?

-তাহলে কী সমস্যা?প্লিজ ভিনা।রুদমিলা ম্যাম সম্পর্কে আমিও অনেক শুনেছি।

রুশান আন্দাজে ঢিল মারলো।

-তুই?কী শুনলি?

-ম্যাম নাকি আসলেই অনেক স্ট্রিক্ট।আগের ইউনিভার্সিটিতে অনেক স্টুডেন্ট কোর্স রিটেক নিয়েছে উনার জন্য।অনেক হ্যাসেল করে।

ভিনার চেহারা মলিন হয়ে গেলো।শরীর খারাপ হয়ে হস্পিটালে থাকার জন্য অনেকদিন লস হয়ে গেছে।দুইটা কুইজ,একটা মিডে মিস হয়ে অবস্থা করুণ।এর উপর সোহেলের উপর সব চাপ এসে পরায় নিজেকেই অপরাধী লাগে।ভিনা নিশ্চুপ থাকলো।মাথা কাজ করছে না।

-ভিনা,কিছু বলো।প্লিজ।

-তুই কাদের ভাইয়ের কাজ করবি?সিরিয়াসলি?

-প্রমিস!

-কাদের ভাইকে প্রতিমাসে পে করা হতো,তোকেও করা হবে।এই শর্তে রাজি থাকলে,আমি ভেবে দেখতি পারি।

ভিনার আত্মসম্মানবোধ দেখে রুশান অবাক হলো।ভাবেওনি ভিনা এমন কিছু বলবে।ভিনার প্রতি মুগ্ধতার পারদ আরো দিন দিন উপরে উঠছে এই কারণেই।

-আমি রাজি। তোমাকে হেল্প করাটাই আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট। 

-আমি বাবার সাথে কথা বলে নেই।এরপরে ফাইনালি জানাবো।

রুশান রাজি হওয়ার পর ও ভিনা সরাসরি সিদ্ধান্ত জানালো না।হুট করে রুশানকে কাদেরের জায়গায় নিয়ে আসাকে সোহেল ইজিলি নিবে নাকি,সেটা আগে পরখ করে দেখতে হবে। তাই একদিন সময় চেয়ে নিলো রুশানের কাছ থেকে।

বাসায় এসে প্রিতিকে সব খুলে বলার পর প্রিতি বললো,

-আঙ্কেল রাজি হয়ে যাবে,দেখিস।

-বুঝলে কীভাবে?আমার তো মনে হচ্ছে না।বাবা অন্যভাবেও নিতে পারে।

-নিবে না।

-এত শিওর কীভাবে তুমি?

-কারণ তোর চেয়ে আমি দুনিয়া বেশি দেখেছি।

ভিনা হাসলো। ভিনা নিজেও চায় সোহেল ইজিলি নেক এই ব্যাপার।এতে তার নিজের উপর ও চাপ কমবে।সোহেলকে এত কষ্টে দেখে ভিনা ভীষণ মানসিক চাপে ভুগছে।

সোহেলকে ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়ার পর বেশ সময় নিয়ে ইতস্তত করে জানালো রুশানের কথা।
ভিনা একদম চমকে দিয়ে সোহেল বললো-

-ছেলেটা এত ভালো!সেদিন হস্পিটালে দেখেই বুঝেছিলাম,অন্যরকম এই ছেলে।

-তার মানে....তোমার সমস্যা নেই?

-সমস্যা বলতে,এভাবে কাজ করবে ভেবে খারাপ লাগছে।কিন্তু এত আগ্রহ যখন দেখিয়েছে, না করিস না।আসতে বলিস ওর সুবিধামত।

-ঠিকাছে।আমি তোমার নাম্বার দিয়ে দিবো।বাবা আরেকটা কথা....

-বল মা...

-আমি আসি রুশানের সাথে?ও কি বুঝবে এসব ব্যবসা?

-না মা...তোর পড়াশোনায় মন দে।এত আসা যাওয়া করলে ক্ষতি হবে তোর। তুই সব বাদ দিয়ে পড়াশোনা কর।এসব জিনিসে মাথা ঘামাস না।রুশান তো আছেই,দেখে নিবে।

-আমার চাইতে ওর উপর ভরসা বেশি?

-না,ওর চাইতে তোর জন্য ভালোবাসা বেশি। আমি চাই আমার মেয়ে সহজ সুন্দর জীবন পাক।

-বাবা,কিন্তু.....

-আমাকে কথা দিয়েছিলি... 

-ঠিকাছে বাবা।

ভিনা কখনো ভাবেনি,সোহেল এত লিবারেল আচরণ করবে।এত পরিবর্তন! কীভাবে?

পরদিন রুশানকে জানাতেই খুশিতে ভিনার হাত নিজের দুই হাতে নিয়ে বললো-

-থ্যাংকিউ সো মাচ ভিনা!তুমি আমাকে ভরসা করেছো,আমার অনেক ভালো লাগছে।

-রুশান,এটা অনেক বড় কোনো চাকরি না।

-অনেক বড় চাকরি ভিনা।এখান থেকেই আমার প্র‍্যাক্টিকালি শেখার সময় শুরু হলো।আর ফ্রি তে কাজ করছি না তো,আমাকে পে করা হবে।

-বাবার নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি,তুমি তার সাথেই যোগাযোগ করো।

সোহেল নিজেও চেয়েছিলো রুশানের সাথে তার কথা বলার সুযোগ হোক।সেদিন হস্পিটালে ভিনার জন্য যে পরিমাণ খাটা খাটনি করেছে,সোহেল একরকম বুঝেই গেছে,রুশানের দিক থেকে এই সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বের না।সে নিজেও একসময় ভালোবেসেছিলো,প্রেমিকদের চোখ দেখেই বুঝতে পারে তাই।ভিনা যে বড় রকমের আঘাত পেয়ে জীবন থেকে একদম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে,সোহেল সেটা জানে,এবং মনেপ্রাণে চাচ্ছে,কেউ এসে তার মেয়ের ভুল ধারণা ভেঙে জীবন গুছিয়ে দেক।সে কেউ যদি রুশান হয়,তার কোনো আপত্তি নেই।

রুশান ঐদিনই সন্ধ্যায় চলে গেলো ভিনার বাসায়।সোহেলের সাথে আলোচনা করে সব জেনে নিলো।এরপর ওখানে বসেই কাগজে লিখে প্ল্যান করে ফেললো আগামী এক সপ্তাহর কাজ। প্রতিদিন ভার্সিটি শেষ করে বিকালে এ বাসায় এসে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত থাকে রুশান।কাজ শেষ করে চুমকিকে পড়িয়ে এরপর বাসায় যায়।বাসায় যেয়ে দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে শুরু করে ভার্সিটির পড়াশোনা আর এসাইনমেন্ট করা।পরিশ্রম ভীষণ হলেও,তৃপ্তি কাজ করে রুশানের মাঝে।ভিনার পরিবারের সাথে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে এর চেয়ে বড় কী হতে পারে।
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp