__প্রাপ্তি আয়ানের মায়ের সেই কথাটা কানে বার বার বাজছে,দ্বিতীয় বার কাউকে মন দিতে গেলে তাকে অসম্মান করে হবে। সেই কারনে আজও সে বিয়ে করেনি।
আয়ান তার মানে আজও আমায় ভালোবাসে? না,না আমি এইসব কি ভাবছি।আমার যে এইসব ভাবতে নেই।
আয়ানেরও চোখে ঘুম নেই,বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে।চোখ বন্ধ করলেই প্রাপ্তির মুখটা চোখের সামনে স্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠে। সেই হাসিটা যেটা আয়ান আট বছর আগে দেখে প্রেমে পড়ে ছিল।আয়ান শোয়া থেকে বসলো।আরিয়া আজ তার দাদীর সাথে ঘুমিয়েছে।মেয়েটাও খুব দুষ্ট হয়েছে।আজ দাদী তার উপর রেগে আছে দেখে দাদীর কাছেই ঘুমাবে।রাতে হয়তো মাকে ঠিক মতো ঘুমাতেও দিবে না।আয়ান কথাটা ভাবতে ভাবতে উঠে এসে বেলকনিতে ইজিচেয়ারটায় বসলো।হেলান দিয়ে বসে বাহিরে চাঁদের দিকে নজর পড়ল তার।অর্ধেক চাঁদটা বেশ পরিষ্কার, তারাগুলো চাঁদের চারপাশে মিটিমিটি করে জ্বলছে।সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে ফোন বাজছে সেই দিকে কোনো খেয়াল নেই।দ্বিতীয়বার বাজতেই উঠে গিয়ে রিসিভ করে,
কিছুক্ষন কানে ধরেই কোনো কথা না বলে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল।
হসপিটাল পৌঁছে শিরিনকে ফোন দিয়ে বলল,নিলিমা বেগম যেন তাকে না দেখে টেনশন না করে।ইমারজেন্সি রোগী আছে তাই চলে আসতে হয়েছে।
রিয়ান এসে,স্যার অপারেশনের সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে আপনি আসার আগেই।আপনার সাথে আছে ডাক্তার সুমনা।
-ওকে,,
অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে আয়ান অবাক হয়ে গেল,
সে কখনো কল্পনায় করেনি এমন কিছু ঘটবে।
সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে সে মানুষটার দিকে যে একদিন,,,,,
সুমনা এগিয়ে এসে রোগীর ফাইল আয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে,স্যার' ইনি পারভীন বেগম সকালেই হসপিটালে ভর্তি হয়েছে।এই ফাইলে ওনার সব রিপোর্ট আছে,আপনি একবার দেখেনিন।
আয়ান নিজেকে সামলিয়ে, রোগীর ফ্যামিলির লোক কোথায়? স্যার তেমন কেউ আসেনি,ওনার ভাই এসেছে বাহিরে কোথাও আছে।
পারভীন বেগম দুইবছর থেকেই হার্টের সমস্যা।দুইবার হার্ট অ্যাটাকও করেছেন।অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন।কিন্তু এইবার হার্ট ব্লক হয়ে গেছে।তিনি যেই ডাক্তার দেখান শামসুল হক।তিনিই আয়ানের হসপিটালে পাঠিয়েছেন।এবং আয়ানের হাতেই ওপেন হার্ট সার্জারি করাতে বললেন।সকালে আয়ান হসপিটাল না আসায় রাতেই অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য বুদ্ধিটা ছিল ডাক্তার সুমনার,সে ভালো করেই জানে যতরাত হয়ে যাক না কেনো ইমার্জেন্সি রোগীর কথা বললে আয়ান না এসে থাকতে পারেনা।
আয়ান সবগুলো রিপোর্ট ভালো করে দেখে সুমনাকে বলল,রোগী ছেলেমেয়ে আসেনি?
-না স্যার, তবে দুপুরে রোগীর সাথে আমার কথা হয়েছে,ওনার একটা মেয়ে আছে তবে সে আসেনি।
ভোর চারটায় আয়ান অপারেশন শেষ করে বেরিয়ে এলো।
সিস্টার মিনুকে ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি হসপিটাল আসতে বলল।
রিয়ান, রিয়ান,
রিয়ান দৌড়ে এসে, স্যার ডেকেছেন?
-আমার গাড়ি নিয়ে যাও, মিনুকে নিয়ে আসো জলদি।
ফজরের আজান শুনে আয়ান হসপিটালের সাথেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে নিলো।
নামাজ পড়ে এসে পারভীন বেগমকে একবার দেখে আসলেন।সুমনা পারভীন বেগমকে একটা স্যালাইন দিয়ে,বাহিরে এসে আয়ানের রুমে ঢুকলো,
আয়ানের সামনের চেয়ারটায় বসে,
-স্যার! আমার কেমন যেন খটকা লাগছে।
আয়ান পারভীন বেগমের ফাইলটা আরও একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন।
সুমনার কথা শুনে সামনের দিকে তাকিয়ে,কোন বিষয়ে?
আমি আপনাকে যত অপারেশন করতে দেখেছি কিন্তু কোনো দিন আপনাকে বিচলিত হতে দেখিনি।আর এই শহরে সবাই কমবেশি জানে, আয়ান মাহমুদ আজ পর্যন্ত কোনো অপারেশনে হেরে যায়নি।সাকসেসফুল হয়েই বাড়ি ফিরেছে।কিন্তু আজ আপনাকে দেখছি অন্য রকম এক আয়ান মাহমুদ কে।
আয়ান সুমনার কথা শুনে মুচকি হাসলেন।কিন্তু কোনো কথা বললেন না।
সুমনা আবার বলতে শুরু করলো,আপনি যত রাতেই অপারেশন করেন না কেনো আপনি অপারেশন শেষ হলে বাড়ি ফিরে যান।কিন্তু আজ আপনি এখনো বসে আছেন।মনে হচ্ছে খুবি চিন্তিত হয়ে আছেন।স্যার প্লিজ বলুন না রোগী কি আপনার স্পেশাল কেউ?
আয়ান এইবার চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে, তোমার মনে আছে সুমনা যেদিন তুমি আমাদের বাড়িতে প্রথম গিয়েছিলে?
অবশ্য তুমি একা যাওনি, তোমার হ্যাজবেন্ড রাফি যে আমার ছোটো বেলার বন্ধু,আর আমার কয়েকজন কলিং।
-হ্যাঁ আরিয়ার জন্মদিনে গিয়েছিলাম।আর সেইদিন আরিয়ার জন্মদিনে আরিয়া তার মাকে চেয়েছিল।কিন্তু আপনি বলেছিলেন তার অহংকারী মা তার কাছে কখনো আসবে না।আপনার মাও আপনাকে অনেক রিকুয়েষ্ট করেছিল আপনার অতীত ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করতে।কিন্তু আপনি আপনার মাকে বলেছিলেন আপনি দ্বিতীয়বার কাউকে মনে জায়গা দিতে চান না।স্যার আপনার সাথে আমি এতোদিন কাজ করি কিন্তু আপনার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না।এবং আপনার বন্ধু রাফিকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে সব কথা মেয়েদের জানতে নেই।এবং কি উল্টোপাল্টাও কথা বলে।মেয়েরা বেঈমান,একজন পেলে আরেকজনকে ভুলে যায়।আরও অনেক কিছু।
আয়ান মুচকি হেসে শান্ত গলায় বলল,হ্যাঁ আগে আমারও ধারণা তাই ছিল।তবে দুইদিন আগে সেই ধারণা ভুলে পরিনত হয়েছে।আমি এখন বলবো, মেয়েরা পারেনা এমন কোনো কাজ নেই।হয়তো নিজেকে কষ্ট দিয়ে ফ্যামিলির মুখে হাসি ফুটাতে জানে।
-স্যার, আরিয়া কি আপনার মেয়ে?
আয়ান সে ব্যাপারে কিছু না বলে সুমনাকে বলল,তুমি না জিজ্ঞেস করলে পারভীন বেগমকে আমি চিনি কিনা?
হুম চিনি।এবং ভালো করেই চিনি।ওনি অহংকারী,বদমেজাজি একজন মহিলা। তবে ভালো একজন মা।তোমরা আমাকে বলতে না? স্যার বিয়ে করেন না কেনো? কবে বিয়ে করবেন?
তুমি একটু আগেও আমাকে আরেকটা প্রশ্ন করলে আরিয়া আমার মেয়ে কিনা? তুমি ভালো করেই জানো আরিয়াকে আমি কীভাবে পেয়েছি। তারপরও তুমি প্রশ্নটা করলে।
সুমনা, এতোদিন ভাবতাম বিয়ে আমি করবো না।কিন্তু কাল ডিসিশন নিয়েছি বিয়ে আমি করবো।তবে একটু সময়ের দরকার।
কথা বলতে বলতে মিনু চলে এসেছে।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে,আয়ান আর সুমনা কথা বলছে দেখে ভিতরে না গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-মিনু ভিতরে আসো।তোমার জন্যই এতোক্ষণ অপেক্ষা।
কাল যে রোগী আসছে ওনার সব দ্বায়িত্ব তোমার।যাওয়ার সময় আমি বুঝিয়ে দিয়ে যাবো সবকিছু। সুমনা তুমি কতক্ষণ আছো?
-স্যার আমি দুপুরের পরেই চলে যাব।
-ওকে,তবে যে সময়টুকু আছো ওই রোগীর খেয়াল রাখবা।ওনার মেয়ে হয়তো আসতে পারে। আসলে আমার সাথে দেখা না করে যেন না যায়।আমি বিকেলে আবার আসবো।
-স্যার আপনি চলে যাচ্ছেন?
-হুম, বাসায় যাব,সেখান থেকে আরেকটা অপারেশন আছে তবে অন্য হসপিটাল সেখানে যেতে হবে।
নিলিমা বেগম নাশতা করছে,সাথে আরিয়াও।আজ চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে সে।নিলিমা বেগম খেতে খেতে বললেন,শিরিন কাল যে মেয়েটা আসলো তোর কাছে কেমন লাগলো?
কথাটা শুনে শিরিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,খালা, মেয়েটা অনেক ভালো,আরিয়াকে কি সুন্দর করে আদর করছে,আয়ান ভাইয়াও কিন্তু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে আমি খেয়াল করেছি।
-আরে পাগলি আয়ান তো দেখবেই।কারন এটাই তো সেই মেয়েটা যার জন্য আয়ান বিয়ে করেনি।
শিরিন অবাক হয়ে,খালা আপনি কালকে বলেননি কেনো? তাহলে আমি আরও ভালো করে একটু দেখে নিতাম।মেয়েটা সত্যিই অনেক সুন্দর। আয়ান ভাইয়ার পছন্দ আছে।মেয়েটার তো বিয়ে হয়নি বলল,তাহলে তখন বিয়ে করেনি কেনো?
-সে অনেক ইতিহাস।পরে একদিন বলবো।
-কিসের ইতিহাস মা?
আয়ানের কথা শুনে নিলিমা বেগম হতভম্ব হয়ে,ও তেমন কিছুনা।
আরিয়া চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে,দাদী তুমি বাবাইয়ের কাছে মিথ্যা বলছো কেনো? বাবাই আমাকে বলেছে মিথ্যা বললে আল্লাহ পাপ দেয়,তাইনা বাবাই?
-হুম আরিয়া, আমার লক্ষ্মী মেয়ে।কথাটা বলে আরিয়ার কপালে একটা চুমু দিয়ে, এইবার বলো দাদী কি মিথ্যা বলেছে?
-তোমার বিয়ে,,আমার বাবার বিয়ে।ওইযে কাল যে আন্টিটা আসলো তার সাথে।বাবাই ওই আন্টিটা কী আমার মা?
আয়ান হাঁটু গেড়ে আরিয়ার সামনে বসে,গম্ভীরমুখে বলল,তুমি চাও ওই আন্টিটা তোমার মা হোক?
-হুউউউম,,আমি চাই।জানো ওই আন্টিটা আমায় তোমার মতো করে পাপ্পি দেয়।তোমার মতো করে ভালোবাসে। বাবাই মাকে আমায় এনে দিবে?
আরিয়ার কথা শুনে আয়ানের চোখ টলমল করছে,
-আচ্ছা আরিয়া ওই মা যদি তোমায় আদর না করে?
কথাটা শুনে আরিয়া মন খারাপ করে কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে, আচমকা আবার খিটখিট হাসি দিয়ে বলল,বাবাই ওই মা কিন্তু খারাপ মা নয়। আমি মাকে দেখে বুঝে গেছি মা আমাকে অনেক ভালোবাসবে।তুমি দেইখো।
আয়ান আরিয়ার গালে চুমু দিয়ে,আমিই তোর মাটাকে চিনতে পারলাম না।
আয়ান ফ্রেশ হয়ে হসপিটাল চলে গেল।
কাল আরিয়াকে দেখে যাবার পর থেকে প্রাপ্তির ভালো লাগছে না। তাই আজ ইচ্ছে করেই আয়ানের বাড়ি আসলো।আরিয়া প্রাপ্তিকে দেখে দৌড়ে ঝাপটে ধরে,দাদী দেখো মা এসেছে, দাদী তাড়াতাড়ি আসো আমার মা এসেছে।
প্রাপ্তি কিছুটা অবাক হলেও মা ডাকটা তার হৃদয় যেন স্পর্শ করে গেল আরিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে,তোমাকে কে বলল আমিই তোমার মা?
-বাবাই বলেছে।
কথাটা শুনে প্রাপ্তি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সত্যিই আয়ান বলেছে আমি ওর মা? শিরিন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে,আরে ভাবী আপনি ওইখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? এইখানে এসে বসুন।প্রাপ্তি লজ্জা যেন আরও বেড়ে গেল।একরাতে কি এমন ঘটলো,কেউ মা,কেউ ভাবি ডাকে?
.
.
.
চলবে...............................