অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ২৬ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


রুশানের প্রচন্ড রাগ লাগছে। নিজের ঘরের সবকিছু এলোমেলো করে ফেলে রেখেছে।শখের গিটারের স্ট্রিংগুলো ছেঁড়া।রেহান একদিন বলেছিলো,মেয়েরা গিটার বাজাতে পারে,এমন ছেলেকে পছন্দের তালিকায় উপরে রাখে।সেই তত্ত্বে অন্ধবিশ্বাস রেখে রুশান দামী এ্যকুস্টিক গিটার কিনেছে।রেহানেরই কাছের বন্ধু সিয়ামের কাছ থেকে গিটার বাজানো শিখছিলো।উদ্দেশ্য একটাই,ভিনাকে নিজের এই গুণে মুগ্ধ করা।কিন্তু ঐ মেয়ে কী করলো এটা?

বাসায় আসার পর আবার ভিনা মেসেজ ও দিয়েছিলো।

-ফারজানা কিন্তু তোকে পছন্দ করে।আগের ঘটনা দিয়ে জাজ করিস না,জেলাসি থেকে এমন করেছে আমার সাথে।আর করবে না এমন।তুই কিন্তু মিসবিহেভ করবি না।ভালোমতো কথা বলিস।আর মেয়ে কিন্তু পর্দানশিন,আগের কোনো পাস্ট ও নেই।একদম ওয়াইফ ম্যাটারিয়াল!

মেসেজ দেখে রুশানের প্রচন্ড রাগ এবার চাপা কান্নায় পরিণত হলো।খুব চেষ্টা করছে নিজের চোখের পানি আটকে রাখার,নিজেকে খুব ছোট এবং কাপুরুষ মনে হচ্ছে।যেসব ছেলেরা কাঁদে,ওরা হলো কাপুরষ।এরকম অদ্ভুত স্টেরিওটাইপ মাথায় নিয়ে ঘুরছে রুশান।ভিনা কি জানে,নিজের অজান্তে রুশানকে অপমান করেছে ও?নাকি জেনেশুনেই অপমান করেছে?আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ধিক্কার দিলো রুশান।ঘটনা খুবই ছোট,কিন্তু আত্মসম্মানে গিয়ে লাগছে অনেক।সেন্সিটিভ প্রকৃতির মানুষগুলোর কপালই এরকম!

ভিনার মেসেজ দেয়ার পরই ফারজানার মেসেজ আসলো।

-কেমন আছো রুশান?আমি ফারজানা।কালকে ফ্রি আছো?পড়া নিয়ে কথা বলতাম ক্যাফেটেরিয়ায়। 

ফারজানা ইকোনমিকস এ পড়ে,রুশান পড়ছে ইঞ্জিনিয়ারিং।পড়া নিয়ে কী কথা বলবে এই মেয়ে।অজুহাতের ও তো একটা ছিরি থাকা দরকার।

রুশান সিদ্ধান্ত নিলো,ভিনাকে জানিয়ে দিবে,এই ফারজানার সাথে ও কথা বলতে পারবে না।তখনি খেয়াল করলো,অচেনা নাম্বার থেকে বারোটা মিসড কল এসেছে।কল ব্যাক করতেই রেহান চেঁচিয়ে উঠলো।

-ইউ ***! ফোন ধরিস না কেন?

-ভাইয়া?তুমি বাংলাদেশি নাম্বার কোথায় পেলে?

-এয়ারপোর্টে আয় ছাগল!

-তুমি এসে পরেছো?!

-শাউট করিস না রে গাধা,বাবা যেন না জানে।মা তো অবশ্যই না।

এক মিনিট ও দেরি না করে রুশান বাসার জামা পরেই রওয়ানা হলো এয়ারপোর্টে।এয়ারপোর্টে রেহানকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

-তুমি আসছো তাহলে!আই কান্ট বিলিভ আই ক্যান টাচ ইউ ইন রিয়েল।

-অনেক মিস করেছিস?

-আসলেই অনেক মিস করেছি তোমাকে।

-কাউকে বলিস নি তো?

-না,কিন্তু সরাসরি বাসায় আসলে সবচেয়ে ভালো হতো।এভাবে বের হয়েছি,মার কিছুটা খটকা লাগবেই।

-লাগুক।আই ডোন্ট কেয়ার।আমরা একসাথে কিছুক্ষণ ঘুরে,এরপর বাবার অফিসে যাবো।

-ওখানে কেন?

-কারণ বাবা এখন অফিসেই থাকবে।

-একটুও ফিল হচ্ছে না তুমি বাইরে থেকে এসেছো।মনে হচ্ছে তুমি বাসা থেকেই বের হয়েছো কোথাও।বুঝলে কীভাবে বাবা অফিসে?

-কারণ বাবার সংসার ঐ অফিসেই।

-এখন সরাসরি ওখানেই চলো,আর কী ঘুরবা?রেস্ট নেয়া দরকার।

-না,কতদিন পর দেশে আসলাম।অন্যরকম লাগছে।এমনিই একটু ঘুরে দেখি রাস্তাঘাট।

-কতদিনের জন্য আসলে ভাইয়া?মনে হচ্ছে জলদিই ফিরে যাবা,আসলেই তাই?

-ফিরছি না আর।

রুশান বিশ্বাস করতে পারছে না যা শুনেছে।বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে রেহানের দিকে।

-ভাইয়া?প্লিজ টেল মি ইউ আর নট জোকিং।

-আই এম নট।

রুশান খুশিতে চিৎকার দিলো।রেহানের পেটে ঘুষি দিয়ে বললো

-আমাকে জানালে না কেন তুমি?

-তোকেও সারপ্রাইজ দিলাম।

রুশান চোখের পানি মুছে বললো-

-থ্যাংকস ভাইয়া।অনেক দরকার ছিলো তোমাকে।

-কী হয়েছে তোর?মন খারাপ কেন?

-বলবো সব।অনেক কিছু বলার আছে।কিন্তু তার আগে বলো কোথায় যাবে?

-টিএসসি।

-টিএসসি?

-হ্যাঁ। নাবিহার সাথে ওখানেই আমার দেখা হয়েছিলো।ওখানে বসেই কথা হতো।নাবিহা আর আমার অস্থায়ী সংসার ছিলো ওখানে।

-এত ভালোবাসো,তবুও তো আপু চলে গেলো।কেন এমন হয় ভাইয়া?মানুষ ভালোবাসার মূল্য কেন বুঝে না?

-যখন এই ঘটনা ঘটলো,তখন তোর বয়স কত ছিলো?

-পনেরো। 

-এর জন্যই।চুনোপুটি ছিলি,মেইন ঘটনা কিছুই জানিস না।

-কী ঘটনা?মা তো শুধু বলেছিলো আপু নাকি এসেছিলো তোমার সাথে,এরপর তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।পরে তো আপু অন্য জায়গায় বিয়ে করলো।

-সিরিয়াসলি?মা এসব বলেছে তোকে?

-হ্যাঁ,আর তোমাকে এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে মানা করেছে,কারণ তুমি আপসেট হয়ে যাও।তাই আমি আর জিজ্ঞেস ও করতাম না। 

-দ্যাটস হোয়াই আই ডোন্ট লাইক হার।

-বুঝতে পেরেছি,ঘটনা অনেক বড়।

-নামি,এরপর বলবো সব।

টিএসসি তে পৌঁছে ড্রাইভারকে নিউমার্কেটের সামনে গাড়ি পার্ক করতে বলে রেহান নামলো।

নেমেই রোকেয়া হলের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো।কত পরিবর্তন হয়ে গেছে সব।আগে প্রায়ই হলের সামনে এসে অপেক্ষা করতো নাবিহার জন্য।নাবিহা বেশ বিরক্তি দেখালেও রেহান টের পেত এই হটাৎ করে আসা পছন্দ করে খুব।রুশান পেছন থেকে রেহানের কাঁধে হাত রাখলো।

-চলো আমরা কোথাও বসি।

রেহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিএসসির চায়ের দোকানের সামনে বসলো।নানাধরণের চা এখানে বিক্রি হচ্ছে।মাল্টা,মরিচ,তেঁতুল চা।রুশান অতি আগ্রহ নিয়ে মাল্টা আর মরিচ চা অর্ডার করলো।রেহান ধমক লাগালো।

-এসব কী রে?চা তো চাই।এসব মাল্টা ফাল্টা কী?চা দুই রকমের হয়,রং চা,দুধ চা।আর যা ভ্যারাইটি আছে এই দুইটার মধ্যেই আছে।বাকীগুলা চায়ের জাতই না।নে দুইটা দুধ চা নে।

রেহানের ধমক খাওয়ার পর রুশান ভেবে দেখলো,কথা ভুল বলেনি রেহান।

চা হাতে দুই ভাই রাতের আকাশের নিচে স্বপ্নময় চোখের যুগলদের দেখছে।রেহানের বুক খালি লাগছে ভীষণ,এই কষ্ট চোখ সিক্ত করে ফেলছে।রুশান মনে মনে ভাবলো এ জায়গায় আসা উচিৎ ই হয় নি।দেশে আসতেই রেহানের মন খারাপ হয়ে গেলো।একটু জোর খাঁটিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেই ভালো হতো।মনোযোগ অন্যদিকে নেয়ার জন্য রুশান বললো-

-তুমি সরাসরি এসেই তো চমকে দিতে পারতা,তাইনা ভাইয়া?আমাকে সহ বাসায় যাচ্ছো কেন?

-বল তো কেন?

-ধরতে পারলে তো অবশ্যই বলতাম।

-মনে আছে আমি জার্মানে চলে যাওয়ার কয়দিন আগে মা তোকে কী বলেছিলো?

রুশান চোখ অন্যদিকে সড়িয়ে নিলো।রেহান কথাটা এতদিন পরেও যে মনে রাখবে,ভাবে নি।আসলে ভুলে যাওয়ার মত ঘটনাও ছিলো না সেটা।

-মনে আছে....

-এর জন্যই তোকে সহ বাসায় ফিরবো।তার বোঝা উচিৎ,রক্তের সম্পর্কে এসব শয়তানি খাটে না।

তখন রুশান কলেজে উঠেছে মাত্র।নাবিহার সাথে ছাড়াছাড়ির পর রেহান ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলো।সারাদিন ঘরে একা থাকতো।কারো সাথে কথা বলতো না,খাওয়া দাওয়া করতো না ঠিকমত।রুশান পুরো ঘটনা জানতো না দেখে নিজের ভাইয়ের এই আচরণে বেশ অবাক হয়েছিলো।ভাইয়ের প্রতি রুশানের টান ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু জেবা একদিন হটাৎ করেই রুশানকে ডেকে নিয়ে যায়।

-শোনো বাবা,তোমার ভাইয়ার অনেক বড় অসুখ হয়েছে।তুমি যদি তার কাছে যাও,সে তোমাকে হার্ট করতে পারে ফিজিকালি।কিপ এ সেফ ডিস্ট্যান্স।হি উইল বি ফাইন।

নাটকীয়ভাবে এই কথা রেহান শুনে ফেলে।জেবার প্রতি তীব্র ঘৃণার শুরু মূলত সেখান থেকেই।জেবা কেন এটা করেছে,রেহান ভালোমতো জানে।সে চায়নি কোনোভাবে রুশান তার এই অপকর্মের কথা জানুক,তার প্রতি নেতিবাচক কোনো ধারণা সৃষ্টি হোক।অথচ একাকীত্বের সেই সময়ে রেহানের সবচেয়ে প্রয়োজন ছিলো কথা বলার মানুষের।রুশানের তখন বয়স কম।ভাইয়ের ভালো চিন্তা করেই বাইরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত রুশান তাই দূরেই ছিলো।অবশ্য আরেকটা কারণ ছিলো জেবা।ছোট থেকেই জেবাকে ভীষণ ভয় পেত রুশান।অবশ্য বিদেশ যাওয়ার পর এই নিষেধাজ্ঞা রুশান মানেনি।সবার অগোচরেই ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক রেখে গেছে।

-রুশান,তুই যখন আমার থেকে দূরে ছিলি,অনেক কষ্ট হতো আমার।এই একজন মানুষ আমার জীবনের মূল্যবান সবকিছু কেড়ে নিয়েছে,এবং খুব বিশ্রী উপায়ে।আজকে যখন তোকে নিয়ে একসাথে যাবো,আমি শিওর সে বড় ধাক্কা খাবে।এই শক তার জন্য ভীষণ দরকার।

-তখন ছিলাম না,কিন্তু এখন আমি তোমার পাশে থাকবো।আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি ফর হোয়াট আই ডিড।

-ইউ ডোন্ট নিড টু বি স্যরি।

-আই নিড টু।আচ্ছা,নাবিহা আপুর ব্যাপারে কিছু বলতে চাচ্ছিলে....

-বলি।

রেহান আরো দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে একদম শুরু থেকে সব বলা শুরু করলো।কোনো ঘটনার কোনো ডিটেইল বাদ রাখলো না।শেষে বেশ কষ্ট নিয়ে বললো-

-ভ্যাজাইনাল টেয়ার রিপেয়ারের জন্য সার্জারি করতে হয়েছে।এছাড়াও ছিলো অনেক ইঞ্জুরি।আর এইসব কিছু হয়েছে আমার মার জন্য।

রুশান কোনো কথা বলতে পারছে না।পা অবশ হয়ে এসেছে যেন।জেবার এ কোন রূপ দেখলো ও?মায়ের প্রতি ক্ষোভ কাজ করতো অতিরিক্ত শাসনের জন্য,কিন্তু এখন রীতিমতো ঘৃণা হচ্ছে।

-অথচ আমাকে মা এমনভাবে প্রেজেন্ট করেছিলো যে নাবিহা আপুই তোমাকে ডিচ করেছে।আই এম টোটালি শকড!শি ইজ...

-বাদ দে।তোর কথা বল।কী হয়েছে?

-আর কী বলবো..

-ভিনা রিলেটেড?

-হ্যাঁ। ভিনার আমার প্রতি সামান্য পরিমাণ ফিলিংস নেই ভাইয়া।ইভেন ও আমাকে ফ্রেন্ড ও মনে করে না।

-কেন কী হয়েছে?

-ক্লাসে ফারজানা নামের বদমাইশ একটা মেয়ে আছে।ঐ মেয়ে ভিনার সাথে খুবই বাজে ব্যবহার করেছে।পরে শুনি ফারজানা আমাকে পছন্দ করে আর এই জন্য ভিনা ওর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে নাম্বার ও এক্সচেঞ্জ করিয়েছে।

-ওয়াও!কী জোস তো!এমন গার্লফ্রেন্ড কয়টা পাবি যে তোর জন্য মেয়ে খুঁজে দেয়।

-গার্লফ্রেন্ড?ভাইয়া প্লিজ,বি সিরিয়াস।

-মেয়ের পাস্ট আছে?

-হ্যাঁ, আছে....

-ছ্যাকা কে দিয়েছে?ভিনা না ঐ ছেলে?

-ঐ ছেলেই।

-সাব্বাশ!রতন খুঁজে এনেছিস একদম।যে মেয়ের পাস্টে বিট্রেড হওয়ার হিস্টোরি আছে,ঐ মেয়ে ভুলেও সেকেন্ড টাইম একি ভুল করবে না।

-একি ভুল?তোমার কী মনে হয় আমি ভিনাকে ছেড়ে যাবো?নেভার।

-এইসব আমিও অনেক বলেছি।লাভ কী হলো?

-আমি একি ভুল হতে দিবো না।আমি এবার কোনোভাবেই মা কে ক্ষতি করতে দিবো না।ইটস এ প্রমিস।

রেহান সন্তুষ্টির হাসি দিলো।রেহান বিশ্বাস করে,রুশান একবার যখন বলেছে,কথা সে রাখবেই।

-ভিনার বাসায় যাওয়া তো হচ্ছেই,তাইনা?

-হ্যাঁ 

-ওর ফ্যামিলি মেম্বারদের সাথে কথা হয়?

-অনেক ভালো রিলেশন হয়ে গেছে সবার সাথে।বিশেষ করে ওর বাবার সাথে।

-আরে!আমি তো মনে করতাম তুই অনেক ইম্যাচিওর।বাট ইউ আর নট।জায়গামতো কাজ করছিস।

-আঙ্কেল খুবই ভালো মানুষ,অনেক ফ্রেন্ডলিও।

-ভিনার পাস্ট সম্পর্কে ভালোমতো জানিস?কী হয়েছিলো এ্যকচুয়ালি? 

-না,এটা জানি না ঠিক কী কারণে সেপারেট হয়েছিলো।তবে থার্ড পার্সন এসেছিলো ওদের মধ্যে।কিন্তু আরো ঘটনা আছে।

-ঘটনা জানার ট্রাই কর ওর কাছের মানুষগুলো থেকে।শোন,শুরুতেই রিলেশনের জন্য প্রেশার দিস না।আম শিওর ভিনা কোনো বাজে এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়ে গেছে।আগে সেই পুরোনো আউন্ড হিল কর।যদি তুই সত্যি বিশ্বাস করাতে পারিস, ওর জন্য তুই পার্ফেক্ট,এমনিই সব হয়ে যাবে।বি সেল্ফলেস ফার্স্ট।

-আমি এভাবে চিন্তাই করিনি ভাইয়া!থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।কিন্তু এই ফারজানার কী করবো?আই হেট হার!

-নরমালি কথা বলবি।ফারজানার সাথে ভালো বিহেভ কর।ফারজানা নিজেই তোর প্রশংসা ভিনার কাছে করবে।রুড হবি না।

-ডান!

রেহান গল্প শেষ করে সোজা চলে গেলো ফারুকের অফিসে।তখন রাত দশটা বাজে।রেহান ভুল ছিলো না।ফারুক অফিসেই ছিলেন।রেহানকে দেখার পর উনি জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে।বাচ্চাদের মত কান্না শুরু করলেন।

-আমার বাপ!আমার বাপ আমার বুকে এসে গেছে!

রেহানের প্রথমবার নিজের পরিবার থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তের উপর অনুতাপ হলো সামান্য।একজনকে কষ্ট দিতে গিয়ে আরেকজন ভুক্তভোগী হলো।এমনটা তো চায়নি।

বাসায় ফিরে জেবার সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রেহান চলে গেলো সায়বার বাসায়।অবশ্য গাড়িতেই এ ব্যাপারে ফারুক কে জানিয়ে রেখেছিলো।ফারুক বিনা বাক্য ব্যায়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।অন্তত ছেলে দেশেই তো থাকবে!

••••••••••••

ভিনা আজকে রুদমিলার রুমে গিয়েছিলো।মজার ব্যাপার হলো পুরো ভার্সিটি যাকে যমের মত ভয় পায় তার সাথে ভিনার বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়ে গেছে।প্রফেসর রুদমিলা জীবনে খুব সহজ নীতি মেনে চলেন,ভালোর সাথে ভালো,খারাপের সাথে খারাপ।
ভিনার এখন পুরো মনোযোগ দেশের বাইরে যাওয়া নিয়ে।এই বিষয়ে সাহায্য করছেন রুদমিলা।উনি ভিনাকে খুব সুন্দরভাবে গাইড করছেন।যদিও এখন সেকেন্ড সেমিস্টার চলছে ভিনার,তবুও এখনি উনি থিসিস পেপারের উপর কাজ শুরু করতে বলেছেন।পেপার রেডি করে উনাকে দিলেই উনি চেক করে ভুল ধরিয়ে দিবেন।এখন থেকেই পেপার লেখার অভ্যাস থাকলে,এবং গ্র‍্যাজুয়েশন কম্পলিট করতে করতে অন্তত তিন-চার জায়গায় পেপার এক্সেপ্টেড হয়ে থাকলে,বাইরে যাওয়া অনেক সহজ হয়ে যাবে।প্রফেসর রুদমিলা জীবনে খুব কম স্টুডেন্টকেই এরকম ডেডিকেটেড দেখেছেন।সেই তালিকায় ভিনার অবস্থান সবার উপরে।কারণ ভিনা মানুষ হিসেবেও চমৎকার।এই মেয়েকে উনি সত্যিই সফল এবং একইসাথে সুখি দেখতে চান।

রুদমিলার সাথে দেখা করে ক্লাসে যেতেই রিদওয়ান ভিনাকে ডাকলো।

-কেমন আছো রিদওয়ান?জরুরি কিছু?

-হ্যাঁ। আজকে দেখলাম মিস রুদমিলার রুমে গেছো।উনি কি বেশি সমস্যা করছে?

-না না!উনি অনেক ভালো মানুষ। আমাকে অনেক হেল্প করছেন স্টাডিতে।

-কী বলো! সত্যি?

-হ্যাঁ। তুমিও যদি হেল্প চাও,উনি তোমাকেও করবে।এরকম স্কলারের কাছ থেকে সরাসরি গাইডেন্স পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

-আমি ভেবেছি ফারজানার জন্য এখনো ভুগছো তুমি।

-ভুল মানুষেরই হয়।ও ভুল করে দিয়েছে হয়ত।আর দেখো,এই ভুলের জন্য আমার সুবিধাই হয়ে গেলো।আমি যদি রিউমারে কান দিয়ে বসে থাকতাম,কখনো এত চমৎকার মানুষের সাথে পরিচয় হতো না।ইভেন আই এম থ্যাংকফুল টু ফারজানা।

রিদওয়ান মুগ্ধ হয়ে ভিনাকে দেখছে।ভিনার কাছাকাছি থাকলেই কেমন যেন শান্তি শান্তি অনুভব হয়।ক্লাসের একদম শুরু থেকেই ভিনাকে দেখে আসছে,এবং হয়ত সবার থেকে আলাদাভাবেই দেখেছে।

-ইউ আর ডিফরেন্ট ভিনা।

-আগেও বলেছি,আবারো বলছি।আমি আলাদা না।তুমিই উদার।

কথা শেষ করে ভিনা চলে যেতে নিলে রিদওয়ান আটকে ফেললো।

-ভিনা,তুমি এখানে বসতে পারো।তোমার জন্যই সিট রেখেছি।

-আমার জন্য?হটাৎ? 

-আমি প্রতিদিনই দেখি তুমি জায়গা নে পেয়ে পেছনে বসো।আগে ফারজানা সিট রাখতো,এখন তাও রাখে না।তাই ভাবলাম এখানে বসো।এ্যজ এ ফ্রেন্ড,এতটুকু তো করতেই পারি।

ভিনা সামনে তাকিয়ে দেখলো ফারজানা বেশ সেজেগুজে এসেছে।পাশে কোনো সিট রাখা নেই।একমনে ফোনে ঢুকে রয়েছে।

কিছুটা মন খারাপ নিয়েই শেষে রিদওয়ানের পাশে বসলো।যদিও মন পরে রইলো ফারজানার দিকে।কেন এমন করছে?সব তো ঠিকি করে দিলো ভিনা।

••••••••••

রুশান প্রতিদিনের মত আজকেও চুমকিকে পড়তে বসিয়েছে।পড়ার ফাঁকে কথা চালিয়ে যাচ্ছে।

-অনেক খানি আগিয়ে গেছো।কয়দিন পরই গুণ করা শিখাবো।

-হ,ভিনা আপা অনেক খানি আগায়া দিয়া গেসে।আর আপনি তো পড়াইতেসেন ই।

-ভিনা তোমাকে পড়াতো?

-হ,আপা আমারে পড়াইত।আপার মত মানুষ হয়না।আমি কত অন্যায় করসি,হের পরো আমাকে মাফ কইরা দিসে।যাওয়ার আগে দুইখান লিপিস্টিক ও দিয়া গেসে।অনেক দামি ছেলো।

রুশান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো 

-কী অন্যায় করেছো?

চুমকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-

-আপনি তো ভাই মানুষ। আপনারে কইতেই পারি।আসলে আমার নিজেরো অনেক বেশি খারাপ লাগতেসিলো।কাউরে কইবার পারতেসিনা।

-কী হয়েছে?

-আমার কারণে তারে বাসা থেইকা বাইর কইরা দিসিলো।আসলে মুনা খালা আর তার মা মিল্যা আমার মাথা ঘুরায়ে দিসিলো।খারাপ ভালো বুঝি নাই।

-মুনা?মানে মুনা আন্টি,ভিনার মা?

-হ।অবশ্য উনি এহন ভালো হয়া গেসে।এই কাজের লেইগা শাস্তিও পাইসে অনেক বড়,তাই উনার প্রতি রাগ নাই।ভিনা আপারে অনেক ভালোবাসে এহন।তয় উনার মা জল্লাদ একটা।মরণের ভয় ডর ও নাই।

-মানে?কিছু বুঝলাম না।

-ম্যালা বড় কাহিনি।

-ছোট করে বলো।

-মুনা খালা বাচ্চা পেটে আসার পর খারাপ হয়া গেসিলো।মনে করসে ভিনা আপা থাকলে উনার বাচ্চা ভালো থাকবো না।তাই উনি উনার মা মিল্যা আমারে গ্রাম থেইকা আনাইসিলো টেকা দিয়া।পরে ভিনা আপার মিথ্যা বদনাম কইরা খালুরে দিয়া ঘর থেইকা বাইর কইরা দিসিলো।

-মানে!কী বলছো তুমি!

-হ,আপা প্রায় তিন মাস ঘরে আছিলো না।অনেক খোঁজা হইসে তারে।পরে খালু ও জানসে মুনা খালাই এই কাম করসে।আমি অবশ্য ততদিনে চইলা গেসিলাম।

-এরপর?

-মোমেনা খালার থেইকা জানসি মুনা খালার বাচ্চা পেটেই মইরা গেসিলো।পরে তো খালা পাগলের মত হয়া গেসিলো।তখন ভিনা আপা ফেরৎ আসছিলো অবশ্য।ভিনা আপার বোর্ড পরীক্ষার পর মুনা খালা একেবারে পাগল।শেকল পড়ায়ে রাখতো তারে।পরে খালু ভিনা আপারে কই জানি মাস খানেকের জইন্য রাইখা আসছিলো।

-তাহলে মাহভিন?

-কথা দেন কাউরে কইবেন না।কসম লাগে ভাইজান।

-কাউকে বলবো না।

-মাহভিন তাগো নিজের বাচ্চা না।মাহভিনরে দত্তক আনছে।খালু আর ভিনা আপাই এই বাচ্চা আইনা দিসিলো খালার কাছে।

রুশানের মাথা কাজ করছে না।কখনো ভাবতেও পারেনি ভিনার জীবনে এমনও কোনো ঘটনা থাকতে পারে।কতকিছুর মধ্য দিয়ে গেছে এই মেয়ে!এখন রুশান বুঝতে পারছে ভিনা কেন এরকম অনুভূতিহীন। মায়া লাগছে ভীষণ ভিনার জন্য।সেই সাথে হতাশাও ঘিরে ধরছে।এই আঘাতের ক্ষত অনেক গভীর হবে।এই ক্ষত সাড়ানো আদৌ সম্ভব নাকি জানে না।
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp